মেঘনাদ সাহা, মানবপ্রেমিক এক বিজ্ঞানসাধক : মৃদুল শ্রীমানী


মেঘনাদ সাহা, মানবপ্রেমিক এক বিজ্ঞানসাধক

 

মৃদুল শ্রীমানী

মেঘনাদ সাহা (০৬.১০.১৮৯৩ - ১৬.০২.১৯৫৬) ছিলেন এক আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী। জ‍্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানের জগতে একটি স্মরণীয় ব‍্যক্তিত্ব। তাঁর থার্মাল আয়োনাইজেশন পদ্ধতি অবলম্বন করে নক্ষত্রগুলির বর্ণালি বিশ্লেষণ করে তাদের তাপমাত্রা এবং তাদের ভিতর কোন্ মৌলিক পদার্থ কিভাবে আছে জানার সুযোগ হয়েছে।

এই মহান বিজ্ঞানসাধক এদেশের বুকে অ্যাকাডেমিক বিজ্ঞানচর্চার বিকাশ ও বিস্তার ঘটানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩০ সালে তিনি গড়ে তোলেন ন‍্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স, ১৯৩৪ সালে ইণ্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ১৯৩৫ সালে ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স। ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ‍্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠানে ১৯৫৩ থেকে আমৃত্যু তিনি ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন করেন।

দেশের সরকার কিন্তু অনেক সময় মেঘনাদের মত মেনে নেন নি। উপেক্ষা করেছেন। তাই স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে গিয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরার প্রয়োজন অনুভব করেন। জাঁদরেল কংগ্রেস প্রার্থী প্রভুদয়াল হিম্মৎসিংকার বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রী ও প্রগতিশীল ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রার্থী হয়ে তিনি নির্বাচনে লড়াই করে জেতেন। মার্জিন ছিল ষোলো শতাংশ। এই নির্বাচন লড়তে নিজের বই ট্রিটিজ় অন হিট এর প্রকাশকের থেকে বই বিক্রি বাবদে ৫০০০ টাকা চেয়ে নিয়েছিলেন।

গ্রামবাংলার দরিদ্র ও অভাবী ঘরের সন্তান ছিলেন মেঘনাদ। শুধু মেধা ও কঠোর পরিশ্রম নয়, সুতীব্র জেদ থেকে তাঁর গড়ে ওঠা।  গজদন্ত মিনার থেকে তিনি পৃথিবীকে দেখেননি। দেখেছেন কায়িক শ্রমে ও নানাবিধ দুর্বিপাকে।

তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি। ঢাকা কলেজ তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পরিচালনা করতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। ১৯১১ সালে সসম্মানে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে আসেন তিনি। সতীর্থ হিসেবে পেয়েছেন সত‍্যেন্দ্রনাথ বসুকে। আর এক ক্লাস উঁচুতে পড়তেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ।

রসায়ন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে মেঘনাদ পেয়েছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে। আর পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। ১৯১৩ সালে সাহা গণিত বিভাগে অনার্স সহ বিএসসি পাশ করেন, আর ১৯১৫ সালে অ্যাপ্লায়েড ম‍্যাথামেটিক‍্স নিয়ে এমএসসি পাশ করেন। দুটি পরীক্ষা তেই তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। দুটিতেই প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন তাঁর সতীর্থ সত‍্যেন্দ্রনাথ বসু।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনা হয়েছিল ১৯১৪ সালের ২৭ মার্চ তারিখে। আলোচ‍্য সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন স‍্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি দুই বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। প্রথমে ১৯০৬ - ১৯১৪ সময়কালে, আর পরে একবার ১৯২১ - ১৯২৩ এই সময়কালে। তো মেঘনাদ সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লায়েড ম‍্যাথেমেটিক‍্স বিভাগের  অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ১৯১৬ সালে। এই সময়ে স‍্যার আশুতোষ কলকাতা উপাচার্য পদে বৃত ছিলেন না। গণিতের অধ‍্যাপক হিসেবে কাজে যোগ দিলেও মেঘনাদ সাহা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ‍্যাপক হিসেবে কাজ করতে চেয়ে আবেদন করেন। তাঁর সতীর্থ সত‍্যেন্দ্রনাথ বসুও তাই করেছিলেন। এর এক বৎসর পরে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত অধ‍্যাপক পদে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করে সাহা স্নাতকোত্তর স্তরে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। তিনি হাইড্রো স্ট‍্যাটিসটিকস, পৃথিবীর গঠন, স্পেকট্রোস্কপি এবং থার্মোডিনামিক্স, এই ধরণের বিষয়ে শিক্ষা দিতেন।

আমরা লক্ষ্য করেছি সাহা নিজে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন অ্যাপ্লায়েড ম‍্যাথেমেটিক‍্স বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পান ওই প্রায়োগিক গণিত বিষয়ে। আণ্ডার গ্রাজুয়েট স্তরে ফিজিক্স নিয়ে তাঁর পড়াশুনা করা ছিল। সেই পুঁজি নিয়েই নিজেকে পদার্থবিজ্ঞানে গড়ে তুলতে তুলতেই তিনি ছাত্রদেরও গড়ে তুলতে লাগলেন‌। পদার্থবিজ্ঞানে পাঠ দেবার পাশাপাশি সাহা ওই বিষয়ে গবেষণাও শুরু করলেন। এইসব সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা নিরীক্ষা করবার মতো উপযুক্ত কোনো গবেষণাগার ছিল না। তবে প্রেসিডেন্সি কলেজের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারটি ব‍্যবহার করার সুযোগ তাঁর ছিল। সাহা তাঁর গবেষণায় কোনো তত্ত্বাবধায়ক গাইড হিসেবে কাউকে পাননি। একান্ত নিজস্ব ব্যক্তিগত উদ‍্যোগে উদ‍্যমে তিনি নিজের গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন।

মেঘনাদ সাহা যে বইগুলি লিখেছিলেন: ১৯২০ তে সতীর্থ সত‍্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে একযোগে আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি সংক্রান্ত গবেষণা পত্রের অনুবাদ। ১৯৩১ সালে বি এন শ্রীবাস্তবের সাথে একযোগে ট্রিটিজ় অন হিট। ১৯৩৪ সালে এন কে সাহার সঙ্গে একযোগে ট্রিটিজ় অন মডার্ন ফিজিক্স। ১৯৪৭ সালে মাই একসপিরিয়েন্স ইন সোভিয়েত রাশিয়া।

ভারতীয় উপমহাদেশের বহু নদীতেই বছর বছর ভয়াবহ বিধ্বংসী বন‍্যা দেখা দিত। ১৯২৩ সালে প্রলয়ঙ্করী বন‍্যায় উত্তরবঙ্গ বিপর্যস্ত হলে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় উত্তরবঙ্গ ত্রাণ কমিটি গড়ে সেবাকার্য শুরু করেন। আচার্য রায়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের আপামর জনতার দানে বিপুল অঙ্কের ত্রাণ সংগৃহীত হয়। এই কাজে সুভাষচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা ও সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত আচার্যের অনুগামী ছিলেন। সংগৃহীত ত্রাণ বিতরণ কাজ পরিচালনা করতে গিয়ে মেঘনাদ সাহা স্বচক্ষে বন‍্যার বিধ্বংসী ক্ষমতা ও তার করালগ্রাস লক্ষ্য করলেন। বন‍্যার করালগ্রাস বিষয়ে স্বচক্ষে দেখা অভিজ্ঞতা নিয়ে সংবাদপত্রে ও নানা পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে কলম ধরলেন মেঘনাদ।


 ১৯৩৪ সালে মুম্বাইয়ে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতির অভিভাষণে তিনি বন‍্যাদুর্গত এলাকার সমস্যা বিষয়ে সভার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। নদী নিয়ে যে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন, এর সপক্ষে তিনি জোরদার সওয়াল করলেন। ১৯৩৮ সালে আয়োজিত ন‍্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এর সভায় সভাপতি হিসেবে তিনি বিশেষ করে বদ্বীপ এলাকায় বছর বছর বন‍্যার প্রাদুর্ভাব ও প্রকোপ নিয়ে বলেন। ১৯৪৩ সালে এক বিধ্বংসী বন‍্যায় কলকাতা এলাকাটি সারাদেশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মেঘনাদ সাহা এই সময়েও কাগজে কাগজে যেখানেই পারলেন জনসচেতনতা ও জনদাবী গড়ে তুলতে লিখে চললেন।  বিভিন্ন সভায় তিনি এই বিষয়ে আলোচনা করতেন। তাঁর বিপুল পরিমাণ লেখা ও আলোচনার অভিঘাতে বন‍্যাদুর্গত মানুষের কষ্ট বিষয়ে সরকার আর চুপ করে কালক্ষেপণ করে যেতে পারল না। ১৯৪৩ সালে বর্ধমানের মহারাজাকে সভাপতি করে দামোদর উপত্যকা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হল। মেঘনাদ সাহা হলেন ওই কমিটির অন‍্যতম সদস‍্য।

যুদ্ধ ও আস্ফালন নয়, প্রতিবেশী দেশের প্রতি চোখরাঙানি নয়, পারমাণবিক শক্তির প্রয়োগ হোক শান্তিপূর্ণ উপায়ে। বিজ্ঞানসাধক  মেঘনাদ সাহা প্রবলভাবে এটাই চাইতেন। ১৯৫৪ সালের ১০ নভেম্বর তারিখে এই বিষয়ে তিনি ভারতের পার্লিয়ামেন্টে বিতর্ক উত্থাপন করেন। ভারতে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন তৈরি হোক, মেঘনাদ সাহা প্রকাশ‍্য ভাবেই এই উদগ্র উদ‍্যোগের বিরোধী ছিলেন।

মেঘনাদের মত ছিল স্পষ্ট এবং সোজাসুজি। তিনি চাইতেন পারমাণবিক গবেষণা হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। এমনকি তিনি চাইতেন ভারতীয় পারমাণবিক শক্তি আইনটিই বাতিল করে দেওয়া হোক। মেঘনাদ চাইতেন পারমাণবিক শক্তি পরীক্ষার কর্মসূচি গ্রহণ করার প্রাক্ শর্ত হিসেবে সরকার প্রথমে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তুলুক। উপযুক্ত দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীবাহিনী গড়ে উঠুক। তারপর এ ধরনের কাজে হাত দেওয়া হোক। কিন্তু ভারত সরকার ও প্রশাসন মেঘনাদ সাহার মতকে গ্রাহ‍্য না করে, তাঁর স্পষ্ট বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে ১৯৪৮ সালে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন তৈরি করে ফেললেন। বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার সভাপতিত্বে কমিশনটির প্রতিষ্ঠা ও সূচনা হল।

মেঘনাদ সাহা (০৬.১০.১৮৯৩ - ১৬.০২.১৯৫৬) দেশকে ভালবাসতেন। কিন্তু দেশ বলতে তিনি বুঝতেন দেশের অতি সাধারণ মানুষদের, আর তাদের জীবনযাপনের মানোন্নয়নকে তিনি দেশের কাজ বলে বুঝতেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সংস্পর্শে তাঁর ভিতর এক সুগভীর মানবপ্রেমিক মাথা তুলেছিলেন। এই ফেব্রুয়ারিতেই তাঁর প্রয়াণ। যে সমস্ত বিজ্ঞান কর্মী গজদন্ত মিনারে বসে নিরাপদ দূরত্বে বিজ্ঞানচর্চা না করে বাস্তবের মাঠে নামতে ভয় পাবেন না, তাঁরা  এই ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে স্মরণ করুন।


 

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.