ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে : মৃদুল শ্রীমানী


ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে
 
মৃদুল শ্রীমানী

সেই কবে কুরুক্ষেত্রের মাঠে দাঁড়িয়ে আমাদের কেষ্ট ঠাকুরটি পিসতুতো ভাইটিকে জ্ঞান বিতরণ করেছিলেন, পরিত্রাণাং সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম ধর্মসংস্থাপনার্থায় চ সম্ভবামি যুগে যুগে। তো সারাজীবন ধরে দ‍্যূতক্রীড়াসক্ত যুধিষ্ঠিরকে ঘরের বৌকে পাশা খেলায় পণ রাখা সম্বন্ধে, দুর্যোধনের তরফে ভ্রাতৃবধূর কাপড় ধরে টানাটানি সম্বন্ধে কেষ্ট মশাই কি কি ধর্মসংস্থাপন করেছিলেন আমরা জানি। তো সেই কেষ্ট কথিত বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম বাক‍্যটি বুকে নিয়ে আজ আঠারোই মার্চ ভারতীয় অর্ডন্যান্স দিবস পালন হয়। হ‍্যাঁ, আজ ভারতের অর্ডন‍্যান্স ফ‍্যাক্টরি ডে। ঠিক দেখছেন, অর্ডন‍্যান্স লিখেছি, অর্ডিন্যান্স নয়। 
 
আমাদের দমদমে গুলি বারুদের পরীক্ষার দম দম শব্দ শুনতে পেত লোকে। তাই থেকে দমদম। ইছাপুরে, কাশিপুরে অর্ডন‍্যান্স ফ‍্যাক্টরি আছে। সারা ভারতে মোট একচল্লিশটি ফ‍্যাক্টরি, আর নয়খানি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, আর গোটা তিনেক বিপণন কেন্দ্র নিয়ে ভারতীয় অর্ডন‍্যান্স ফ‍্যাক্টরি বোর্ডের বিপুল সংসার। যুদ্ধ সারা পৃথিবীতে এক বিপুল শিল্প। এই শিল্পের বিকাশে ছোটখাটো স্থানীয় যুদ্ধ বাধিয়ে রাখা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলির মহান কর্তব‍্য। যুদ্ধের প্রয়োজনেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে রাষ্ট্রগুলি টাকা ঢেলেছে। যুদ্ধের ময়দানে প্রমাণ হয়েছে উড়োজাহাজ চলবে না জেপেলিন। প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পেনিসিলিন যে সত‍্যি কতটা দরকার, যুদ্ধ খেলা তা টের পাইয়ে দিয়ে নোবেল জিতে নিয়েছে। যুদ্ধের মাঠে আহত সৈনিকের যথাযথ নার্সিং করলে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা  অনেক বেড়ে যায় দেখিয়ে দিয়ে, এমনকি গাণিতিক প্রমাণ দিয়ে নার্সিংকে বিজ্ঞান পদবাচ‍্য করে দিলেন লেডি উইথ দ‍্য ল‍্যাম্প, আমাদের বরানগরের পাশেই কাশিপুর। সেখানে গান অ্যাণ্ড শেল ফ‍্যাক্টরি। গরিব নিম্নবিত্ত ঘরের একটু ভাল নম্বর তোলা ছেলেপিলেদের পাখির চোখ ছিল ওখানে একটা চাকরি বাগানো। 
 
ওখানে চাকরি মানে নিশ্চিন্তি। হেসে খেলে সংসার চলে যাবে। সিমলা বেড়াতে গিয়ে সেখানে আমাদের কাশিপুর কারখানার তৈরি কামান দেখেছিলাম। পিতলের চাক্তিতে যে সাল লেখা তা সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে। যুদ্ধাস্ত্র বাগানোয় যে যত উন্নত, সে ক্ষমতাদখলে ততদূর পারদর্শী। কামানের কাছে হেরে যায় তীরধনুক। মেশিন গানের কাছে হার মানে সেকেলে কামান। রাণা সঙ্গ পাঠানদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। পাণিপথের যুদ্ধে বাবর শা হারিয়ে দেন ইব্রাহিম লোদীকে। মঙ্গল পাণ্ডেরা দামী অস্ত্রের নাগাল পায় নি। 
 
পাণ্ডবেরা অজ্ঞাত বাসে যাবার সময়ে শমীবৃক্ষে অস্ত্রশস্ত্র বেঁধে তারসঙ্গে একটা মৃতদেহ বেঁধে দিয়ে গিয়েছিল। লাওয়ারিশ মড়া নিশ্চয়ই। তাই মৃতদেহের অন্ত‍্যেষ্টির প্রয়োজন বোধ করেননি ধর্মপুত্র ও তাঁর অসামান্য ভাইয়েরা। অর্জুনকে সেরা তীরন্দাজ বানাবেন, এমন চাকুরিগত শর্ত থাকায় নিষাদ তীরন্দাজ একলব‍্যের বুড়োআঙুল গুরুদক্ষিণা বাবদ চেয়ে নিতে লজ্জা পাননি দ্রোণ। পাশুপত আর ব্রহ্মশির অস্ত্রের নাম মনে পড়ে। আর একপুরুষঘাতিনী। অর্জুন অস্ত্র সংবরণ করতে জানতেন। অশ্বত্থামা জানতেন না। তাই জন‍্যে উত্তরার গর্ভস্থ সন্তান পরীক্ষিৎ মরতে বসেছিল আর কি। এখনো নাগাসাগি হিরোশিমায় বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম দেন মায়েরা। ওপেনহাইমার পরমাণু বোমা ফাটানোর সময়ে গীতার শ্লোক আওড়ান। আর কোনো দেশ তার পরমাণু বোমা ফাটানোর কর্মসূচির কোড নাম দেন বুদ্ধ দাঁত ক‍্যালাচ্ছেন। বুদ্ধ লাফিং। মাতাহারির গল্প পড়েছি। আজো অঘটনঘটনপটীয়সীর ছলাকলায় ভুলে দেশের গোপনীয় তথ‍্য পাচার করে দেয় দেশপ্রেমিক সেনানীরা। তবে সেরা চমকটি দিয়েছিলেন হনুমানজি। 
 
তিনি ব্রাহ্মণ সেজে রাবণঘরণী মন্দোদরীর কাছে রাবণের মৃত‍্যুবাণ চেয়ে নিয়ে এসেছিলেন। মন্দোদরীর মন্দ কপাল। রাবণ ব্রাহ্মণ সন্তান। মুনির ছেলে, মুনির নাতি, খোদ ব্রহ্মার প্রপৌত্র। মন্দোদরী ভাবতে পারতেন না যে, বামুনের ছদ্মবেশে কেউ এসে তাঁর স্বামীর মৃত‍্যুবাণ চেয়ে নেবেন। রামের পিতা দশরথের ছিল শব্দভেদী বাণ। তাইতে তিনি হরিণ মারতে গিয়ে মেরে ফেলেছিলেন অন্ধমুনির পুত্র সিন্ধুকে। সেই অপরাধের সূত্রে রামের জন্ম। ওই অপরাধ না করলে আর রামের জন্ম হত না। রাম মানে দাঙ্গা। রাম মানে পাঁচ শো বছরের পুরোনো মসজিদ ভাঙা। আশারাম রামরহিম মানে শিষ‍্যাধর্ষণ আর সাধুদের লিঙ্গচ্ছেদ।
 
লিঙ্গ‌ও অস্ত্র। রাবণ মরলে রামের বানরসেনা মন্দোদরীকে উদোম করে ঘুরিয়েছিল। যুদ্ধে হেরো পার্টির মেয়ে বৌদের আবার আব্রু কিসের? ধর্ষণ তো তাদের ন‍্যায়সঙ্গত প্রাপ‍্য। পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে স্ট‍্যালিনের প্রশ্রয়ে রাশিয়ান সৈন‍্যরা যা করেছিল, তা দেশে দেশে নিয়মনিষ্ঠ সৈন‍্যবাহিনীর লোকজন করে থাকেন। ইন্দিরা হত‍্যার পর শিখজনগণকে বিনাবিচারে খুন করতে বাধে নি কংগ্রেস নেতাদের। তাঁদের শাস্তি আজো কার্যকর করা হয় নি। চীনের মাটিতে ছাত্রযুবরা গণতন্ত্রের দাবি করলে ট‍্যাঙ্ক চালিয়ে তাদের পিষে দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতৃত্ব। যুদ্ধাস্ত্রের ওই ধর্ম। যে আমার বিরুদ্ধে, সেই দুষ্কৃতী। তাকে খতম করাই ধর্ম। নিরপরাধ? তো কী হয়েছে? ওকে সাঁজোয়া গাড়ির সামনে বেঁধে ঘোরাও। কচি কচি ফুটফুটে কিশোরী! ওদের মুখে ছররা গুলি বিঁধে কুশ্রী করে দাও। 
 
একটা মেয়েকে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহ হচ্ছে? বেছে বেছে ওর যৌনাঙ্গের ভিতর গুলি করো। ওটাই মনোরমার প্রাপ‍্য। কেষ্ট ঠাকুর কুরুক্ষেত্রের মাঠে দাঁড়িয়ে চেল্লাচ্ছেন, সর্ব ধর্মং পরিত‍্যজ‍্য  মামেকং শরণং ব্রজ। ধর্ম টর্ম বাদ দাও, আমি যা বলি সেটাই ধর্ম। বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম, আমি সবাইকে মেরে রেখেছি, ভারত, তুমি নিমিত্ত মাত্র হ‌ও।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.