অভাগীনির নক্সী-গাঁথা : কর্ণধর মণ্ডল

অভাগীনির নক্সী-গাঁথা : কর্ণধর মণ্ডল
অভাগীনির নক্সী-গাঁথা : কর্ণধর মণ্ডল

পর্বঃ-৩

     এমন বেদনাময় মুহুর্ত দেখে ছেলেটি বাড়ী ফিরে গেলেন।এরপর সারা রাত সে ঘুমাতে পারলোনা।চোখ বন্ধ করলে একটাই ছবি  বার বার ভেসে উঠছে তার মনের হৃদয় ক্যানভাসে।ভাবতে লাগলো প্রতিদিন একান্তে নির্জনে বসে থাকা মেয়েটি কে?একে তো আগে কোনদিন এই গ্রামে দেখিনি।এই ভাবনা বারংবার তাকে ভাবিয়ে তুলতে লাগলো কৌতহলী অবুঝ মন।আবার সে নিজের মনকে নিজেই বলতে লাগলো,ওকে দেখবো বা কেমন করে!কাজের সুত্রে বিদেশ থেকে দীর্ঘঃ দশ বছর পর নিজের গ্রামে ফিরলাম।হয়তো ছোটবেলায় দেখেছি।এখন স্মরণে আসছে না।কারন- মাঝে পেরিয়েছে দশটি বছর।এখন সে হয়েছে সুশ্রী-সুন্দর নব-যৌবনা তরুনী।তাই হয়তো আমার কাছে স্মরনা'তীত।
---যাই হোক আমাকে ওখানে গিয়ে আগামীকাল জানতে হবে ওই মেয়েটি কে?
---কেন?রোজ এখানে এসে নীভৃতে-নির্জন নিরালায় চোখের জল ফেলে।আপন স্বজন কে আছে মেয়েটির বাড়ীতে?
---এমন ভাবনা ছেলেটির নিদ্রাহীন দু'চোখে ভাবিয়ে তোলে সারারাত।রাতের শেষে পুব্-দীগন্তে রক্তিমা'ভায় সুর্য উদীয়মান।পাখীর মধুর কলতানে-কুহু-কুজনে স্নিগ্ধ সকালটা হয়ে উঠলো আরো মোহময়ী ও শান্ত-স্নিগ্ধ।ছেলেটি প্রতিদিনের মতো আজো চলেছে নদী তীরে।কারন তার আবেগী মনে বাঁধ ভেঙেছে নতুন প্রেমের ছোঁয়া লেগে।
    
     কিছুক্ষণ পরে,দেখলো মেয়েটি প্রতিদিনের মতো,আজো একই স্থানে এসে উপস্থিত হলেন এবং নীঃস্তব্ধে বসে পড়লেন।তারপর খাতার পাতায় স্মৃতির আঁকরে বেদনার কালি দিয়ে কি সব লিখতে শুরু করেছেন।অনতিদুর থেকে এমনটাই মনে হলো।এমন দৃশ্য বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর নিজেকে আর স্থির না রাখতে পেরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলেন সুন্দরী বৃক্ষের পাদদেশে উপনীত অচেনা-অজানা মেয়েটি সন্মুখে।
---তারপর,স্ব-হৃদয়ে সুমিষ্ট কন্ঠে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কে?
---কেন এসে রোজ বসে থাকেন নীভৃতে-নির্জনে?
---মেয়েটির নিকট হইতে কোন সদুত্তর পেলেন না।
---আবার,জিজ্ঞাসা করলেন,এভাবেই দুই-তিন বার জিজ্ঞাসা করবার পর।ইতঃস্তত হয়ে মেয়েটি বললেন.....
----আপনি কি আমাকে বলছেন?
----আজ্ঞে!আমি আপনাকেই বলছি।আপনি ছাড়া তো আর এখানে আশেপাশে কেউ নেই।সেহেতু নিঃশ্চয় আপনাকে বলছি।এভাবে দুজনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কথোপকথন চলতে থাকলো।
----তারপর,ছেলেটি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন....
----আপনি কে?
----আপনার বাড়ী কোথায়?
----আপনি কেন রোজ এখানে এসে বসে থাকেন?
----আপনার নামটা কি জানতে পারি?
----আপনি আমাকে বলছেন?
----আমার নাম জানতে চাইছেন তো?
----আমার মতো ভাগ্যহীনা,হতছাড়া,অপয়ার কেউ মুখ দর্শন করতে চায়না।আপনি আমার নাম জানতে চাইছেন?আমার নাম শুনলে আপনার অমঙ্গল ছাড়া মঙ্গল কিছুই হবে না।তাই দয়া করে এই অসহায় অভাগীনিকে বিব্রত করবেন না দয়া করে।
----ছেলেটি বললেন,এসব কুসংস্কার আমি বিশ্বাস করি না।কেউ কারো ভাগ্য কেড়ে নিতে পারে না।ভাগ্যটা হলো ঐশ্বরিক দান।তাই আপনি অনুগ্রহ করে আপনার নামটা বলুন!
----অভাগীনি বললেন,আপনাকে আমি চিনিনা-জানিনা।আপনাকে কোনদিন দেখেনি।আপনাকে কোন দুঃখে আমার নাম বলতে যাবো!আপনি যখন এতই আগ্রহী আমার পরিচয় জানতে।তাহলে শুনুন.....
----আমার নাম অভাগীনি নিরুপমা।
----ছেলেটি বললেন অভাগীনি বলছেন কেন?
----সে অনেক কথা!আপনার শুনে লাভ নেই।
----আপনাকে তো আমি চিনতে পারলাম না,আপনি কে?
----আপনার বাড়ী কোথায়?কোন গ্রামে?
----প্রত্যুত্তরে,ছেলেটি উত্তর দিলেন আমার নাম রুপম রায় চৌধুরী।আমার বাড়ী সামনে ওই সবুজ ঘেরা মাঠের ওপারে সোনাগাঁ গ্রামে।
----মেয়েটি বললেন,আমার বাড়ী ওই সামনের রুপসা গ্রামে।আপনাকে তো আগে কখনো দেখিনি।
----কাজের সুবাদে বিদেশে কেটে গেছে দীর্ঘঃ দশ বছর।কাজ সমাধান করে সবে মাত্র চারদিন গ্রামে ফিরেছি।ছোটবেলায় যখন দেখা হয়েছিল হয়তো তা আজ স্মৃতির পাতায় অতীত।শুধু নিজের কথা বলছি।আপনার জীবনের কোন কথা শোনা হলো না.....

      অভাগীনি নিরুপমা বললেন,আমার জীবনে দুঃভাগ্যময় ইতিহাস বলে,আপনাকে দুঃখ দিতে চাইনা।আর নিজেও কষ্ট পেতে চাইনা।কষ্টের আঘাতে আঘাতে এই হৃদয় আজ ক্ষত-বিক্ষত।
----আমার জীবনের সমস্ত সুখ-দুঃখ,ব্যথা-বেদনা,বিরহের কাহীনি এই খাতার প্রতি পাতায়,"নক্সী-গাঁথায়"-লিখেছি অশ্রু-জলে।পারলে কোন একদিন তুমি পড়ে নিয়ো।আর আপন বলতে কেউ নেই।পারলে তুমি সবাইকে বলে দিও!আমি মারা যাওয়ার পর যেন বেদনা'সৃক্ত এই ''নক্সী-গাঁথা''-কাব্যের খাতাটা,রুপসার তীরে শ্মশানে বাবা-মায়ের পাশে আমার সমাধীর উপর বিছায়ে দেয়।যখন কেউ এই নদীর তীরে আসবে,এই অভাগীনির বিরহের কথা যানতে পারে।আর অসহায় অভাগীর জন্যে এক বিন্দু অশ্রু ঝরিয়ে,ব্যথিত আত্মাকে সান্ত্বনা দিয়ে যায়।

----অভাগীনি নিরুপমা তাঁর ''নক্সী-গাঁথা''-কাব্যে প্রথম পঙংক্তিতে লিখলেন......

          "এই রুপসা নদীরে আমি বড়ো ভালোবাসি,
          এখানে ঘুমায় আমার বাবা-মা!
          কিছুই মনে পড়ে না......
          তবুও আমার পরাণ যে মানে না।
          আপন হাতে দিয়েছি চিতাতে,
          আমার পালিত বাবা-মার!
          এই দুনিয়া নিয়েছে বারে বারে মুখ ফিরিয়ে,
          দু'চোখেতে নেমেছে অন্ধকার।
          জীবনের গল্প নয় যে অল্প.....
          উন্মুক্ত করলে আকাশ বাতাস ছাইবে বিষাদে!
          ব্যথা-ব্যথি কেউ হলো না আমার,
          অভাগীনি বলে এদুনিয়া নিয়েছে মুখ ফিরিয়ে।

     একথা বলতে বলতে নিরুপমার হৃদয় বক্ষ হতে অশ্রু-ধারাপাত নদীর স্রোতে নীরবে মিশে গেল।গাছের পাতারা ঝরে পড়লো বেদনায় বিষাদে।
----নিরুপমার জীবনের করুন গল্প-কাহিনী ও দু'চোখের অশ্রু দেখে রুপমের দু'চোখের জল বাক মানলোনা।হৃদয় হলো ব্যথায়-ব্যথিত সমব্যথী।

     এভাবে কথা হতে হতে দুজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব-পুর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠলো ক্রমশ।রুপম ও নিরুপমার মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরো গাঢ় হতে থাকলো।একে অপরকে দেখার জন্য দুজনের মন উদগ্রীব হয়ে উঠতো।

     তাহলে কি,অভাগীনি নিরুপমার মরা গাঙে সুখ আসতে চলেছে?প্রেমের বার্তা বহন করে!অভাগীনির রিক্ত'হৃদয় পল্লবে নব-রুপে,নব-নব-ছন্দে ভালোবাসার মুকুল সুগন্ধ বিলাতে ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে লাগলো।নতুন কোন অজানা সুখের অভিলাষে।

     এক সময় নিরুপমালও রুপমের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভালোবাসায় পরিনত হলো।সাক্ষী থাকলো আকাশ,বাতাস,সবুজ মাঠ আর রুপসা নদীর হৃদয় মোহিত করা কুল কুল সুরধ্বনি। প্রকৃতি যেন অপার মহিমায় প্রেম-সুধা ঢেলে দিয়েছে।রুপম ও নিরুপমা দুজনের হৃদয়ের অন্তঃকক্ষে।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.