অভাগীনির নক্সী-গাঁথা : কর্ণধর মণ্ডল

অভাগীনির নক্সী-গাঁথা : কর্ণধর মণ্ডল
অভাগীনির নক্সী-গাঁথা : কর্ণধর মণ্ডল

পর্বঃ-৪

     এমন এক সময় আসে,দুজন-দুজনকে দেখার জন্য পাগল-উদ্বেগ-উদ্ভান্ত হয়ে ওঠে।ক্ষণিক কালের জন্য নিরুপমা তার অতীতের সমস্ত কথা স্বপ্নের মতো ভুলে,বর্তমানকে নিয়ে ব্যতি-ব্যস্ত ও উদ্বীগ্ন।এটাইতো কালের নিয়ম।অতীতকে ভুলে ভবিষ্যৎকে কাছে পেতে বর্তমানের সাথে!তালে তাল মিলিয়ে সন্মুখে এগিয়ে চলা।

----এটা কি নিরুপমার জীবনে বিধিলিপি?
----না কি!নিরুপমার জীবনে নতুন করে,বেদনার অশ্রু-সজল বার্তা বহন করে আনছে নিয়তির ভাগ্য-লিখন।
----এই নিয়ে আমার মনে একটা সংশয় থেকে যায় । এই কলমের সজ্ঞা-নিরুপমার ভাগ্যলিখনকে কোথায় নিয়ে যায়।আমার কাছে যেমন প্রশ্নের তীর ছুঁড়েছে!ঠিক তেমনই পাঠকের মনে কৌতুহল রেখে যায় এমনটাই....
----দেখা যাক;এর শেষ পরিণতি কোথায় ও কি হতে পারে?

     যে, নিরুপমার এক সময় জীবনের শেষ ঠিকানা ছিল রুপসা নদীর তীরে সন্দরীবৃক্ষ মুলের তলে।আজ সেই নিরুপমার মনে যেন;নতুন করে নিত্য-নব-ছন্দে!সুখের প্লাবন অভাগীনির হৃদয়কে উদ্ভাসিত করেছেন, অজানা কোন স্বপ্ন সুখের অভিলাষে।যদিও রুপম নিরুপমাকে এখনো পর্যন্ত প্রেম নিবেদন করেননি।কিন্তু চোখের ভাষা,উদ্বেগ-ব্যকুলতা,অনুভুতির গভীরতা অনুভবে বুঝিয়ে দিয়েছেন দুজন-দুজনকে কতটা ভালোবাসে।দুজনের এই আলাপ-বিনিময়, হৃদয়ের অনুভুতি,ভাব-ভালোবাসা ক্রমশঃ নিবিড় হতে থাকলো।নিরুপমা ও রুপম দুজনে যে প্রেমে পড়েছে গ্রামের লোকেদের বুঝতে বাকী থাকলো না। ঠিক যেমন- ''আকাশে মেঘের গর্জনে বোঝা যায় কতটা বৃষ্টি হতে পারে''। ঠিক তেমনই ''গ্রামের মানুষের কুৎসা রটানো আবেগী কৌতুহল''।যখন সবাই জেনে গেল অভাগীনির প্রেম-কাহিনীর কথা।তখন আর সমালোচনার অন্তঃ থাকলো না।যা হয়,হাসি-ঠাট্টা-বিদ্রুপ নানা রকম হীন মন্যতার কু-রুচিকর মন্তব্য।হয়তো এমন হয়েছে, যারা আজ উপহাস করছে তারা গতকাল পর্যন্ত রুপমের প্রতি আকৃষ্ট ছিল।অত্যাচারী জমিদারের ভয়ে প্রকাশ করতে পারেনি।কিন্তু নিরুপমা ভাগ্যের লিখনে রুপমের জীবনে জড়িয়ে পড়লো তখন হিংসে হওয়াটাই স্বাভাবিক।আমরা নীতি-গল্পে পড়েছি-''ধুর্ত শিয়াল সাধ হয়েছিল সে আঙুর ফল খাবে।কিন্তু,লাফিয়ে লাফিয়ে আঙুর ফলের নাগাল পায়নি, আর খাওয়াও হয়নি,ঠিক তখনই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে ধুর্ত-শিয়াল বলেছিলেন আঙুর ফল টক''।
----তেমনই নিজের দোষ ঢাকতে,আমরা নির্লোজ্জের মতো অপরের দোষ নিয়ে সমালোচনা করতে বসে যাই।
----ঠিক সেটাই হলো.....
----সবার মুখে একটাই কথা!
----অপয়া,অভাগীনি নিরুপমা নীচ-কুলিন জাতি।যার তিন কুলে কেউ নেই।যে অল্প বয়সে বাবা-মাকে খেয়েছে।সে কি না ভালোবাসবে জমিদারের একমাত্র সোনার টুকরো ছেলেকে। সে কথা আবদ্ধ থাকলোনা রুপসা গ্রামে।বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়লো দিকে দিকে।সংবাদ গিয়ে পৌঁছালো সোনাগাঁ-য়ে অহংকারী জমিদার দুর্যোধন রায় চৌধুরীর রাজ দরবারে।শুনে,নির্দোয় জমিদারের রক্ত-চক্ষু শুল হয়ে গেল। রাগে-ক্রোধে ডগমগ হয়ে অত্যচারী নায়েবকে রাজ দরবারে ডেকে পাঠালেন।আক্রোশ ভরে আদেশ দিলেন,যাও এখুনি ওই মায়াবী অভাগীনিকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসো আমার রাজ দরবারে।
----এমনটা হওয়ারই কথা!যে জমিদারের নাম হতে পারে দুর্যোধন,নিশ্চয় তার কর্মটা তেমন হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় কঠোর-প্রহষণ।

     অত্যাচারী শোষনকারী নায়েব মশাই কয়েক জন উদ্ধত লাঠিয়াল নিয়ে চড়াও হলেন অভাগীনি নিরুপমার উপর।অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসলো জমিদারের রাজদরবারে।অহংকারী জমিদার অভাগীনিকে করলেন নির্মম শব্দে! বাণের আঘাত।নিরুপমা হলেন মানষিক আঘাতে বিধ্বস্ত।অত্যাচারী লাঠিয়ালদের আদেশ দিলেন,এই দুলে-বাগদীর মেয়েটাকে মেরে মেরে শেষ করে দাও।তারপর হতচ্ছাড়িকে রুপসার জলে ভাসিয়ে দাও। ''বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর সাধটা জীবনের মতো মিঠিয়ে দাও''।নির্দোয়-মানবিকহীন-নর-পশুদের হৃদয়ে করুণা জন্মালো না।লাঠির প্রহারে প্রহারে অভাগীনির সারা দেহটা করলেন ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত।শয়তানদের লালসার শিকারে অভাগীনির নিষ্পাপ দেহটা হলো ধর্ষিত কলঙ্কিত।অবশেষে লাঞ্ছিত-অবাঞ্ছিত দেহটা নিয়ে ভাসিয়ে দিলো রুপসার পবিত্র জলে। লাঞ্ছিত অভাগীনির জীবন এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।ব্যথায় ব্যথিত প্রাণ যন্ত্রণায় মৃতপ্রায়।হৃদ-স্পন্দন নিষ্প্রাণ ঘড়ির মতো টিক টিক করছে।

     নিরুপমার জীবনে এমন এক চরম নির্মম ঘটনা ঘটে গেল, জমিদার পুত্র রুপম ভ্রুণাক্ষরে জানতে পারলেন না।কাজ-কর্ম সেরে শেষ প্রহরে রুপম ফিরছে মহানন্দে নদী পথ ধরে, সারাদিনের শেষে একপলকে প্রাণের সাথী ভালোবাসাকে দেখবার জন্য।যেখানে নিরুপমা সারাদিন একান্তে বসে ''সময় কাটায়;গাছের ছায়ায় দুঃখ ভোলায়''!সেই স্থানে উপস্থিত হলেন।কিন্তু,সেখানে এসে নিরুপমাকে দেখতে পেলেন না।রুপম একটু আবেগ মোহিত হলেন।আমার সঙ্গে দেখা না করে,এত তাড়াতাড়ি কখনো বাঁসায় ফিরতে পারে না!
----তাই রুপমের মনে একটু সন্দেহ অনুভব হলো।ভাবতে লাগলেন,নিরুপমার কোন বিপদ হয়নি তো?
----হাজার প্রশ্ন রুপমের মনে জাগতে থাকে।কারন-রুপম ও নিরুপমার প্রেমের কথা জমিদার দুর্যোধন রায় চৌধুরী জেনে গিয়েছিলেন।
----তাহলে,জমিদার আক্রোশের বশে নিরুপমাকে কোন ক্ষতি করলো না তো?
----সেই ভাবনায় রুপম বিচলিত হয়ে পড়লেন।কিছুতেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারলেন না।এমন কাল্পনিক ভাবনায় রুপম বিচলিত হয়ে পড়লেন এবং  রুপম চারিদিকে নিরুপমাকে খুঁজতে লাগলেন।মনে মনে বলতে লাগলেন, নিরুপমা আমাকে বিশ্মিত করবার জন্য কোথাও লুকিয়ে নেই তো?নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পরীক্ষা করবার জন্য।

     একথা বলতে বলতে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকলেন মনের মানুষকে।অনতি ক্রোশ দুরে,নদীর তীরে দেখতে পেলেন,কে একজন মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে রয়েছেন।গায়ের সুভ্র বস্ত্র হয়েছে রক্তে লাল।অনর্গল রুধির ধারা গিয়ে মিশেছে রুপসার জলে।জোয়ারের জল প্রায় তাকে স্পর্শ করে ফেলেছে।দেখে রুপমের বক্ষের ডান অলিন্দটা কেঁপে উঠলো।উন্মাদনার সহিত এগিয়ে গেলেন।কাছে গিয়ে দেখলেন তার হৃদয়ের হৃদ-স্পন্দন,একমাত্র বাঁচার অবলম্বন নিরুপমা।এমন মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে পাগল প্রেমিক রুপম মুহুর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।মুখে কোন কথা নেই।মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো।ক্ষণিকের মধ্যেই সব কিছু রুপমের  কাছে ওলট-পালট হয়ে গেল।কি করবে কিছু ভাবে উঠতে পারলেন না।নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নিলেন।নিরুপমাকে কোলে তুলে নদীর তীরে নিয়ে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিয়েও হুঁশ ফিরলো না।হাত চেপে ধরে দেখলো তখন নিরুর দেহে প্রাণ ধুক ধুক করছে দোদুল্যমান অবস্থায়।কি করবে কিছুতেই ভেবে পেলেন না রুপম।অন্যদিকে পড়ন্ত বিকেল;দিনের সুর্য পশ্চিম দীগন্ত ছুঁতে ব্যস্ত।এখনকার দিনের মতো তখনকার দিনে ডাক্তারের রেওয়াজ ছিলনা।হয়তো পাঁচ-দশটা গ্রাম ঘুরলে একটা ডাক্তারের সন্ধান পাওয়া যেত।গ্রাম-বাংলায় যা চিকিৎসা করতেন গুনীন-বদ্দি-কবিরাজে।রুপমের জানাশুনা একটা কবিরাজ রয়েছেন।সে বহুদুর পায়ে হাঁটা মেঠো পথ।সেখান থেকে প্রায় চার মাইল দুরে পাশকুড়া গ্রামে।সেই কবিরাজের ওষধির এমন ক্ষমতা।যদি দেহে প্রাণ থাকতে কোন রুগীর পেটে পড়ে, তাহলে জমের সাধ্য নেই তাকে মেরে ফেলার।

     একথা অনুসরন করে,রুপম নিরুপমাকে কাঁধে নিয়ে,রুদ্ধঃশ্বাসে ছুটে চললেন আঁকা-বাঁকা মেঠো পথ ধরে পাশকুড়া গ্রামের উদ্দেশ্যে।বেশ কয়েক ঘন্টা হাঁটার পর সেই বিশ্বস্ত কবিরাজ মশাইয়ের নিকট পৌঁছলেন।কবিরাজ মশাই অবাক হয়ে গেলেন।ঘোড়ার গাড়ী ছেড়ে পায়ে হেঁটে জমিদার পুত্রকে এইভাবে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আস্তে দেখে।
----মুহুর্তের মধ্যেই কবিরাজ মশাইয়ের, সকালের নির্মম ঘটনার কথা স্মরন হয়ে গেল।জমিদার পুত্র রুপম ছুটতে ছুটতে এসে কবিরাজ মশাইকে জড়িয়ে ধরলেন।
----বললেন,কবিরাজ মশাই আপনি দয়া করে বাঁচান আমার নিরু'কে।আমি নিরু'কে বড্ড ভালোবাসি।ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।''ও যে বড়ো অভাগী!ও যে আমার জীবনে চলার পথের একমাত্র অবলম্বন''।
----তারপর,কবিরাজ মশাই রুপমকে আশ্বাস দিলেন।জমিদার পুত্র আপনি ব্যস্ত হবেন না।আমি চেষ্টা করছি অভাগী-নিরু'কে বাঁচানোর।এই বলে,কবিরাজ মশাই চিকিৎসা শুরু করলেন।
----কিছক্ষণ চিকিৎসা করবার পর দেহে প্রাণ! ফিরলো।সেদিনের মতো,রুপমের ভালোবাসার জোরে ও ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় নিরুপমা পুনঃজন্ম ফিরে পেলেন।

     নিরুপমা একটু সুস্থ হতেই রুপম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটলো?
----নিরুপমা কিছুতেই সে কথা প্রকাশ করলেন না।যাহাতে রুপমের সঙ্গে তার জমিদার পিতার কোন বিবাদ না হয়।
----নিরুপমা কখনো চায় না যে,ওর মতো অভাগীনির জন্য রুপমের সুখের জীবনে নেমে আসুক দুঃখ-যন্ত্রণা।গড়ে উঠুক বেদনা-বিরহের ''নক্সী-গাঁথা''। নিরুপমা বোঝে দুঃখ-বেদনা কাকে বলে।সে জরা-জীর্ন,নগ্ন-ভগ্ন,নর-পশুতে ছিঁড়ে খাওয়া কলঙ্কিত নশ্বর দেহটা নিয়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে।
----নিরুপমা চরম সত্যটা রুপমকে বলতে অস্বীকার করতেই।কবিরাজ মশাই বললেন, আমি জানি অভাগীনির জীবনে কি ঘটনা ঘেটেছিল।
----তুমি কি শুনতে চাও, জমিদার পুত্র?
----রুপম বললেন,হ্যাঁ কবিরাজ মশাই।জানতে চাই বইকি।বংশ পরম্পরায় আমিও হবো ভবিষ্যতে মহল্লার জমিদার।ন্যায়-অন্যায় বিচার-বিবেচনা করার অধিকার আমারও আছে।
----রুপমের মুখে এমন কথা শুনে,কবিরাজ মশাই আনন্দিত হলেন।আর বললেন,রুপম তোমার মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি আগামীর হাজার স্বপ্নের বীজ বপন করা রয়েছে।

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.