মাতৃত্ব নিয়ে দু এক কথা : মৃদুল শ্রীমানী

মাতৃত্ব নিয়ে দু এক কথা : মৃদুল শ্রীমানী
মাতৃত্ব নিয়ে দু এক কথা : মৃদুল শ্রীমানী

আমাদের সমাজে নারীত্বের মাপকাঠি কি বাচ্ছার জন্ম দেওয়া????

এই রকম শীর্ষনামে আমার এক বন্ধু একটি পোস্ট সম্প্রতি দিয়েছেন। আমি ধরে নিয়েছি বিষয়টি ওই বন্ধু যেহেতু পাবলিক পরিসরে দিয়েছেন, সেহেতু এতে তিনি নিজের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব গুলো জড়ান নি, নিজস্ব একান্ত পরিসরের থেকে মুক্ত করে বিষয়টি  একটি নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছেন। একটু অ্যাকাডেমিক ধাঁচে দেখতে চেয়েছেন।  আমিও সেই রকম ভেবে জবাব দেবার কথা ভেবেছি। আমার জবাবেও কোনো নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে লক্ষ্য না করে কথা বলার চেষ্টা করছি। 

নারী আমাদের মানুষী সমাজে শিশুর জন্ম দেয়। এটা একটা সাধারণ নিয়ম। আমরা সভ্যতার আগে থেকেই গুহার কোটরের দিন থেকেই এটা দেখে আসছি, শুধু তাই নয়, হোমো সেপিয়েন্স চেহারাটা নেবারও আগে থেকে, এমন কি আমাদের প্রাইমেট পূর্ব পুরুষেরও আগে থেকে, স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকেই স্ত্রীলিঙ্গ যুক্ত প্রাণী গর্ভধারণ করে, প্রসব করে, স্তন্যদান করে। শিশু পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটা সাধারণ নিয়ম। দৈবাৎ ব্যতিক্রম যে থাকে না, এ কথা বলব না। কিন্তু সাধারণ নিয়ম এটা। সুতরাং নারী জন্মের সাথে "বাচ্ছারজন্মদেওয়া???" কে কেউ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত করে দেখলে সেটাকে খারাপ বলি কি করে? প্রকৃতি তো নারীর শরীর বিন্যাসে মাতৃত্বের কাঠামো দান করেছেন। পুরুষ কঙ্কালের তুলনায় নারী কঙ্কালের গঠন বিচার করে দেখুন, নারীর বুকের খাঁচা প্রশস্ত। কেন না, তাকে স্তন্য দান করতে হয়। আর পেলভিক অস্থিবিন্যাস লক্ষ্য করুন। প্রসব করার সুবিধার্থে সেখানেও প্রশস্ত দুয়ার বর্তমান।

নারীর হরমোন এবং গ্রন্থি বিন্যাসে মাতৃত্বের হাতছানি। নারীর দেহ ত্বকের নিচে স্নেহ পদার্থের বিন্যাস তার শরীরে সুগোল পেলবতা নমনীয় সৌন্দর্য দিয়েছে, শিশুর নরম কোল তৈরির জন্যে। নারীর মানসিকতাতেও সন্তানের দায় বহনের ছাপ। সুতরাং যাকে প্রকৃতি এত ভাবে বিকশিত করেছেন সন্তানের গর্ভ ধারণ করতে, প্রসব করতে আর পালন করতে, এবং সেটা আজ হঠাৎ নয়, বহু লক্ষ বছর ধরে, সেখানে এক কথায় "বাচ্ছারজন্মদেওয়া" নারীত্বের সার্থকতা নয়, এটা বলা ঠিক হবে না।  ছোট শিশু কেঁদে উঠলে মায়ের স্তন্যে সে শান্ত হয়। মা তার স্তন বৃন্ত শিশুমুখে গুঁজে দিলে ভীত শিশু ক্রমে শান্ত হয়। আর সন্তানের জন্মসূচনায় স্তন্যপায়ী স্ত্রী প্রাণীর স্তনে দুধের সঞ্চার হয়। অন্য সময় দুধ থাকার কথা নয়। সুতরাং স্তনকে মাতৃ অঙ্গ বলে চিহ্নিত করলে কোনো সমস্যা নেই। অন্তত শিশু কোলে মা প্রকাশ্যে স্তন্যপান করালে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ তাকে যৌন প্রদর্শনী মনে করে না। মনে করে, মা তার পবিত্র দায়িত্ব পালন করছেন। তাই মায়ের কোলে শিশু একটা যুগ যুগ ধরে পবিত্র বন্ধন। অতল অপার মাতৃস্নেহ পারাবার।

আমার বন্ধুটি রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী , সংঘজননী সারদা দেবীর কথা এনেছেন। তাঁর বায়োলজিক্যাল বেবি ছিল না। কিন্তু তিনি মা হিসাবে পূজিতা। শুধু সারদা দেবীই বা কেন, এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা নিজের সন্তান ছাড়াও অন্যের সন্তানকে মাতৃস্নেহ দিয়েছেন । শরৎচন্দ্রের সাহিত্য যারা পাঠ করেছেন, তারা এই রকম মায়ের কথা জানেন। শুধু সাহিত্যই বা বলি কেন,পকসো আইন পড়তে গিয়ে দেখছি, আইন বলছেন শিশুরা মেয়েদের কাছে ভাল থাকে।  তাহলে, শরীরে মা না হলেও মেয়েদের শারীর মানসিক কাঠামোয় কিছু একটা থাকে, যা শিশুদের সুবিধাকর। মেয়েদের ব্যক্তিত্ব শিশুর পক্ষে সুখকর। 

আমি বলব এক রাজার কথা; যিনি বলেছিলেন "সব মুনিসে পজা মমা", সকল মানুষ আমার সন্তান। তিনি রাজা প্রিয়দর্শী অশোক। সন্তানের জন্ম না দিয়েও পুরুষ অশোক সন্তানের কথা ভেবেছেন। আর বলবো রবীন্দ্র কবিতার সেই ভিক্ষুণীর অধম সুপ্রিয়ার কথা, যে বলেছিল, "কাঁদে যারা খাদ্যহারা, আমার সন্তান তারা ..."। সন্তান বলে অন্য মানুষকে ভাবতে পারাতেই মানব জন্মের, শুধু মেয়ে জন্মের কথা বলছি না, মানব জন্মের সার্থকতা বলছি।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.