দেহব্যবসা ও নারী পাচারের এক খণ্ডচিত্র : সূরজ দাশ

সূরজ দাশ
নার্গিসের ঘরে ফেরা
নার্গিস! ১৭ বছর বয়স! প্রকৃত বাপ-মায়ের পরিচয় জানে না সে। ওর বাড়ি যশোর। বড় হতে হতে একদিন দুম করে অনেক বড় হয়ে গেল নার্গিস। তারপর স্বপ্নের রাজপুত্তুরের সন্ধান। রকি! গোপালগঞ্জে বাড়ি। নার্গিস স্বপ্নে বিভোর। রকির কাছে জানতে পারে সে সুখের রাজপ্রাসাদ তৈরি আছে ভারতের মুম্বাই শহরে। তার হাত ধরে পেট্রাপোল-বেনাপোল হয়ে সটান একদিন মুম্বাই।
নার্গিস হাতবদল হয়ে গেলো। ৬০,০০০ টাকা লেনদেন। সে এখন অন্যের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। প্রাসাদ জুড়ে কেবল হাহাকার। এরকম কপাল ছিল, ভাবতেই পারেনি সে। বুক চাপড়ায়। দুঃখ যন্ত্রণাকে প্রতিদিন গলা টিপে হত্যা করে সে। গ্রামের কথা মনে পড়ে তার। ছোট ভাইবোনগুলোর কথা মনে পড়ে। বর্ষাকালে গুঁড়োমাছ। ভাইয়ার চপের দোকানের গন্ধ। পাড়ার নানি, আরও কতকার কথা মনে পড়ে। কি এক অচেনা জগতে চলে এলো! ফেরার রাস্তা জানা নেই। দুবছর হয়ে গেল। গতর আর চলে না।

“হে আল্লাহ্‌, কার ওপর আর ভরসা রাখব!”  বয়স এখন কুড়ি। যৌবন কি তবে ফুরিয়ে এলো? কত হাঙর, কুমীর এলো গেলো...”।

 “রাকেশ,  তুম ক্যায়া মুঝে অপনা দেশ বাপস ভেজ সকতে হো ? মেরি আঁখোকি তরফ দেখো,... ...  দেখতে পাচ্ছ আমার পদ্মার ঢেউ ???”
রাকেশ মুম্বাই থেকে হাওড়াগামী ট্রেনে চাপিয়ে দিল নার্গিসকে।
“যশোর, তুমি কতদুর?  খুলনা ভালো আছো? বরিশালে বড় আপা থাকেন। ভালো আছেন আপা? আমি আইতেসি।”

সাপ-খোপ, ব্যাঙ-টিকটিকির বেড়াজাল ছিঁড়ে হাওড়া থেকে শিয়ায়লদা হয়ে বালুরঘাট। দুদিন সেখানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আশ্রয়ে। তারপর সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে হিলি চেকপোস্ট দিয়ে নার্গিস পৌঁছে যায় মাটির কাছে।

সীমান্ত প্রহরীর নল উপেক্ষা করে হিলি রেলষ্টেশনে  আনন্দে কাঁদছে নার্গিস। এ এক অন্য অনুভুতি। অন্য স্বাদ। আকাশের দিকে বারবার তাকিয়ে বলছে, “কত কি দেখলাম আল্লাহ্‌, আর কিছু দেখতে চাই না। কেবল আমি রকির মতন জল্লাদদের ফাঁসি চাই আল্লাহ্‌... এই সামান্য মেহেরবানিটুকু করো, হে আল্লা।”

রেস্টুরেন্টে দীপিকা
শহরে ফ্লাইং কিছু মেয়ে আছে, এদের নিয়ন্ত্রণ করেন এক শ্রেণীর মানুষ,  যাদের ভাড়া পাওয়া যায় দু ঘণ্টা তিন ঘণ্টার জন্য। যারা আপনার সঙ্গে রেস্টুরেন্ট, পার্ক, সিনেমা হল, মোটর বাইকের পেছনে ঘুরে আপনাকে দিলদার যৌন অনুভুতি  উপহার দেবে। এই কালচালচারটা আমাদের শহরে ক্রমশ বাড়ছে। এই মেয়েরা কখনও কখনও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পাশাপাশি এদের অনেকে পরবর্তী কালে  পাচার হয়ে যায়।  এই ধরণের অল্পবয়সী মেয়েরা কিছুটা বয়সের তাড়নায়, কিছুটা পারিপার্শ্বিক বদ বন্ধু বান্ধবীদের খপ্পরে অথবা ভালো মন্দের বিচার না করার ফলে এরা ধীরে ধীরে নিজের অজান্তে সেক্স র্যাছকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পরছে এবং পাচারের শিকার হয়ে পরছে।

দেশে প্রতি মিনিটে একটি শিশু কন্যা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এছাড়া কমপক্ষে ২০ হাজার শিশু কন্যা  পশ্চিমবঙ্গে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছে। ট্রাফিক সিগন্যালে এদের কাউকে কখনো দেখা যায় ফুল অথবা অন্য কোনো পণ্য বিক্রি করতে। কখনো বই বা গাড়ির কাঁচ মুছে দিচ্ছে ওরা। কিন্তু রাত হলেই ওরা নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে। বাঁচার তাগিদে কিংবা ক্ষুধা মেটাতে দেহ ব্যবসাই সম্বল তাদের।

ওদের বেশিরভাগই পরিস্থিতির শিকার। শিশু অধিকার নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের হিসেবে ওরা যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের রক্ষায় কোনো নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ রাষ্ট্র তাদের রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা রাখেনি।  পথশিশু, তাকে যে নামে ডাকা হোক না কেন যাদের বেশিরভাগ মেয়ে শিশু। আর মেয়ে শিশুরাই বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় সহজে। পথশিশুদের মধ্যে যারা মেয়ে তাদের মধ্যে অন্তত ১৯ ভাগ বাধ্য হয় পতিতা বৃত্তিতে। এক সময় এদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে। শিশুদের যৌন নির্যাতন আমাদের সমাজে নিষিদ্ধ হলেও এর সুরাহায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। শিশু শ্রম, পাচার ও নিগৃহীত হবার মত যৌন নির্যাতন নিয়েও কোনো শলাপরামর্শ হয় না। জাতীয় শিশু নীতিতে এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা নেই। যৌন নির্যাতনের পর শিশু কন্যাদের নানা ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। এদের অনেকে হতাশ হয়ে পড়ে, মাদকাসক্ত হওয়া ছাড়া তীব্র অবসাদে ভোগে এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন যৌন রোগে আক্রান্ত হলে তা অন্যের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত বা বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে তারা শেষ পর্যন্ত  আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না।যৌন শিক্ষা ও স্কুলভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে।

টু বাই টু পুশব্যাক
পেটের দায়ে যে যৌনকর্মীরা রাস্তায় নেমেছে পুলিশের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে হয় তাদের। বয়স ১৮ হওয়ার আগেই যৌন অভিজ্ঞতা হচ্ছে ৫০ শতাংশ শহুরে তরুণের। এছাড়া প্রায় ৮০ শতাংশ তরুণ পরোক্ষভাবে প্ররোচিত হয়ে যৌন কর্মে লিপ্ত হচ্ছেন। এদের এক-তৃতীয়াংশ আবার লিপ্ত হচ্ছেন দলগত যৌনকর্মে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের যৌনসঙ্গী হচ্ছেন পেশাদার যৌনকর্মী। কিন্তু এসব তরুণের অর্ধেকই যৌনকর্মে একদমই নিরোধ ব্যবহার করছেন না। বাকীরাও নিরোধ ব্যবহারে অনিয়মিত। তাই তাদের মধ্যে এইডস ঝুঁকি বাড়ছে। এদিকে এমন অনিরাপদ যৌনকর্মের মাধ্যমে ৫২ শতাংশ এইডস ছড়ায় বলে মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পেশাদার যৌনকর্মীর কাছে যেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া তরুণের প্রায় ৭৯ শতাংশই এইডস সম্পর্কে সচেতন নন। যৌন মিলনের পর যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করলে এইডস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না বলেও মনে করেন তারা। যৌনকর্মে লিপ্ত হতে এসব তরুণের ৮০ শতাংশ যাচ্ছেন আবাসিক হোটেলে। আর ২০ শতাংশ অপেশাদার যৌনকর্মীর কাছে যাচ্ছেন। আর জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ তরুণ হওয়ায় দেশের বৃহৎ ও নিভর্রশীল এই জনগোষ্ঠী ব্যাপক ঝুঁকিতে মধ্যে আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে বড় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, তরুণদের অধিকাংশ যৌন চাহিদা মেটাতে যৌনকর্মীর কাছে যাচ্ছেন। সব ধরণের যৌন আচরণ করছেন। গবেষণায় দেখা যায়, এসব তরুণের প্রায় ২০ শতাংশের মধ্যে যৌনবাহিত ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা যায়। তবে এদের মাত্র ১৫ শতাংশ চিকিৎসকের কাছে যান। আবার অনেকে পর্ন সিডি দেখে যৌন কর্মে উৎসাহিত হন। এদের অনেকের বয়স ১১ থেকে ১৪ বছর। এছাড়া বিবাহিতরাও যৌনকর্মীর কাছে যাচ্ছেন বলে দেখা গেছে গবেষণা জরিপে।

গভীর বন্ধুত্ব পেতে হলে ফোন করুন এই নম্বরে
ফোন  করলে একজন পুরুষ রিসিভ করে। বিনয়ের সঙ্গে জানায়, হ্যালো, বলুন কি সেবা করতে পারি স্যার ? আপনার ফোনের অপেক্ষায় আছেন বিভিন্ন কলেজ, ইউনিভারসিটির ছাত্রী ও মধ্য বয়সের মহিলারা। আপনাকে অনাবিল আনন্দ দিতে আমরা প্রস্তুত। এভাবেই একটা বিরাট সেক্স র্যা কেট তাদের ব্যবসার জাল ছড়িয়েছে মহানগর থেকে জেলা শহর, সর্বত্র। আপনার সুবিধা মতন যেখানে চাইবেন, সেখানেই ওদের পরিষেবা পৌঁছে যাবে। কেবল ফেলো কড়ি। ব্যাঙ্ক একাউন্ট নম্বরে টাকা দিন, বিনিময়ে অফুরন্ত মস্তি। আপনার চাহিদা মতন যোগান সর্বত্র। বিজ্ঞাপনের ভাষা লক্ষ করলেই দেখবেন – বোল্ড রিলেশনশিপ, স্ট্রং রিলেশনশিপ ইত্যাদি ধরণের বাছা বাছা শব্দ বন্ধ। নীচে কয়েকটি বিজ্ঞাপনের টুকরো তুলে দিলাম। বুঝতে সুবিধা হবে। যা প্রতিষ্ঠিত দৈনিক খবরের কাগজগুলোতে রোজই প্রকাশ হয়। পাঠক পড়ুন।
ক) আমি আলো, বন্ধুত্বের মাধ্যমে সবরকমের রিলেশনে আগ্রহী , ফোন করুন এই নম্বরে ---
খ) আমি কবিতা, আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে প্রচুর আনন্দ  ও ইনকাম করুন।
গ) হার্টবিটে আজই ফোন করে নিজের আনন্দ উপভোগ করুন আর মনের শূন্যতা পূরণ করুন, ঠকার ভয় নেই।
ঘ) স্বপ্নের পরিদের সঙ্গে উষ্ণ যৌবনের মজা নিতে আসুন ঠকবেন না। ফোন ---
ঙ) প্রিন্স ক্লাব – ঠকবার ভয় নেই। বোল্ড রিলেশন, বন্ধু না হলে ফি ফেরত। গভঃ রেজিঃ।
চ) মধুরিমা উদার সম্পর্কে আগ্রহী। উদার মনের বান্ধবী, নিজ এলাকায় পেতে ফোন করুন ...

ছ) দেশি – বিদেশি সুন্দরী মহিলাদের সঙ্গে বোল্ড রিলেশন। ভ্রমণ ও গাড়ির সুবিধা।

জ) ফাস্ট চয়েস – বিশ্বাস ও গোপনীয়তার সাথে জীবনের একাকীত্ব দূর করুন। ফোন ---

এভাবেই মহানগর থেকে জেলা শহর হয়ে বিভিন্ন মফসসলে দেহ ব্যবসার রমরমা। এদের মধ্যে অনেকেই আবার নারী পাচারের শিকার হয়ে পরছে। আমার দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা থেকে প্রতি মাসে প্রায় গড়ে ৭০ – ৮০ টি মেয়ে কিশোরীরা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। যৌন ব্যবসার ফাঁদে যে কোনও সময় যে কোনও মেয়ে ফেসে যাচ্ছে। তার একটা বড় মাধ্যম মোবাইল ফোন। সবার হাতে মোবাইল। যার সাইড এফেক্ট নারী পাচারের ফাঁদে পরা। যৌন ব্যবসায় লিপ্ত হয়ে পরা।

দালালচক্র ও হোম সার্ভিস
 হোটেল আর রাজপথ পেরিয়ে চামেলিরা এখন যুক্ত হয়েছে হোম সার্ভিসে। তাদের এ পেশার নেপথ্যে রয়েছে শক্তিশালী দালাল চক্র।  হোটেলের ম্যানেজার ও বেয়ারারা  কমিশনের ভিত্তিতে খদ্দের যোগাড় করে দেয় তাদের। অনেক পেশাদার যৌনকর্মী অবশ্য নিজেরাই ফোন নম্বর বিলি করে। এসব কার্ডে সাধারণত মধ্যস্থতাকারীর মোবাইল নম্বর থাকে। পার্ক, ওভারব্রিজ এলাকায় তাদের তৎপরতা বেশি। হারবাল চিকিৎসা, হোল বডি ম্যাসাস পার্লারের আড়ালে চলে দেহ ব্যবাসা। এরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের পরিচিত মানুষের মাধ্যমে খদ্দের পেয়ে থাকে। আমাদের শহরের প্রায় সব এলাকায় চলে এই ব্যবসা। ভিআইপি এলাকায় যৌন ব্যবসা পরিচালিত হয় বিশেষ গোপনীয়তায়। সেখানে যাতায়াত করে বিশেষ ধরনের খদ্দের। পারিবারিক আত্মীয় সেজে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আপনার আমার বাড়ির পাশেই হয়তো দীর্ঘদিন ধরে চলছে এই ব্যবসা। আপনি ঘুণাক্ষরেও তা জানেন না। মানুষের আদিম প্রবৃত্তিকে হাতিয়ার করে একালের দালালরা খদ্দেরদের আধুনিক সুযোগ সুবিধা দিয়ে অনায়াসে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরাট কর্মকাণ্ড। এমন বাড়িও আছে, যেখানে দিনের বেলায় স্বামী অফিসে, সন্তান স্কুলে আর সে সময় সকলের অজান্তে সেই বাড়িতে চলছে যৌন ব্যবসা।

চামেলির দু’দেশ
বছচামেলি সাধারণ  একটা মেয়ে,  বয়স ২৪। সীমান্তবর্তী এক প্রত্যন্ত গ্রামে তার বাড়ি। স্বামী পরিত্যক্তা। বাড়িতে বুড়ি বিধবা মা। ঘরে শতচ্ছিন্ন অভাব। বাধ্য হয়ে তাকে বেছে নিতে হয় যৌনকর্ম। নিকটবর্তী শহর বাংলা হিলি। সেখানকার হোটেলে পুলিশের হয়রানি। এছাড়াও স্থানীয় হোমরা চোমরা ও মস্তানদের উৎপাত। তাদের বখরা না দিয়ে নিস্তার মেলে না। তাই বাধ্য হয়েই হোম সার্ভিসে জড়িয়ে পরে সে। খদ্দেরের কল পেলে বাড়ি যায়। এভাবে  চামেলি ও তার অনেক সঙ্গী, আরও অন্যান্য যৌনকর্মী নানাভাবে তাদের পেশাকে বিস্তৃত করছে এখন। বাংলা হিলি ছাড়িয়ে রাতের অন্ধকারে হামেশায় ওরা চলে আসে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে এপারের হিলিতে। সারারাত কাজ সেরে আবার ঘরে ফেরে, দিনের আলো ফোটার আগে। দীর্ঘ ৬ বছর ধরে চামেলির এই যাতায়াত। তার হাতে আরও অনেকের হাতে খড়ি। যখন এপার থেকে ওপারে পণ্যবাহী ট্রাকের যাতায়াত বাড়ে , তখন চামেলির আয় ভালো বাড়ে। কারণ,  বাইরের খদ্দের অনেক থাকে সে সময়।
চাম্পি মালিশ
আজকাল ভদ্র ঘরের অবস্থাসম্পন্ন শিক্ষিত মেয়েরাও যৌন ব্যবসার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা নেমেছে এ পেশায়। তারা বড় বড় হোটেলে যায়। তাদের কন্টাক্ট নম্বর কেবল হোটেলে পাওয়া যায়। এছাড়াও  স্বামীর অসঙ্গতি, সংসারে ঝামেলা ও বিভিন্ন মানসিক কষ্টের কারণে এ কাজে অনেকে ঝুঁকে পড়ে। যেমন একটা উদাহরণ দিই।  জেলা শহরের অনেকদূরে বসবাস করেন এক মহিলা। নিঃসন্তান। প্রতি শুক্রবার স্বামী কোলকাতা থেকে কাজ সেরে ঘরে ফেরে। ওই মহিলা সপ্তাহে তিনদিন শহরের হোটেলের দালালদের মাধ্যমে খদ্দের নেয়। টাকা রোজগারও হয়, মানসিক ফুর্তিও আসে। তার পরিবার, প্রতিবেশি কেউই জানেন না তার এই গোপন ব্যবসার খবর। পাসাপাশি  হারবাল  চিকিৎসার আড়ালে  শহরে চলে  যৌন ব্যবসা। নিঃসন্তান দম্পতিকে সন্তানের আশ্বাস, জড়িবুটি, তন্ত্রমন্ত্র, তাবিজ-কবজ, সংসারে শান্তি প্রতিষ্ঠা,  হস্তরেখা বিচার প্রভৃতির প্রলোভনেও নির্দ্বিধায় চলছে যৌন নির্যাতন, যৌন ব্যবসা। নর-নারীর যৌন সম্পর্ক বিষয়ে সমাজের অযৌক্তিক নেতিবাচক ধারণার কারণে এ সংক্রান্ত অজ্ঞতা বা নানাবিধ ভুল ধারণা বাসা বেঁধে আছে। এ বিষয়ে যথাযথ তথ্যভিত্তিক বই -পত্রিকার অভাবের কারণে তরুণ-তরুনীদের জন্য নীলছবি এবং পর্ণ ম্যাগাজিন ছাড়া এ বিষয়ে জানার আর সে রকম কোনো উপায় নেই। কিন্তু এইসব নীলছবি দেখে বা পর্ণ ম্যাগাজিন পড়ে কী যৌন সম্পর্ক বিষয়ে কোনো সুস্থ ধারণা তারা পায় ? এইসব নীলছবি এবং পর্ণ ম্যাগাজিনগুলোর বেশিরভাগ-ই বিকৃত যৌন আচরণের দৃশ্যে বা গল্পে ভর্তি। মেয়েদের এখানে সিম্পলি যৌনবস্তু হিসেবে তুলে ধরা হয় এবং ছেলেদের মনে তাদের সম্পর্কে এক ধরণের অশ্রদ্ধা বা 'ব্যবহারের সামগ্রী মাত্র' -ইত্যাদি ধারণা জন্মে। ফলত যৌন চেতনায় আকৃষ্ট হয়ে বহু যুবক বিপথগামী হচ্ছে। বহু মহিলা ট্র্যাপে পরে পাচারের শিকার হচ্ছেন। অল্পবয়সী মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ভিনরাজ্যে পাচার করছেন কিছু অসাধু মানুষ। আমাদের এই জেলার বহু মহিলা শিশু নিখোঁজ। বেসরকারি মতে এই জেলা থেকে প্রতি বছর গড়ে ৪০০ – ৪৫০ মেয়ে নিখোঁজ হয়। যার একটা বড় অংশ নারী পাচারের শিকার।
চম্পার কাহিনি
``পরাণের বান্ধব রে
বুড়ি হইলাম তোর কারণে।
এতো কষ্ট করে আমি
কামাই রোজগার করে আনি
তবুও তো তোর মন পাইলাম না রে।''
কোথায় তার বাড়ি, কোথায় ঘর, আজ আর তেমনভাবে মনে পড়ে না। মাঝে মধ্যে মায়ের কথা মনে পরে। মনে পরে ঘরের কথা। এটি এমন এক কিশোরীর কাহিনী, যার নিজেরই এখনো ১৮ পেরোয়নি। তার বাবা যখন মারা গেলেন, বয়স তখন তার ছয় কি সাত। তখন থেকেই তার মায়ের কাঁধে সংসার চালানোর সব দায়িত্ব বর্তায়। মা দুই-তিনটা বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ নেন। মা যখন কাজে যেতেন,  সে ১১ মাস বয়সী তার ছোটবোনের দেখাশোনা করত। ওরা ছিল তিনবোন। মেজো বোনের বয়স ছিল আট আর ওর তের। অভাবী সংসার।  ঠিক করল সেও একটা চাকরি করবে। কিন্ত এত কমবয়সী একটা মেয়েকে কে চাকরি দেবে? সে না জানে লেখাপড়া, আর না পারে ভারি কোন কাজ করতে। এক বাসায় কাজ নিলো সে।  কিন্ত ঠিকমত কাজ করতে না পারায় মালকিনের হাতে রোজই মাকে মার খেতে হত তাকে। তার অধীনে কাজ করে উপার্জনও খুব একটা হত না। একবেলা খাবার জুটত। কাজেই সংসার চালানোয় মাকে সাহায্য করা ওই কাজের মাধ্যমে তার পক্ষে সম্ভব হত না। তাই দুইমাস বাদেই ওই কাজ ছেড়ে সে একজন যৌনকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে নিজের অজান্তেই।  মা জানতে পারল না সে কোন পথে নেমেছে। খদ্দেরদের কাছে যখন ‘ঠেক’ খাটতে যেত, মাকে বলত যে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আর যখন মায়ের হাতে টাকা তুলে দিত, মা জানতে চাইত সে কিভাবে এত টাকা পেল। মাকে বলত, আমি ইট ভাঙ্গার কাজ নিয়েছি। পাড়া-পড়শী সবাইকেই এই কথা বলে আসছিল সে। একজন যৌনকর্মী হিসেবে তার হাতে খড়ি হয় এক প্রতিবেশির মাধ্যমেই। তাকে সে ডাকতো ‘কাকা’ বলে। সেই কাকাই একদিন তাকে নিয়ে গেল এক লোকের কাছে। সে তাকে ওই লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন তার নতুন ‘কাকা’ হিসেবে। এই লোকটাকে সেদিনই সে প্রথম দেখেছিল। ‘নতুন কাকা’ তাকে বললেন উনার সাথে যেতে। সেও গেল। এক হোটেলে। সেটাই ছিল তার প্রথম। অনেক ব্যথা পেয়েছিল সেদিন সে। এরপর থেকে ফি হপ্তায় তিন-চারবার তার সাথে যেত ওই হোটেলে। একদিন উনি তাকে উনার সাথে উনার বাড়ি নিয়ে গেলেন। সেদিন উনার বাড়িতে অন্য কেউ ছিল না। এরপর থেকে কখনো উনার সাথে হোটেলে যেতে লাগল, কখনো উনার বাড়িতে, যখন বাড়িতে তার বউ বা অন্য কেউ থাকত না। এই ‘নতুন কাকা’ই তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় নতুন এক লোকের সাথে। সেই লোক একদিন তাকে নিয়ে গেলেন হিলির সুপারিপট্টিতে। ও কনডম ব্যবহার করত না। ও ভাবত, দেড়-দুই ঘন্টার নরক যন্ত্রনা ভোগ করে পাচ্ছিই তো মাত্র একশ টাকা। তার থেকে আবার কিছু টাকা কনডমের পেছনে নষ্ট করলে তার হাতে তো আর কিছুই থাকে না। তার খদ্দেররাও কনডম ব্যবহারে খুব একটা সচেতন ছিল না।  সাধারণত বয়স্করাই ওকে ভাড়া করত। তাদের বয়স থাকত ৪০-৪৫ এর মধ্যে। এদের কেউই খুব একটা বড়লোক ছিল না। তার প্রতিবেশি কাকাই এদের সাথে ওর যোগাযোগে দালালের কাজ করতেন। মাঝেমধ্যে কাকাও তাকে ব্যবহার করতেন। কিন্ত এর বিনিময় তিনি তাকে কিছু দিতেন না।  তার খুব কষ্ট হয়। এ কষ্ট যে শুধু শারীরিক, তা নয়। মানসিক কষ্টও বটে! মাসিকের (পিরিয়ড) সময়ও যখন ‘খেপ’ খাটতে হয়, তখন তার খুবই রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু এ দেখে খদ্দেররা কিন্তু একটুও সহায় হয় না। তারা সবসময় ব্যস্ত থাকে তাদের পয়সা উসুল করতে। সে চায় এই কাজ থেকে সরে আসতে। কিন্ত সে জানে, তার এই ইচ্ছে পূরণ হবার নয়। প্রথমত, অর্থের খুব অভাব তার। আর দ্বিতীয়ত, এ এমনই এক পেশা যাতে ঢোকা অনেক কঠিন। কিন্তু এ থেকে বেরোনো? সেটা প্রায় অসম্ভব। চম্পা এখন অস্তগামী যৌবনা। শরীরে সন্দীপন নেই। কেউ আর তার শরীর চায় না। তবু শরীর আর দেহটায় যে তার সম্পদ। এখন নতুন নতুন কিশোরীদের এই লাইনে নামানোর জন্য কসরত করতে হয় তাকে। এছাড়া তার আর কিছু করার নেই। এটাই এখন তার ভবিতব্য।
হিলি সুপারিপট্টি
আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগের কথা। শৈশবে শুনেছি,  এবং একটু বড় হয়ে দেখেওছি, হিলি সুপারিপট্টিতে এক ভগ্নপ্রায় বাড়িতে ‘বেশ্যাখানা’  টিম টিম করে চলছে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার এক প্রান্তিক মৃতপ্রায় শহর হিলি। প্রাচীন বাণিজ্য নগরী। বর্তমানে ইন্দো – বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট হিসেবে খ্যাত এই শহরের বহু ভগ্নপ্রায় ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে আজও। অনেক কিছু অবলুপ্ত হয়েও গেছে ইতিমধ্যে। তেমনি অনেক পুরনো এই জেলার মানচিত্র  থেকে মুছে গেল বহুচর্চিত ‘হারকাটা গলি’।   কালের নিয়মে নাকি অন্য কোনও কারণে এই জেলার একমাত্র এই ঠেকটি বন্ধ হল, তা জানি না। বিষয়টি নিশ্চয়  গবেষণার দাবি রাখে। কানাঘুসায়, বন্ধুদের আড্ডায় বিভিন্নরকম মুখরোচক গল্প শুনতাম আর জারিত হতাম। তখন আমি সম্ভবত কলেজ ছেড়েছি। বিভিন্ন কাজে প্রায় হিলি যেতাম। তখন ছোটোদের সুপারিপট্টিতে যাওয়া একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। মনের ভেতর একটা গোপন ইচ্ছা দীর্ঘদিন ধরে লালন তো হচ্ছিলোই। কেমন সেই সুপারিপট্টির বাড়িটি, কি হয়  সেখানে,  দেহ-ব্যবসা কেমনভাবে চলে, এরকম নানান ধরনের প্রশ্ন মনের ভেতর উঁকিঝুঁকি মারে। এরকমই একদিন দিনের বেলা আমার চেয়ে বয়সে বড় এক বন্ধুর অতি উৎসাহে সেই বিখ্যাত বাড়িটি দেখেতে যাই। তখন আমি ১৮-২০র যুবক। বুকে সাঙ্ঘাতিক সাহস নিয়ে সেই গলির ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে যখন যাচ্ছিলাম, ভেতরে একটা অদ্ভুত শিহরণ হচ্ছিল। আড় চোখে দেখছিলাম সেই বাড়িটির ভেতরের বাসিন্দাদের। সেদিন দেখেছিলাম ২জন ৩০-৩৫ বছরের মহিলা। খুব আপন মনে গৃহকর্মে নিয়োজিত। আমরা যে ওদের দেখছি, সে দিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই ওদের। দেহ ব্যবসা আদতে কিভাবে হয়, সেখানকার পরিস্থিতি কি, কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু সেদিনের সেই শিহরণ এখনো মনে পড়লে ওই ২ জন মহিলাকে এখনো মনে মনে  খুঁজি।  কেন জানি না, সেদিন ওই পবিত্র স্থান দর্শন সেরে বাড়ি ফিরে আসার স্মৃতি আজও অম্লান।  সে কথা না হয় পড়ে অন্যত্র কখনও বলবো। আজ বেশ কিছু বছর হল, সুপারিপট্টির সেই ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। শোনা যায়, এখানকার শেষ হার্টথ্রব  ছিল  চম্পা ও চামেলি। কি সব ঝঞ্ঝাটে একদিন বন্ধ হয়ে গেল এই ঠেক।  এলাকার মানুষ জানায় চম্পা এখন এক যুবকের সঙ্গে সংসার পেতেছে। আসা ছিল নিজের এলাকায় ঘর বাঁধবে সে। কিন্তু বিধি বাম। হিংস্র ক্ষুধার্ত পশুগুলো তো চম্পার মাংসের স্বাদ খোঁজে। ফলত একদিন দুজনে পারি দিল মুম্বাই। চামেলি ও দেশে এখন কোথায় কি করছে জানা নেই।
কালিকাপুরের রাগী ডান্ডিবুড়ি
বাতগ্রস্ত ডাণ্ডি বুড়ির শরীরে কোনও দুঃখ নেই, শোক নেই। আছে শুধু ব্যাধির যন্ত্রণা। তার একমাত্র ১৬ বছরের মেয়ে এখনো নিরুদ্দেশ। সে জানে এ জন্মে আর কখনও ফিরে আসবে না সে। তবু শত যন্ত্রণার মাঝেও মেয়েটার মুখটা মনে পরে। শরীর কবেই শেষ হয়ে গেছে। এখন কেবল কচি মেয়ের সন্ধান। এখন আর নিজ গৃহে ব্যবসা করতে পারে না। বহু ঝক্কি। পুলিশের চাপ। স্থানীয় মানুষের চাপ। তাই সেন্টার চালানো এখন খুব ঝঞ্ঝাট। এখন ডাণ্ডিবুড়ির স্ট্র্যাটেজি চেঞ্জ। সেন্টার ছড়িয়ে পরেছে শহরের কয়েকটি এলাকায়। ডাণ্ডিবুড়ি এখন লিঙ্কম্যান। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগে আমার মফসসল এই শহরের হার্টথ্রব ছিলেন এই ডাণ্ডিবুড়ি। যুবকদের মুখে মুখে শোনা যায় নানান মুখরোচক গল্প। দুম করে সব বদলে গেল। মোবাইল ফোন সবার হাতে হাতে এসে যাওয়ায় ডাণ্ডিবুড়ির কাজ পরিচালনা খুব সহজ হয়ে গেল। ফোনের মাধ্যমে বুকিং চলে। কমিশন চলে যায় ডাণ্ডিবুড়ির ব্যাঙ্ক অ্যাকাঊন্টে। ডাণ্ডিবুড়ির সঙ্গে এখন যুক্ত আছেন আমাদের তথাকথিত ভদ্র শহুরে নাগরিক ব্যক্তিবর্গ। রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও জড়িত।  ডাণ্ডিবুড়ির সংসারে এখন আর অভাব নেই। এ কাজ তার এখন আর না করলেও চলবে। তবু তাকে করতে হয়। ডাণ্ডিবুড়ি জানে, এ এমনই এক পেশা যাতে ঢোকা অনেক কঠিন। কিন্তু এ থেকে বেরোনো? সেটা প্রায় অসম্ভব।
বিউটি পার্লারের ফাঁদ
শহরের অনেক বিউটি পার্লার থেকে ফ্লাইং সেক্স ওয়ার্কার সাপ্লাই হয়। এমন কি পুরুষ সেক্স ওয়ার্কারও পাওয়া যায়। সম্ভ্রান্ত ঘরের অনেক মহিলা তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে পুরুষ সেক্স ওয়ার্কার ভাড়া নিচ্ছেন। কিছু দরিদ্র যুবক, কিছু মস্তিবাজ যুবক ঝুঁকছেন এই ফাটকা ব্যবসায়।
দারিদ্রের নিষ্পেষণে দরিদ্র নারী অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ের মন্ত্র পড়ে, দায়মুক্ত হয় পরিবার।  নিজের পিতামাতার কাছেই যে বোঝা, অন্যের কাছে সে আদরনীয় হবে এটা ভাবা বাতুলতা মাত্র। স্বামী সংসারে নির্মম নির্যাতন আর সীমাহীন অভাব সহ্য করতে না পেরে রোজগারের সহজ পেশা হিসেবে দরিদ্র নারী যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে নেয়। অনেকে দারিদ্র মোকাবিলার জন্য গ্রাম থেকে শহরে আসে, সম্মানজনক উপায়ে দুমুঠো উপার্জন করতে চায়, কিন্তু শহরে জাল পেতে থাকা ধূর্ত দালাল চক্রের খপ্পরে পরে নিজের অজান্তেই একসময় যৌনকর্মী হয়ে উঠে। স্বামী পরিত্যক্তা নারী বারবার প্রেম আর বিয়ের ফাঁদে পরেও যৌনকর্মীর পেশা গ্রহণ করে। এছাড়া কত নারী যে আত্মীয় বন্ধু পরিজন প্রতিবেশীর যৌন লালসার শিকারে ধর্ষিতা হয়ে; সমাজে টিকে থাকার কোনো বিকল্প খুঁজে না পেয়ে যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে নিয়ে ধঁকে ধুঁকে জীবন পার করছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এমন নারীর সংখ্যাও কম নয় যারা অন্য পেশার পাশাপাশি যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে নিয়ে পরিবারে স্বচ্ছলতা আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এদের ৪০% স্বামী পরিত্যক্তা, ১৮% অবিবাহিতা, ১০% তালাক প্রাপ্তা, ২% বিধবা এবং ৩০% বিবাহিতা। ভাসমান যৌনকর্মীদের একটা গ্র“প শহরে বাসা ভাড়া করে এবং সামাজিক জটিলতা এড়ানোর জন্য একজন পুরুষ সঙ্গীকে সাথে রাখে যে কিনা আদতে তার স্বামী তো নয়ই বরং মাসে মাসে মাসোহারা নেয়।
সিনেমা হলের ব্যালকনিতে পিঙ্কি
উচ্চশিক্ষার ব্যয় মেটাতে বহু ছাত্রী দেহ ব্যবসার জীবন বেছে নিচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীই আবার কেবল শিক্ষার ব্যয় মেটাতে নয়, ভিন্ন কিছু করার আগ্রহ থেকেও এমন কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। কিছুটা বান্ধবিদের প্রভাবে, দেহ ব্যবসা যারা পরিচালনা করেন, তাদের ফাঁদে পরে অথবা যৌবনের তীব্র আকুতিতে এ পথে ঝুঁকছেন মেয়েরা। কলেজ এসে পিঙ্কি বেরিয়ে পড়ছেন বয় ফ্রেন্ড এর সঙ্গে। আমার এই মফসসল শহরের সিনেমা হলগুলোতে চোখ রাখলেই দেখতে পাবেন এই দৃশ্য। লক্ষ্য করে দেখবেন আমাদের দেশে বিকৃত রুচির পর্ণ ম্যাগাজিন/বই পড়তে, চলচ্চিত্রে রগরগে ধর্ষণের দৃশ্য  দেখতে এবং পত্রিকায় ধর্ষণের খবর পড়তে এক শ্রেণির মানুষের উৎসাহের কোন কমতি নেই। কিন্তু বিজ্ঞান সম্মত সঠিক যৌন শিক্ষার কথা তুললেই যেন ছি ছি রব উঠে যায়- যেন নিষিদ্ধ  ফল ভক্ষণের কথা বলা হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এ বিষয়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব এক সারিতে এসে দাঁড়ায়।
ফ্লাইং মধুচক্র
আমাদের এই শহরে শুরু হয়েছে গাড়িতে যৌন ব্যবসা। ভ্রাম্যমাণ যৌন কর্মীরা ক্রেতাদের গাড়িতে করে শহরের বাইরে চলে যায়। এখানে সেখানে, রাস্তার ধারে, মাঠে প্রভৃতি স্থানে এরা গভীর রাতে গাড়িতেই যৌন ব্যবসা চলছে রমরম  করে।  এই তো সেদিন পুলিশ একটা লাল মারুতি গাড়িতে রাত ২ টার সময় ধলপাড়ার ব্রিজের কাছে চলমান  মধুচক্রের সকলকে হাতেনাতে ধরলেন। গাড়ির ভেতর নগ্ন অবস্থায় পাওয়া গেল  এক সদ্য যুবতি ও দুজন উঠতি বয়সের সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে। সঙ্গে মদের বোতল। পরদিন থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল তাদের অভিভাবকরা। পুলিশের দুটো পয়সা হলো। গৃহস্তের সম্মান বাঁচল। স্থানীয় মানুষজন সব জানলো। কানাঘুষো চললো এলাকায় কয়েকদিন।  প্রতিদিনের খবরের কাগজে নজর রাখলেই দেখা যায়, আজ এখানে কাল সেখানে মধুচক্রের আসর। সমাজের মান্যগণ্য , মাতব্বরেরা জড়িত এই কাজে। প্রশাসনের নাকের ডগায় চলে এই সব কাণ্ডকারখানা। চোখ বন্ধ করে থাকেন তারা। কখনও কখনও জানাজানি হলে প্রশাসন লোক দেখানো কিছু আদিখ্যেতা দেখায়। তারপর পুনরমুশিকিভব। সীমান্তবর্তি এই জেলার চোরাচালান, পণ্য পাচার, মানব পাচার এক বড় ব্যবসা। যার সঙ্গে নারী শরীর ও মধুচক্র ওতপ্রোত জড়িত। প্রায়ই শোনা যায়, রাতে প্রহরারত সীমান্ত রক্ষীদের নিকট মহিলা, মদ মাংস সরবরাহ করে নির্বিঘ্নে পণ্যপাচার চলছে সীমান্তে। অধিকাংশ ঠেকগুলোর খবর পুলিশের কাছে আছে। তারা সেখান থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকেন নিয়মিত। সাধারণ মানুষের অভিযোগ করার মতন বুকের পাটা নেই কারো।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.

3 Comments:

বিশ্বনাথ লাহা বলেছেন...

সূরজ দাশের কলমে অনেক কিছুই ধরা দেবে, ধীরে ধীরে । এ যেনো সমাজের এই সময়ের দলিল ।

Majed Rahman বলেছেন...

সুরজ দা,
বাংলাদেশ দেশ থেকে অনেক অভিনন্দন ভালো একটি লেখা পড়লাম। সমজের এই অবস্থা পরিবর্তন হবেই একদিন। এই আশা নিয়েই কাজ করতে হবে। ভালো থাকবেন। মাজেদ রহমান, সাংবাদিক বগুড়া, বাংলাদেশ।

Samapti Choudhury বলেছেন...

খুব বাস্তবসম্মত লেখা। খুব ভালো লাগল।