![]() |
গোবিন্দ ধর- এর কবিতায় প্রকৃতি চেতনা : পম্পা দাস |
“ আপন অন্তরের একনিষ্ঠ খননকর্মী হয়ে কবি গোবিন্দ ধর প্রকাশিতব্য ‘দ্রোহবীজ পুঁতে রাখি’ , একা’ কাব্যগ্রন্থে নিজেকেই যেন বারবার আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। সুখের কথা, আশা ও আশ্বাসের কথা , কবির কবিতা একান্ত ব্যক্তিগত স্তরে আবদ্ব হয়ে থাকেনি। বহু বহু পাঠকের ব্যক্তিগত জীবন দর্শনের সংগে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে এবং এখানেই কবি গোবিন্দ ধর একজন সৎ কবি , প্রকৃত কবি হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ”
-(পীযুষ রাউত)
প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে অনুভব করেননি এমন কবির সংখ্যা বোধ হয় কমই আছেন, কেউ কেউ তো প্রকৃতির মধ্যেই মুক্তি খুঁজে পেয়েছেন । আবার কোনো কোনো কবির কবিতায় প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে । বুদ্বদেব বসু একবার বলেছিলেন যে কোন কবির কবিতা সেইখানেই সবচেয়ে সফল যেখানে কবিতায় প্রকৃতির বর্ণনা রয়েছে । যদিও সকল কবির কবিতায় প্রকৃতি প্রধান বিষয় হয়ে উঠবে এমন কোনো কথা নেই তবে প্রধান বিষয় না হলেও প্রকৃতি ছাড়া কি কোনোও কবিতা পরিপূর্ণ হয় ? প্রকৃতি কবিতার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন আকার ধারণ করে কবির নিজস্ব মানসিকতায়। কখনো কল্পনার মধ্য দিয়ে ও কবিতা আমাদের কাছে সত্যের অনুভূতি দেয়। যেমন আলোকরঞ্জন দাসগুপ্তের একটি কবিতায় মা , প্রিয়া , মানুষ বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে এমন ওতপ্রোত হয়ে ধরা দিয়েছে যে কবি জয় গোস্বামীর কাছে মনে হয়েছে যেন এই মা তারই মা । শুধু জয় গোস্বামী কেন আমাদের মতো সাধারণ পাঠক ও তার সঙ্গে একাত্ম হতে পারি অনায়াসেই।
“ আমি যত গ্রাম দেখি / মনে হয়/ মায়ের শৈশব/ আমি যত গ্রামে যত মুক্তক পাহাড় শ্রেণি দেখি/ মনে হয় প্রিয়ার শৈশব / পাহাড়ের হৃদয়ে যত নীলচে সবুজ ঝরনা দেখি / মনে হয় / দেশে গায়ে ছিল/ কিন্তু ছেড়ে আসা প্রতিটি মানুষ।
একুশ শতকের লেখক গোবিন্দ ধর একদিকে যেমন সম্পাদক, সংগঠক , প্রকাশক, কথাকর্মী সংগীত রচনাকার, নাট্যকার তথা নাট্যশিল্পী অন্যদিকে তিনি মূলত কবি। কবি অশোক দেব গোবিন্দ ধরের লেখনি সম্পর্কে বলেছিলেন-
‘ গোবিন্দ নিম্নস্বরে বলেন চিৎকারের কথা ‘
যদিও কবিকে আমরা এ রূপেই চিনি। ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যে কবি গোবিন্দ ধরের নাম চিরোজ্জ্বল হয়ে থাকবে। ২০০৭-এ ‘কবিতা প্রতিমাসে’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত তার কাব্যগ্রন্থ ‘জলঘর’-এ কবির পরিচিতি সংক্ষেপে দেওয়া হয়েছে এইভাবে-
“কবি গোবিন্দ ধর। দঁক্ষিণারঞ্জন ধর ও ঁসুষমা রানী ধরের পুত্র। জন্ম ৩০ শে জুলাই ১৯৭১ ইং। ধর্মনগরের পদ্মপুর অফিস টিলায় । বড় হয়ে উঠা উত্তর ত্রিপুরার রাতাছড়ায়। বর্তমান ঠিকানা হালাইমুড়া ; জীবনানন্দ লেন, কুমারঘাট উত্তর ত্রিপুরা। পেশায় শিক্ষক । প্রথম কবিতা প্রকাশ ৮ নভেম্বর, ১৯৯১। ‘স্রোতস্বিনী’ নামে সাহিত্যপত্র ও ‘স্রোত’ সাহিত্য পত্রের সম্পাদক । ১৯৯৫ থেকে ‘উদ্দীপ্ত সংগ্রহশালা’ নামে একটি গ্রন্থাগার পরিচালনা করেছেন। নিজস্ব প্রকাশনা ‘স্রোত’ রয়েছে।”
‘জলঘর’(২০০৭) কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা কবিতার জগতে কবির প্রথম আত্মপ্রকাশ । তারপর একে একে ‘সূর্যসেন লেন’ (২০০৭) , ‘মনসুন মাছি’(২০০৭), ‘দ্রোহবীজ পুঁতে রাখি একা’ (২০১১) । এছাড়াও আরোও অনেক কবিতা ও ছড়া সংকলন করেছেন কবি।
গোবিন্দ ধরের কবিতা অনেকটা খোলামেলা । অথচ শব্দ ব্যবহারের অসাধারণ নৈপুণ্যে প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ কে উপমা , প্রতীক ও রুপকের ব্যঞ্জনায় , চিত্রকল্পের অসামান্য পরিবেশনে তিনি প্রকৃত শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন-
‘এত ভুল নিয়ে ফুল ফোটাতে দোল উঠেনা
সব ফুল গোলবাজারে নষ্ট হয়
হৃদয়ে যে জল প্রতিদিন ঢেউ দেয়
প্লাবিত হয়
সে জল হৃদিজল, জল ছলছল।
হৃদয়ে বন্যা ডেকে আনে
বানভাসি হয় এক জলঘর। (হৃদিজল! জল ছলছল)
সংবেদনশীল অনুসন্ধিৎসু মন ধরা পড়ে তার ‘জলবর্ষা’ কবিতায়-
‘প্রতিদিন একটু একটু পুড়ি
প্রতিদিন।
পুব-পশ্চিম ঘুরি।
প্রতিদিন মরূমায়ায় হাঁটি
প্রতিদিন কামড়ে ধরি মাটি। (প্রতিদিন)’
সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে বুকে নিয়ে নিজেকে আবিস্কারের প্রবনতা ধরা পড়েছে ‘সীমান্ত সমস্যা’ কবিতায়। এখানে তিনি অনুভব করেছেন সীমানা বিহীন মুক্ত পথের |
১। ‘ পড়শিরা সীমানা বাড়ান
বিজ্ঞের মতো হাঁটেন
আমি জমিন থেকে
হারাই নিজস্ব অধিকার ।’
২। ‘ জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা বাঘ, বাঘ নয়,
মানুষকে বড় ভয়
তারা জঙ্গলে থাকেনা।’
৩। ‘ ভেতরে ভেতরে বাস্তুসাপ , কামড়ায়
মন মেধা ও সংস্কৃতি
আমি ও ভেতরের আমি লাল সুতোয় আবদ্ধ
সেখানে জিহ্বা বের করে
ফোঁস ফোঁস ভেতরে ভেতরে বাস্তুসাপ
প্রতিদিন কামড়ায় (বাস্তুসাপ)।’
৪। ‘ ... নীড় নেই
বাসায় ফেরা নেই
পরিযায়ীর মত উড়তে উড়তে
একদিন ভিনদেশে চলে যাই। ’
আমাদের পরিচিত বিভিন্ন শব্দকে কবি কবিতায় এমনভাবে ব্যবহার করেন যে পরিচিত শব্দ ও তার নিজস্ব সীমা অতিক্রম করে আমাদের শব্দাতীত জগতে নিয়ে যায় । আর তখনই তা কবিতা হয়ে ওঠে । শব্দের এই সীমানা অতিক্রম করার ক্ষমতাই হল ব্যঞ্জনা । যেমন গোবিন্দ ধরের ‘স্বদেশমালা’ কবিতার এই পঙতি পাঠকের মন ছুঁইয়ে যায়।
‘তোমার কাছে আকাশ ছিলো
পাখি ছিল
উড়তে দিলে কই?
তোমার কাছে সব থেকেও রিক্ত আমি
জলের মাঝে জল কষ্ট সই।’(স্বদেশমালা)
এখানে ‘পাখি’ তার সাধারণ অর্থের সীমা অতিক্রম করে পৌছতে চেয়েছে অন্য এক প্রতীকে বা দ্যোতিতে। এখানে ‘পাখি’ হয়ে উঠেছে স্মৃতির চিহ্নায়ক বা প্রতীক। কবিতা শব্দতীর রহস্যময়তায় পৌঁছানোর জন্য আশ্রয় নেয় বিভিন্ন ইঙ্গিতের, ব্যঞ্জনায়, প্রতীক ও চিত্রকল্পের।
গোবিন্দ ধরের কবিতায় আমরা ফিরে পেলাম প্রকৃতির প্রতি তীব্র ভালোবাসা ও এক মরমী টান ও তার কাছে ফিরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা। প্রকৃতির প্রতি এই টান ও আত্মনিবেশী মনন কাজ করেছে সময় ও সমাজের গ্লানি, বৈকল্য, নাগরিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা,দহন, অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ হিসেবে। প্রকৃতির সঙ্গে তিনি মিশে যেতে চেয়েছেন-
‘দূর থেকে ভেসে আসে বাউলের তান
টগর মালতী গন্ধ বাতাসে ভাসমান,
কোকিলের দরবারী মৌতাত প্রকাশের ভাষাহীন
গ্রাম ছাড়া আর কোথা আছে প্রাণ?
তার কবিতায় প্রকৃতি যেন এক প্রেরণার মতো কাজ করেছে। যেখানে মানব চেতনার সঙ্গে প্রকৃতিকে বিচ্ছিন্ন করা যায়না। মানুষ ও প্রকৃতির এক নিবিড় মহাবস্থান রয়েছে তার কবিতায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি মানব বিচ্ছিন্ন প্রকৃতির মধ্যেও শান্তি খুজেঁ পাননি –
‘দিনে দিনে প্রতিদিন বিশ্বাস ভেঙে যায়
যদি বলি পাপ এসব মিথ্যা আস্ফালন,
আমাদের বৈরাগ্য হয়, চেতনার সন্নাস হয় (লিপিসংকেত) ।
শেষ পর্যন্ত এই একাকীত্ব ও দোলাচলতাকে তিনি বরণ করেন-
১। ‘ভেতরে ভেতরে নিক্কনের শব্দ বাজে
বাইরে আমি একা
সমস্ত দ্রোহবীজ পুঁতে রাখি একা, একা’
(দ্রোহবীজ পুঁতে রাখি একা)
২। ‘পথে নামি, পথ হারিয়ে যায়
প্রদর্শক পথ বাতলে দাও
আবহমান পথিক থাকি।(পথিক)’
গোবিন্দ ধরের কবিতায় তাই ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে, কাল থেকে কালোত্তরে, দেশ থেকে দেশোত্তরে মুক্তি প্রধান প্রসঙ্গ। তার কবিতায় দেখি খন্ড কালকে তিনি দাঁড় করিয়ে দেন অখন্ড কালের মাঝে। ফলে গোবিন্দ ধর সমস্ত ধরনের আত্মদংশন, আত্মসমালোচনা, আত্মবঞ্চনাকে উপেক্ষা করে আত্মবিস্তারের পথে নিজেকে চালিত করেছেন-
১। ‘আপনি মায়ামৃগ
ছুট ছুট
পিছে আছি- রামচন্দ্র
মায়া দেখব।’
২। ‘যতদিন উত্তরমুখো
না হবো
পদ্মপায়ে ফুটে থাকবে
হৃদয়ফুল।’
আর গোবিন্দ ধরের কবিতা এখানেই পেয়েছে সার্থকতা।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন