![]() |
পিনাকী চৌধুরী |
মাহেশের রথযাত্রা : পিনাকী চৌধুরী
করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় এইবছর স্থগিত হল মাহেশের ৬২৪ তম রথযাত্রা ! বাস্তবে শ্রীক্ষেত্রের পরেই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা হিসাবে পরিগণিত হয় এই মাহেশের রথযাত্রা। তবে মাহেশের রথযাত্রার একটি ঐতিহ্য এবং ইতিহাস রয়েছে ! কি সেই কাহিনি ? আজ থেকে প্রায় ৬২৪ বছর আগেকার কথা। সেইসময় মাহেশে একজন উদারমনস্ক ও সর্বত্যাগী ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তাঁর নাম ছিল ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী। তিনি গঙ্গার তীরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে গভীর সাধনায় মগ্ন হন । তারপরে হঠাৎই একদিন পরিব্রাজক হয়ে তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন ! তীর্থভ্রমণ করতে করতে তিনি অবশেষে শ্রীক্ষেত্র পুরীতে গিয়ে উপস্থিত হন। এই ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর মনে সুপ্ত বাসনা ছিল যে, তিনি নিজে ভোগ রান্না করে প্রভু জগন্নাথ দেবেকে নিবেদন করবেন। কিন্তু তিনি তা করতে গেলে সেখানকার পান্ডারা তা জেনে ফেলেন এবং প্রচন্ড রেগে যান। সেখানকার তথাকথিত পান্ডারা সেই সন্ন্যাসীকে রীতিমতো অপমান করে পুরী ধাম থেকে তাড়িয়ে দেন ।
এদিকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী মনে খুবই ব্যথা পেলেন এবং এক বট বৃক্ষের নীচে বসে মনের দুঃখে ভাবতে লাগলেন যে, প্রভু জগন্নাথ দেবেকে যখন আর ভোগ নিবেদন করা হল না, তখন আর বেঁচে থেকে কি লাভ ! তিনি ঠিক করলেন যে, এই প্রাণ আর রাখবেন না ! অন্তর্যামী প্রভু জগন্নাথ দেব ধ্রুবানন্দের মনের ব্যথা বুঝতে পারলেন ! স্বপ্নে দেখা দিয়ে জগন্নাথ দেব ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীকে বললেন " ধ্রুবানন্দ , তুমি দুঃখ কোরোনা। তুমি আমাকে অবশ্যই ভোগ নিবেদন করতে পারবে। আমি এখন থেকে মাহেশেও অধিস্ঠান করবো ! তাই তুমি এখন মাহেশে ফিরে যাও।মাহেশে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে একটি নিমকাঠ ভেসে আসবে। সেই কাঠ দিয়ে তুমি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি নির্মাণ করবে। আর আমি সেই মূর্তিতে অধিস্ঠিত হব !" স্বপ্নে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী প্রভু জগন্নাথ দেবের দর্শন পেয়ে এবং দৈববাণী শুনে যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন ! সেই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী মাহেশে ফিরে এলেন। ভাগীরথীর তীরে ধ্রুবানন্দ আবার গভীর সাধনায় রত হলেন ! বর্ষণমুখর এক প্রবল দুর্যোগের রাত , প্রকৃতি যেন তান্ডবলীলা চালাচ্ছে। ভাগীরথীও উথাল পাতাল ! এর মধ্যে তিনি যেন দিব্যকর্ণে শুনতে পেলেন, কে যেন তাঁকে বলছে " ওঠো ধ্রুবানন্দ , জয় জগন্নাথ। ওই দেখো , তোমার সেই কাঙ্ক্ষিত নিমকাঠ ভেসে আসছে !" অবশেষে চোখ মেলে তাকালেন ধ্রুবানন্দ, সত্যিই তো....! আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন তিনি ।এক কোমর জলে নেমে পড়লেন, আর সেই নিমকাঠটি যেন ইচ্ছে করেই তাঁর বুকের কাছে এসে থেমে গেল ! তিনি পরম ভক্তিতে সেই কাঠে মাথা ঠেকালেন ! নিমকাঠতো পাওয়া গেল , কিন্তু শ্রীবিগ্রহ তৈরি করে করবে ? হঠাৎই একজন এসে উপস্থিত হলেন , বললেন তিনি সূত্রধর। তিনিই মূর্তি নির্মাণ করবেন। ধ্রুবানন্দ বললেন , এই মূর্তি পুরীর মন্দিরের মুর্তির থেকে আলাদা হবে।
সুভদ্রা ও বলরামের মূর্তি প্রভু জগন্নাথ দেবের থেকে কিছুটা ছোট হবে । আর প্রভু জগন্নাথ দেবের নয়নযুগল আয়ত হবে, অর্থাৎ জগন্নাথ দেব আয়তলোচন হবেন ! রুদ্ধদ্বার কক্ষে মূর্তি নির্মাণ শুরু হল এবং নির্দিষ্ট সময়ে নির্মাণ সম্পন্ন হল , কিন্তু দরজা খুলতেই দেখা গেল সেই সূত্রধর নেই ! অবাক কান্ড ! ভক্তদের বিশ্বাস, এই সূত্রধর ছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা ! অতঃপর ধ্রুবানন্দ খড় ও পাতা দিয়ে পর্ণ কুটির তৈরি করলেন । সেই পর্ণকুটিরে প্রতিষ্ঠিত হলেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা ! ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর মৃত্যুর পরে পুজোর দায়িত্ব নেন কমলাকর ঠাকুর। এখানে উল্লেখ্য যে, মাহেশে প্রভু জগন্নাথ দেবের প্রথম মন্দিরটি গড়ে তোলা হয় ভাগীরথীর তীরে। যদিও পরবর্তীসময়ে গঙ্গার ভাঙনে মন্দিরটি নষ্ট হয়ে যায়। তারপরে রাজপথের পশ্চিম দিকে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। উত্তর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার জনৈক নয়নচাঁদ মল্লিক মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এখানে পুরীর মতোই শালগ্রাম শিলার ওপর রত্নবেদী । এই বেদীর উপর অধিস্ঠিত জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। মাহেশের আগের রথটি ছিল কাঠের তৈরি। বর্তমান রথটি লোহার। এটি তৈরি করে দেন শ্যামবাজারের বসু পরিবারের দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু । বর্তমান রথের উচ্চতা ৫৩ ফুট , ওজন ১২৫ টন । চারতলা রথটিতে মোট ৯ টি চূড়া রয়েছে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন