শামসুর রাহমান ও আমি : রুদ্রসাগর কুন্ডু

শামসুর রাহমান ও আমি : রুদ্রসাগর কুন্ডু
শামসুর রাহমান ও আমি : রুদ্রসাগর কুন্ডু

বাংলাদেশের প্রধান কবিদের সারিতে প্রধান কবি ছিলেন শামসুর রাহমান। শামসুর রহমানের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টবরে, বুধবার সকাল ১০ টায়। আমার জন্ম ২৩ জুন ১৯৭৮ সালে। প্রায় অর্ধ শতবছরের ব্যবধান আমার সঙ্গে আমার অনুকরণীয় কবির। তিনিই আমার স্বপ্ন-চেতনা-বাস্তব। তাঁর আদর্শ আর ব্যক্তিত্ব আমাকে মোহিত করেছিল আমার জীবনের শুরুতে। অত্যন্ত ছোটবেলা থেকেই তাঁর জীবনের খুঁটিনাটি সবকিছু জানার আগ্রহ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিলো এক মানবিক আত্মম্ভরিতায়। কেমন ছিলেন তিনি, কেমন ছিল তাঁর জীবন ও পেশা, ব্যক্তিত্ব! আসুন, আমার অনুভবের কিছু কথা শেয়ার করি পাঠকের সঙ্গে। 

সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে উঠে সাহিত্য নির্মাণের একাগ্রতায় উনি ছিলেন অন্যতম মুখ। নিজেকে মুখোশের আড়ালে ঢাকতে পছন্দ করতেন না। অকপটে সত্যকে সত্য বলার ক্ষমতা ছিল উনার প্রধান হাতিয়ার। ঢাকার জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়েও নাগরিক ভোগবিলাসিতা থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন আজন্ম। অজস্র লিখেছেন। লেখায় ছিল তার একমাত্র কাজ। আমি ছোটবেলা থেকে উনার মতো একজন বড়ো কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। পূর্ববঙ্গের সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন অসাম্প্রদায়িক লেখক তথা ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব আমার খুব ভালো লাগতো। কেননা, বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট বা বলা চলে একটি মুসলিম প্রজাতান্ত্রিক দেশ।  এবং  এই দেশে প্রত্যেকটি অসাম্প্রদায়িক বড়ো মানুষই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য পরম বন্ধু স্বরূপ। ছোটবেলা থেকে আমিও অসাম্প্রদায়িকতার অভ্যস্ত হয়ে পড়ি কমিউনিস্ট নেতা সন্তোষ ব্যানার্জী ও সাইদুর রহমান নামের দুজন কমরেডের সংস্পর্শে এসে। ফলে, শামসুর রহমানের প্রতি চরমভাবে আবেগঘন দুর্বলতা অনুভব করতাম। উনার নতুন কোনো বই প্রকাশিত হলেই সংগ্রহ করতাম। একাধিকবার পাঠের মাধ্যমে হৃদয়ঙ্গম করার প্রয়াসে মগ্ন হয়ে থাকতাম দিনের পর দিন।

১৯৯৪ সালে মাধ্যমিক পাশ করি।  স্কুলের পাশেই ছিল জেলা গ্রন্থাগার। ছাত্র বয়সের অবসর সময়জুড়ে সেই গ্রন্থাগারের হাজার হাজার বইয়ের মাঝে খুঁজে বের করতাম শামসুর রহমানের কবিতার বই। সেই সূত্র ধরে পরবর্তী সময়ে কবি হওয়ার বাসনায় পুরো সাহিত্য জগতের চক্রব্যূহে আজও ঘুরছি। ১৯৯৫ সালের শুরুতে একটি কবিতার কাগজ বের করতে শুরু করেছিলাম। সেই কাগজে যারা লেখালেখি করতে শুরু করে পরিণতিতে এসেছিলো, ঢাকাতে আজ তারা নামজাদা কবি হিসেবে পরিচিত। সেই সময়টাতে নাস্তিকতার ওপর ভোর করে জীবনযাপনের এক আধুনিক অভ্যাস গড়ে উঠেছিল আমার জীবনে। কমিউনিস্ট মতাদর্শে আত্মনিবেদন, কবিতার মধ্যে ডুবে থাকা, আর ধর্মের কু -প্রভাবের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী সুলভ আদবকায়দা-- এই সব প্রভাবের মুলে ছিলেন কবি শামসুর রহমান। সমসাময়িক কবিদের কবিতাও পড়তাম তখন। লাইব্রেরি জীবনের সময়গুলোতে কবি সুবল বিশ্বাস, রাজনীতিবিদ রতন দাস, ও লিগ্যাল এইড এসোসিয়েশনের লাইব্রেরিয়ান মঞ্জুরুল প্রমুখ ব্যক্তিদের কাছে আমি বিশেষ ভাবে ঋণী। 

আমার লেখালেখির সময়ে কবি জাহিদ সোহাগ ছিল ছায়াসঙ্গী। মুসলিম রক্ষনশীল পরিবারের সন্তান হিসেবে মানসিক জড়তা ও কুসংস্কার ওকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। মুক্তচিন্তার এই কিশোর প্রথম পরিচয়ে আমার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল। ওরও পছন্দের তালিকায় ছিলেন শামসুর রহমান। জাহিদ সোহাগ বর্তমান সময়ে ঢাকাতে কবি হিসেবে অনেক বড়ো নাম করেছে। কিন্তু আগের মতোই আমার আদর্শের অনুকরণ বজায় রেখেছে কিনা, তা আমার জানা নেই।  তবে শামসুর রাহমান চর্চায় ও-আমার বিশেষ এক সঙ্গী ছিল। ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্তকে বাদ দিলে শামসুর রহমান, নির্মলেন্দু গুন, রফিক আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিল আমাদের পরিচিত কবিদের নাম। কবিদের পাশাপাশি তখন আমার আর একজন প্রিয়মানুষ ছিলেন, তিনি "চে গুয়েভারা''। তাঁর একটি সাদাকালো ফটো যত্নে বাঁধানো ছিল আমার পড়ার ঘরে। আর এই ঘরেই গড়ে উঠেছিল আমার শৈশব, যৌবন। আমার আগামী জীবনের ভবিতব্য। 

বাংলা কবিতার জগত মূলত তিনভাগে বিভক্ত রয়েছে। ঢাকা, কলকাতা, আগরতলা। অর্থাৎ, বাংলাসাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে এই তিনটি অঞ্চল ভীষণ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হতো আমাদের সময়ে। এখনো একই রকম পরিলক্ষিত হয়। কলকাতার কবি হিসেবে তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার পছন্দের কবি। আর ত্রিপুরার কবিতা ও সাহিত্য সম্পর্কে তখন আমার কোনো চর্চা ছিল না। সুতরাং বাংলা কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে কলকাতা ও ঢাকা  অর্থাৎ এই দুই বাংলার কবিতায় ছিল চর্চার প্রধান লক্ষ্য। সুনীলের প্রেমের কবিতা তখন মুগ্ধ করে রাখতো।  তেমনি ভাবেই শামসুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কবিতা ও স্বাধীনতার পক্ষে লেখা কবিতাগুলি হৃদয়কে নাড়িয়ে দিত। তখন একটু আধটু করে জয় গোস্বামী ও রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা পড়তে শুরু করেছি। সঙ্গে খানিকটা নির্মলেন্দু গুণ। মাঝে মাঝে হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলের পাতা ওল্টাতাম আর এমন একটি বই প্রকাশের স্বপ্নে মশগুল থাকতাম।


 




 ( লেখাটা সমাপ্ত হয়নি )

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.