বারট্রোল্ট ব্রেখট (১৮৯৮-১৯৫৬) : লিখেছেন, মৃদুল শ্রীমানী


বারট্রোল্ট ব্রেখট (১৮৯৮-১৯৫৬) 
জন্মদিনে স্মরণলেখ।
 
লিখেছেন, মৃদুল শ্রীমানী।

তিনি শিল্পী। তিনি কবি। তিনি নাট‍্যকার। তবুও তিনি বললেন, আর্ট বা শিল্পকলা জিনিসটা নিছক বাস্তবকে তুলে ধরার দর্পণটুকু নয়। ও হল হাতুড়ি। ওর ঘা মেরে বাস্তবকে পিটিয়ে নতুন চেহারা দিতে হবে। বললেন, ভুখা মানুষ, ধরো বই, ওটা হাতিয়ার। প্রশ্ন তোলেন, অন্ধকার নেমে এলেও কি গান টিঁকবে? নিজেই উত্তর যোগান, হ‍্যাঁ, তখনও নিশ্চয় গান থাকবে, অন্ধদিনে আমরা গাইব আঁধার দিনের গান। ওই যে তিনি ক্ষুধার্ত মানুষকে বই হাতে নিয়ে, তাকে হাতিয়ার করে তোলার প‍রামর্শ দিলেন, ওই ধরনের কথাই যেন নানা জায়গায় নানাভাবে বলে চলেছেন। "যে শ্রমিক পড়তে জানে, তার তোলা প্রশ্ন" কবিতায় তিনি ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন খুঁচিয়ে তোলেন। বলেন, বলতে পার, থিবসের সাতটি তোরণ কারা বানিয়েছিল? বইপত্র ঘাঁটলে সেখানে শুধুই রাজা রাজড়ার নাম। আরে ওইসব বিশাল পাথরগুলো কি রাজাগজারা ঠেলে তুলেছিল? ব‍্যাবিলনের কথা উঠলে মনে পড়ে, কতবার শহরটা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বলো তো, কাদের মেহনতে বারবার ব‍্যাবিলন আবার আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে? সোনা ঝকঝক লিমা শহরের মিস্ত্রি মজুররা কেমন বাড়িতে থাকত? বলতে পার, যেদিন চীনের প্রাচীরের শেষ ইটটি গাঁথা হল, তারপর দেয়াল গড়তে থাকা মজুররা রাতের আঁধারে কোথায় হারিয়ে গেল?

তরুণ বীর আলেকজান্ডার ভারতকে জিতে নিয়েছিলেন। তোমরা কি ভাবো একাটি তিনি জয় হাসিল করেছিলেন? সিজার গলদের পদানত করেছিলেন। আচ্ছা, ওঁর সাথে কি রসুইখানার এক আধটা পাচকও ছিল না? ইতিহাসের পাতায় পাতায় যুদ্ধজয়ের গল্প। যারা যুদ্ধে জিতত, তাদের ভোজসভার খাবার বানাত কারা? দশকে দশকে এক একজন মহামানব। কাদের ঘাম ঝরানো পয়সায় তাঁরা গড়ে ওঠেন? অনেক অনেক খবর। আর অনেক অনেক প্রশ্ন।

আমরা বারটোল্ট ব্রেখটকে তাঁর জন্মদিনে স্মরণ করছি। নাটক লিখেই তিনি বিখ‍্যাত। তবু কবিতা ও প্রবন্ধেও তিনি অসামান্য। আমি ব্রেখটের রাজনৈতিক বক্তব্যের দিকে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে তাকাই। ব্রেখট, জার্মান লোকটা, বলেন, মৃত্যু নিয়ে অতো আহা উহু কোরো না, বরং ভাবো, জীবন এত ছোট কেনে? পরিবর্তনের গূঢ় গুহ‍্য সত‍্যকে লক্ষ্য করে ব্রেখট বলেন, আজ যে সব জিনিস আমাদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে, ওগুলো ওইভাবে আছে বলেই, ওগুলো চিরদিন টিঁকবে না। ব্রেখট একই সাথে চার্লি চ‍্যাপলিন আর কার্ল মার্কসের চিন্তায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। ওই কারণে তাঁর লেখায় অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ আর গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মেলবন্ধন ঘটেছে। বিজ্ঞান কেন, বিজ্ঞানের লক্ষ্য কি, এই প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, অসীম প্রজ্ঞার দ্বারোদ্ঘাটন করাটা আদৌ বিজ্ঞানের লক্ষ্য নয়। বিজ্ঞানের লক্ষ্য হল, আমাদের মধ‍্যে যে অসীম ত্রুটি বিচ‍্যুতি ভুলভ্রান্তি আছে, তাতে একটু লাগাম পরানো। তাঁর লাইফ অফ গ‍্যালিলিও নাটকে একথা তিনি বললেন। ১৯৪৩ সালে লেখা এই নাটক। তখন ব্রেখট পঁয়তাল্লিশ বছরের জ্ঞানতাপস। গভীর মন্ময়তায় মহাবিজ্ঞানী গ‍্যালিলিওর জীবন সন্দর্শন করেছেন। তাঁর প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রের আক্রমণটা খুঁটিয়ে দেখছেন। আর ঐতিহাসিক ঘটনার পরতে পরতে বুনে নিচ্ছেন সমকালীন যন্ত্রণার ছবিটি। ওই গ‍্যালিলিও নাটকে আরো বলছেন, সেই দেশ বড়ই দুঃখী, যাদের বীর খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়। মহৎ সত‍্যদ্রষ্টা গ‍্যালিলিওকে স্মরণ করতে করতে ব্রেখট ওই নাটকে বলছেন, আজকের দিনে যিনি মিথ‍্যার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইবেন, অজ্ঞতার বিপ্রতীপে তরবারি ধরবেন, যিনি নিজের কলমে সত‍্যপ্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন, তাঁকে অন্ততপক্ষে পাঁচটি বাধা জয় করতে হবে।

প্রথমতঃ, যে সময় সব জায়গায় সত‍্যকে বিরুদ্ধতার মুখে পড়তে হচ্ছে, সেই সময় তাঁকে নিজের কলমে সত‍্য লিখতে হবে। যে সময়ে সত‍্যকে ঢেকে চেপে রাখতে সবাই ব‍্যস্ত, সেইরকম সময়ে  সত‍্যকে খুঁজে বের করতে তাঁর অকুণ্ঠ আগ্রহ থাকতে হবে। সত‍্যকে একটা হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলবার এলেম তাঁর থাকতে হবে, আর কাদের হাতে সত‍্য পৌঁছে দিতে পারলে তা সবচাইতে কার্যকর হবে, এটা বোঝার মতো বিচারবোধ তাঁর থাকতে হবে। আর সেই সব মানুষের কাছে সত‍্যের আলো পৌঁছে দিতে গিয়ে তাঁকে দৌড়ে বেড়াতে হবে।

রাজনৈতিক বোধই ব্রেখট এর সাহিত্যবোধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নিজের রাজনৈতিক বোধকে তিনি ঢেকে চেপে রাখা নিতান্তই অপদার্থতা বলেই মনে করেন। বলেন, যারা রাজনৈতিক বিষয়ে মূর্খ, তাদের মতো মূর্খ আর কেউ নেই। ওই মহামূর্খগুলো কিছু কানে নেবে না, কথাটি বলবে না, রাজনৈতিক ঘটনায় অংশগ্রহণ করবে না। ওরা জানে না, কত কষ্টে জীবন পরিচালনা করতে হয়। এই মূর্খেরা জানেই না সবজির দাম কত, মাছের দাম কি,  আটা ময়দার দাম কি যাচ্ছে, বাড়িভাড়ার হার এখন কেমন, জুতোর দাম কি, আর ওষুধপত্রের খরচ খরচা কি, এগুলো আসলে রাজনৈতিক মহলের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। রাজনৈতিক বিষয়ে মূর্খরা এতটাই মাথামোটা যে তারা বুক চাপড়ে গর্বের সঙ্গে বলবে, তারা নাকি রাজনীতিকে ঘৃণা করে। গণ্ডমূর্খগুলো জানেই না যে, ওর ওই রাজনৈতিক অজ্ঞতার ফাঁকফোকর গলে বেশ‍্যারা পয়দা হয়, বাচ্চারা পরিত্যক্ত  অনাথ হয়ে বেড়ে ওঠে, আর নোংরা রাজনীতিকরা, যাদের মতো চোর আর হয় না, সেইগুলো গজিয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অজ্ঞতার সুযোগেই জাতীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির জঘন‍্য দুর্নীতিবাজগুলোও এথেকেই পুষ্টি পায়।

দশ ফেব্রুয়ারি ব্রেখট এর জন্মদিন। ১৮৯৮ তে জন্মেছিলেন। মৃত্যু ১৯৫৬ সালের ১৪ আগস্ট। আজকের দিনেও ব্রেখট এর চিন্তা আমাদের নতুন নতুন পথে বিকশিত হতে সাহায্য করতে পারে।


Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.