কখন যে অখ্যাত-কুখ্যাত হলাম, টের পাইনি : তসলিমা

তসলিমা নাসরিন   
কখন যে অখ্যাত-কুখ্যাত হলাম, টের পাইনি

তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত একজন নারীবাদী লেখিকা। ১৯৬২ সালের ২৫ আগস্ট ময়মনসিংহ শহরে এই লেখিকার জন্ম হয়। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তসলিমা তৃতীয়। বাবা, রজব আলী পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন। মা, ঈদুলওয়ারা ছিলেন সাধারণ গৃহিনী। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেনসিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন তসলিমা নাসরিন। ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৮৪ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাশ করেন। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সরকারি গ্রামীণ হাসপাতালে চাকরি করেছেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সল্ পর্যন্ত ঢাকা মিডফোর্ড হাসপাকালে স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

বিংশ শতাব্দীর আশীর দশকে একজন উদীয়মান কবি  হিসেবে (প্রয়াত কবি ও তসলিমার প্রথম স্বামী রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর হাত ধরে) সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। নারীবাদ ও ধর্মীয় সমালোচনা বিষয়ক বিতর্কিত লেখালেখির কারণে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি, লিঙ্গবৈষম্য, ও কোরান সংশোধনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে লেখালেখি করে বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীদের রোষানলে পড়েন। ১৯৯০ সালে তাঁর  এই বিতর্কিত লেখা প্রকাশের জন্য মৌলবাদীরা খবরের কাগজ নামক পত্রিকা অফিস ভাঙচুর করেন। ১৯৯২ সালের ভারতীয় বাবরি মসজিদ ভাঙা হলে বাংলাদেশে ব্যাপকহারে হিন্দু নির্যাতন বেড়ে যায়। হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া, লুটপাট করা, মেয়ে বৌদের ধর্ষণ করে আবাদে চলতে থাকলে, তসলিমা লিখে ফেলেন লজ্জা উপন্যাস, যা ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে তিনি একজন হিন্দু ছেলে সুরঞ্জন কর্তৃক একটি মুসলিম মেয়েকে টাকার বিনিময়ে সঙ্গম করাকে মুসলিমের বিরুদ্ধে হিন্দুর প্রতিশোধ হিসেবে বর্ণনা করেন। ফলে, বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় আন্দোলন শুরু হযে যায়। উপন্যাসটি বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।  

আন্দোলন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ায় ১৯৯৪ সালে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত উনি একজন নির্বাসিত বাঙালি লেখিকা হিসেবে পরিচিত। নির্বাসিত হওয়ার পর ভারত হয়ে তসলিমা প্রথমে সুইডেনে ও পরে জার্মানিতে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বসবাস করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি সুইডেনের নাগরিকত্ব লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি আমেরিকায় বসবাস করেন। এই সময় লেখিকার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন বাংলাদেশে। এই সময় মাকে দেখতে বাংলাদেশ প্রবেশের অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হন। এবং সুইডেন হয়ে বিনানুমতিতে বাংলাদেশ প্রবেশ করেন। বাংলাদেশ সরকার সে কারণে তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে পুনরায় দেশ ত্যাগ করেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্স-এ বসবাস করেন।

এরপর বিভিন্ন সময়ে তিনি ভারতে ও অন্যান্য দেশে বসবাস করেন।বর্তমানে ভারত সরকারের নজরবন্দি আইনে তসলিমা অজ্ঞাতবাস হিসেবে অবস্থান করে আছেন। বর্তমানে তাঁর বয়স প্রায় ৫৮ বছর। এইসময় তিনি ফেসবুকে নিজস্ব অনুভূতির কথা প্রকাশ করেছেন। তা নিম্নরূপ। 

`একটা সময় আমি খুব বিখ্যাত ছিলাম। দেশে বিদেশে সর্বত্র। তারপর ধীরে ধীরে কখন যে অখ্যাত আর কুখ্যাত হয়ে গেলাম, টের পাইনি। যদিও আমার নীতি আর আদর্শের একচুলও বদল হয়নি। যে আমি সেই আমি আছি। সরল, সহজ, সৎ, সংবেদনশীল। তবে বিখ্যাত থাকার সময়ে আমি যতটুকু ভালোছিলাম, তার চেয়ে শতগুণ ভালো আমি অখ্যাত আর কুখ্যাত যখন, তখন।’ 

‘দিন দিন আমার ভালোত্ব বাড়ছে, সহনশীলতা, ক্ষমাশীলতা, দয়াশীলতা বাড়ছে, আর আমি কুখ্যাত হচ্ছি। অপরিচিত, অল্প পরিচিত সকলের মধ্যে আমাকে নিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প চলে। গল্পগুলোর দুটো একটা কানে এলে আমি আকাশ থেকে পড়ি।' এখন আর অখ্যাত, কুখ্যাত কিনা আমি, লোকে আমার জন্য উন্মাদ কিনা, আমাকে ভুলে গেলো কি না, আমার বই পড়া বন্ধ করে দিয়েছে কি না, আমার বদনাম করে বেড়ায় কি না, আমাকে খিস্তি করে কি না, এসব নিয়ে ভাবতে চাই না। না পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ নেই। এক জীবনে যা পেয়েছি, তা যথেষ্টরও বেশি।এখনো পথে ঘটে অচেনা অজ্ঞাত মানুষেরা কাছে এসে `ভালোবাসি' বলে, এই ছোট্র পাওয়ার কাছে আমার `না-পাওয়ার পাহাড়' অতি ক্ষুদ্র।'  

 লেখিকার নিজের দাবি মতো, উনি ১৩ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেন। এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত সেঁজুতি নাম একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন। এই সময়ে ১৯৮২ সালে ভালোবেসে গোপনে বিয়ে করেন প্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে। ৪ বছর সংসার জীবন শেষে ১৯৮৬ সালে দুজনের সম্মতিতে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। একই বছরে ১৯৮৬ খ্রীষ্টাব্দে `শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা' নামক একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এভাবেই শুরু হয় লেখিকার প্রথম লেখালেখির জীবন। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খানের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরী করেন। মাত্র ১ বছরের মাথায় বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তৃতীয়বার বিবাহ করেন সাংবাদিক মিনার মাহমুদকে। এখানে ১ বছরের বেশি বৈবাহিক সম্পর্ক টেকেনি। লেখিকার এই দীর্ঘ সময়ে কোনো সন্তান নেই। 

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.