ঘোর ... কাজী সাইফুল ইসলাম






               

ঘোর

 কাজী সাইফুল ইসলাম


অন্ধ মানুষের সবচে' বড় সুবিধা হচ্ছে, তারা বাতাসের গন্ধ থেকেই বুঝে নিতে পারে সবকিছু।  বাতাসের গায়ে লেপ্টে থাকে শব্দ আর গন্ধ।  এই জিনিসই হচ্ছে মহাজাগতিক ভাষা।  মাঝে মাঝে চোখের দেখা ভুল হতে পারে, কিন্তু গন্ধ আর শব্দের ধরণ চিনে নিতে পারলে তার ভুল হয় না।  যদি ভুলি হবে, তাহলে অপরাধীদের খুঁজতে বিদেশি কুকুরকে ট্রেনিং দেয়া হয় কেন ?  নদীর ভাঙ্গনে বসে থেকে দিনরাত এলোমেলো সব ভাবনায় নিজের মধ্যে একটি জগত গড়ে নিয়েছে মহর আলী।  মহাকাশের মতো।

অন্ধ মানুষের কাছে তো আর দিন রাতের কোনো পার্থক্য থাকে না।  কিন্তু মহর আলীর কাছে সেই পার্থক্যটাই প্রকট হয়ে ধরা দেয়, বাতাসের গন্ধ শুঁকে ঋতুচক্রের খেলা  বুঝে নিতে পারে সে।  সূর্যের তাপে, পোড়া বাতাসের গন্ধে, হঠাৎ করেই বিহ্বল হয়ে পরে মহর আলীর মন।  আবার কোন কোন দিন ভেজা বাতাসে বুকের আকুলি-বিকুলি টের পায়।  এই বুঝি লন্ডভন্ড হয়ে যাবে সব।  নদীর পানি ফুলে উঠে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে গরু ছাগল, মাঠের ধান, কুরেঘর, শস্যের আঁটি। 

গভীর রাতে নদীর ভাঙনে বসে নিবিড়ভাবে কান পেতে থাকে মহর আলী। নদীর তলা থেকে উঠে আসা বুদ্বুদের শব্দ শুনে সে বুঝতে পারে, পানির গভীরতা।  স্রোতের শব্দ শুনে বুঝে নেয়, জোয়ার ভাটার টান লেগেছে নদীতে।

কোন পানিতে কোন মাছ ঘুরে বেড়ায়, বড় ছোট মাছের গুলতানি সে বুঝতে পারে। শব্দ শুনেই।  প্রকৃতির ভাষা বুঝতে প্রায় এক যুগ অনুশীলন করতে হয়েছিল মহর আলীর।  অন্ধ হয়ে যাবার পর তেমন কোন কাজ করতে হত না।  বসে বসে শুধু পাতা ঝরার শব্দ শুনে রাখতো।  আজ কটা পাতা ঝরেছে ঘরের কাছের বড় আম গাছ থেকে।

 নিবিড় রাতে পাতা ঝরার শব্দ শুনতে খুবই ভালো লাগতো তার।  পরে নেশা হয়ে উঠেছিল।  রাত জেগে শুধুই পাতা ঝরার শব্দ শোনা।  বছর শেষে মহর আলী আবিষ্কার করেছিল ১৯৭১৩ টি পাতা ঝরেছে বড় আম গাছ থেকে।  তাহলে তো সেই পরিমাণ নতুন পাতাও গজিয়েছে।  কৌতুহল সামলাতে না পেরে একদিন সকালে উঠে তার ছেলে নজুমিয়াকে ডেকে বলল, বাপ্ ধন, দেখতো গাছে কতগুলো নতুন পাতা গজাইছে ?

ছেলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এক দৌড়ে মার কাছে গিয়ে বলেছিল, আম্মা, আব্বা কি সত্যি সত্যি পাগল হইয়া গ্যালো ? মহর আলী তো আর জন্মান্ধ ছিল না।  যৌবনে শিয়াল শিকার করতে গিয়েই তো চোখ দুটো খেয়েছে।  শিয়াল মারা ছিল তার ভয়ঙ্কর রকম নেশা।  শিয়ালের মাংস খাওয়া হারাম।  আবার বিক্রি করার উপায় নেই।  তবুও সন্ধ্যার পরপরই যখন উঁচু ঢিবির জঙ্গলে শিয়ালের হুক্কা হু হুক্কা হু হুক্কা  ডাক শুনতে পেত,  তখন আর ঘরে বসে থাকতে পারত না মহর আলী।

আল তোলা শক্ত জুতি  নিয়ে বেরিয়ে পরতো।  শিয়ালের পিছু নিয়ে ঝোপঝাড় দৌড়ে শরীর যখন  ঘামে জবজবে, দাম হাফ ধরা ভাব আসে, তখনই যেন তার শান্তি।  কোন কোন দিন শিয়ালের রক্ত ছুটে এসে মেখে যেত মুখময়।  তারপর খুন হওয়া শিয়ালটাকে রাতের অন্ধকারে একাই টেনে টেনে নিয়ে ফেলতো নদীর পানিতে।  তারপর নিজেই নদীতে নেমে হাপুস-হুপুস ডুব আর ডুব। গ্রীষ্ম বর্ষায় এই একই রীতি ছিল তার।  মহর আলীর এ উগ্র নেশা দেখে দিনের পর দিন কপালে ভাঁজ ফেলে বসে থাকতো মতি মিয়া।

 ছেলে তো খুবই খারাপ নেশায় পাইছে।  কবে জানি নিজেই খুন হয়।  রাতে ঘুম হত না মতি মিয়ার। একদিন ছেলেকে ডেকে মতি মিয়া বলে, বাপ্ ধন, শিয়াল তো নির্দোষ প্রাণী। ওগো জীবন নিতাছো ক্যান ? মহা অন্যায় করতেছো।  নিজের বিপদ নিজেই টাইন্যা এঁটেছো ক্যান!  তখন বাবার কথায় কোন রকম ভ্রুক্ষেপ ছিল না মহর আলীর।  শিয়ালের ডাক শুনলেই রক্তের মধ্যে একটা অজানা চার শুরু হতো।  অন্তত একটি শিয়াল কে খুন না  করা পর্যন্ত কোন রকম স্বস্তি ছিল না তার। মহর আলীর এই কান্ড কারখানা দেখে, বিশাল ভাবনার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল মা মরিয়ম।  অনেক ভাবনা-চিন্তা করে ছেলেকে সে বিয়ে দিল।  রক্তে ভাটা পড়লে শরীর এই রাগ আর থাকবে না।  কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়না মোহর আলীর।

 অন্ধ হয়ে নদীর ভাঙনে বসে বসে দৃষ্টিশক্তির ব্যাখ্যাটা খুবই মন দিয়েই ভাবে মহর আলী।  চোখ দিয়ে দেখা আর  মন দিয়ে দেখার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান।  সেই কবে চোখের দেখা সবকিছু এখনো ভিড় করে মনে।  সিনেমা হলে ছবি দেখার মত।  মানুষ তার নাম নিয়েছে স্মৃতি ! স্মৃতি গুলো একেবারেই নতুন।  ঝকঝক করে।  তয় মন দিয়ে দেখার মত অতটা ধারালো না।  অন্ধ হয়ে যাবার পর যা কিছু মন দিয়ে দেখেছে তার সবকিছুই খুবই উজ্জ্বল।  আকাশের তারার মত।

সে দিনের কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে মহর আলীর।  বর্ষাকাল, সারাদিন ধরেই ঝরছে বৃষ্টি।  নদীতে উতলা ঢেউ।  পানির ঢেপার বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ছিল নদীর পাড়।  উল্টাপাল্টা বাতাসে নারিকেল গাছের পাতায় সিস বাজানো শব্দ।  লম্বা-চওড়া শিমুল গাছ তার মাথায় সন্ধ্যা নামতেই মহর আলী বুঝতে পারে আজ অমাবস্যার রাত।  আর রাত নামার আভাস পেয়েই শিয়ালগুলো দলবেঁধে শুরু করেছিল হুক্কা হুয়া হুক্কা হু হু হু হু হু হু।  শিয়ালের ডাক শুনেই হেসেল থেকে দৌড়ে ঘরে আসে মরিয়ম।  মহর আলীর বউ মজিদকে বলে, ও বউ তুই একটু চুলার ধারে বয় দেহি।   মহর এর লগে আমার কথা আছে - পাশে বসে নানা রকম এলোমেলো গল্প ফেঁদে বসে মরিয়ম।  ছেলেকে সে আজ কিছুতেই শিয়াল মারতে যেতে দিবে না।  কথায় কথায় শিয়ালের ডাক ভুলিয়ে রাখতে চায়।  কিন্তু কিছুতেই যেন শিয়ালের কথা ভুলে না মহর আলী।  মায়ের কথা তার কান পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনা।  শুধু শিয়ালের ডাক-ই কানের দুয়ারের সাথে ধাক্কা খেতে থাকে অবিরাম। 

শিয়াল গুলো একসাথে ডাকতে শুরু করে ট্রেনের হুইসেলের মত।  শেষবার যখন একসাথে ডেকে  উঠেছিল অমনি হাতে জুতি নিয়ে এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল মহর আলী।  পিছন থেকে মরিয়ম ডাকে, ও বাপ, ও বাপ রে, বাপ, আমাবস্যা লাগছে রে বাপ।  কারো কথাতে ফিরে না মহর আলী। কে যেন অন্ধকারের গুঁড়ো মিশিয়ে দিয়েছিল বাতাসে, কিছুই দেখতে পাইনি মহর আলী।  ধুম করে পড়ে গিয়েছিল জঙ্গলের খানাখন্দে। অমনি শেয়ালগুলো ওর বুকের উপর উঠে গিয়েছিল আর ছিড়ে নিতে থাকে ওর চোখ আর গালের নরম মাংস। মহর আলীও শক্ত সমর্থ যুবক। এক ঝটকায় সে আসতে পেরেছিল উঠোনে, তারপর শুধুমাত্র একটি শব্দই করেছিল মহর আলী, মাগো তুমি কই ?

অনেক চেষ্টার পর প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল।  কিন্তু চোখ দুটি আর কাজে লাগানো গেল না।  প্রথম প্রথম চোখ দুটি হারাবার জন্য খুবই আক্ষেপ হত তার।  কিন্তু এখন আর কোন আক্ষেপ হয় না।  বরং বুকের ভেতরটা অদ্ভুত একটা শান্তির বাতাস বয়ে যায়।  মনে হয় জন্মান্ধ হলেই যেন ভাল ছিল।  চোখ হারাবার কথা উঠলেই মহর আলী বলে, চর্মচোখে সংসারের বিন্দুবিসর্গ বোঝা যায় না, মনের।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.