অনেক মেয়েই বুকে বেলকুঁড়ি উঠতে না উঠতে হারিয়ে যায়। কৈশোর না কাটতে কাটতেই অসম প্রেমে জড়িয়ে যায়। সে প্রেমে শরীরী চাহিদা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। শরীরখেলা মিটে গেলে সে মেয়ের ঠাঁই হয় কোথায় ভাবতেও ভয় লাগে বেবীর।
একবুক উদ্বেগ নিয়ে বড়ো হতে থাকে বেবী। সে কাজ করে একটা প্যাথলজি সেন্টারে। সেখানে মানুষের রক্ত পরীক্ষা হয়। থুতু কফের পরীক্ষা করা হয়। আর যেসব জিনিসের পরীক্ষা করা হয়, তার কথা ভাবলেই প্রথম দিনটা গা গুলিয়ে উঠেছিল বেবীর। এত নোংরা জিনিসপত্র নিয়ে পরীক্ষা করে সত্যটাকে খুঁজে বের করতে হয় ভাবলেই অবাক লাগে।
পথ চলতে চলতে চোখে পড়ে সরকারি বিজ্ঞাপন। আঠারোর আগে কিছুতেই মেয়ের বিয়ে নয়। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করান। সন্তান দুটির বেশি মোটেও নয়। এসব বিজ্ঞাপন প্রচার করে কি হয়?
যে সমাজে সাট্টা চলে, জুয়া চলে, চোলাই মদ চলে, দেহ ব্যবসা চলে, সেখানে এই কথাগুলো মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে কে? যে সমাজে সরকার লটারির ব্যবসা চালায়, মদ বিক্রির লাইসেন্স দেয়, আর সরকারি কোষাগারের বেশিটা ভরে এই খাতে আদায়ে, সেই সরকারের তরফে এই সব বিজ্ঞাপন কতদূর ভণ্ডামি?
বাবার বক বক শুনে এইসব মনে হয় বেবীর। মাকে সে এসব কথা কখনো বলে না। মা পার্টির মিছিলে যায়। ভোটের সময় মা পার্টির হয়ে খাটে। মা পার্টির অন্ধ সমর্থক। সরকার আর পার্টির মধ্যে কোনো তফাৎ মা স্বীকার করে না।
এইবার দোল আসছে। দোল এলে কদিনের জন্যে গোটা বস্তি মেতে থাকে। বাবার বকবকানি থেকে বেবী শুনেছে ভদ্র বাড়িতে শিশুরা বড়দের পায়ে ফাগ আবির মাখিয়ে প্রণাম করে। বড়রা ছোটোদের গালে মাথায় আবির ছুঁইয়ে আশির্বাদ করে। এই সব বাড়ির মেয়েরা নিজেদের মধ্যে গালে আবির দেয়। কখনও কখনও উঠতি তরুণীকে হালকা আদর করার চেষ্টা করে অনেকে। রঙ মাখানোর ছলে নববধূর গায়ে পিঠে আলতো স্পর্শের সুযোগ খোঁজে কেউ। দোলের দিনটুকুতে বাঙালি সমাজে এই সবের ছাড় থাকে।
অনেক মেয়েও স্পর্শ খোঁজে। যৌন বুভুক্ষু উপোসী রূপসীরাও সমাজবিধি বহির্ভূত স্পর্শ খোঁজে। দোলের দিনটা এই সব ব্যাপারে স্পর্শকাতর হয় না ভদ্রলোকের সমাজেও।
রাজা রাজড়ার দোলে দেহস্পর্শের অবাধ সুযোগ থাকত। বেবী কোথাও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় সে রকম ইঙ্গিত দেখেছে। কোথাও কারো লেখায় পড়েছে বড়ো কাঁসার থালায় আলতা ঢেলে সুগৌরী নিবিড় নিতম্বিনী রূপসীরা বসতেন। ফর্সা তেলটান ত্বক আলতা ছোঁয়ায় রমণীয় হয়ে উঠত। সে সব দিনে সায়া পরার চল ছিল না। সায়া জিনিসটা এসেছে পর্তুগিজ বণিকের হাত ধরে। সায়াহীন লালাভ নিতম্বে মসলিন জড়িয়ে অপার বিস্ময়ের জন্ম দিতেন রাজপরিবারের লাস্যময়ী নারীরা।
কিন্তু দোলের দিনগুলো অসহ্য হয়ে উঠত বস্তিতে বস্তিতে। রঙ স্থায়ীভাবে বসিয়ে দেবার ব্যবস্থা হত অনিচ্ছুক পথচারীর গায়ে। বেলুনে চড়া রঙ গোলা জল ভরে বাসের জানলা গলে যাত্রীকে বিপদাপন্ন করে তুমুল হররা হত। রঙ ফুরালে আলকাতরা পিচ শেষে নর্দমার পাঁক অবধি ছোঁড়া চলত। বিকট রঙ খেলার ভয়ে ভদ্রলোকেরা দোলের দুদিন আগে পরে বস্তি এলাকার ধারপাশ মাড়াতো না।
নিজেদের বস্তির যে মেয়েরা নিজের মতো চলতে চাইত, ছেলেরা চেষ্টা করেও যাকে বশ করতে পারত না, তাকে টার্গেট করা হত দোলের দিনে। অনিচ্ছুক মেয়ের শরীর স্পর্শ তো বটেই, রীতিমতো শ্লীলতাহানির চেষ্টাকেও প্রশাসন হালকাভাবে দেখত।
দোল এলেই এইসব বেআব্রু আচার ব্যবহারের প্রশ্রয় বেবীকে উদ্বিগ্ন রাখত। নিজেকে সে কঠোরভাবে ঘরের মধ্যে আটকে রাখত। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার কাজের জন্য বেছে নিত ভোর রাত্রিকে। গুণ্ডার দল তখন নেশায় অসাড়।
সেই লোকটা কিভাবে যেন বস্তিতে এসে পড়েছিল। কেন সে বস্তির ভিতরের রাস্তা দিয়ে চলছিল বেবী আন্দাজ করতে পারে না। সেই সময়ে একটা মেয়ে স্নান করে নিজের কুটিরে ফিরছিল। বস্তির ছেলেরা স্নান সারা মেয়ের গায়ে রঙ দিতে তীব্র আপত্তি জানায় মেয়ে। সেই রাগে মেয়েটিকে ধরে সব গুণ্ডাছেলেরা চটকাতে শুরু করে। পথচারী লোকটি প্রকাশ্য অনাচার দেখে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তাই তার গলায় ক্ষুর চালিয়ে দিল গুণ্ডারা। ছটফট করতে করতে লোকটা বেবীদের দরজার পাশে আছড়ে পড়ল। 'জল জল' আর্তনাদের পরেও মা তাকে বেরোতে দেয় নি। বেরোয় নি বস্তিতে থাকা অন্য মেয়েরাও।
বিকেলে লাশ তুলে নিয়ে গেল পুলিশ। মা ঝাঁটা দিয়ে রক্তের দাগ ধুয়ে দিয়েছিল নির্বিকার মুখে। যেন মানুষ নয়, মুরগি কাটা হয়েছিল।
পাড়ার কাউন্সিলর এসে বাইট দিয়েছিল দুদল দুষ্কৃতীর মধ্যে হাঙ্গামা। এতে পার্টি জড়িত নয়। যে মেয়ের শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে প্রাণ দিল নিঃসম্পর্কিত তরুণ, সে চুপ করে রইল, যেন কিছুই ঘটে নি। নিহতের হয়ে কোনো কথা কেউ বলল না, সুবিচারের দাবি তুলল না। এমন কি মায়ের প্রখর শাসনে বেবীও মুখে কুলুপ দিয়ে রইল।
দোলের দিন এলেই সেই নিহতের ছিন্ন রক্তাক্ত গলা কয়ে ওঠে জল দাও, জল দাও। বেবী শক্ত করে চোখ বুজে থাকে। চোখের পাতার ভিতরে আর্তনাদরত যুবকের ধড় ছটফট করতে থাকে প্রবল তৃষ্ণায়। বেবী নিজের উরু খামচে নিজের আবেগ স্থির করতে চায়। পারে না। দরজার বাইরে রক্ত হোলি চলতেই থাকে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন