গ্রাম জনপদের নতুন ভাষ্য - কবি মাসুদার রহমান : সূরজ দাশ

গ্রাম জনপদের নতুন ভাষ্য - কবি মাসুদার রহমান : সূরজ দাশ
গ্রাম জনপদের নতুন ভাষ্য - কবি মাসুদার রহমান : সূরজ দাশ

কবি মাসুদার রহমান । জন্ম ০১ সেপ্টেম্বর , ১৯৭০ । ঠিকানা – পাঁচবিবি, জয়পুরহাট, বাংলাদেশ । এ পর্যন্ত তাঁর ৯টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।
১]    হাটের কবিতা, (২০১১) । প্রকাশক – পাঠসূত্র, ঢাকা, বাংলাদেশ ।
২]    উত্তরবঙ্গ সিরিজ, (২০১২) । প্রকাশক – চিহ্ন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ । 
৩] সমুদ্র ( কবিতা পাক্ষিক, ২০১৩),
৪] মাসুদার রহমানের কবিতা ( গুপিযন্ত্র, ২০১৩)
৫] ডাকবাংলো ( আরক, ২০১৫),
৬] ডায়ালের যাদু ( ২০১৬)। আরক থেকে প্রকাশিত
৭] 'ভ্যান গঘের চশমা' বেহুলাবাংলা প্রকাশন, প্রচ্ছদঃ রাজদীপ পুরী।(১২জানুয়ারি২০১৬ - ১২ আগস্ট২০১৭ রচনাকালের ৫০টি কবিতা রয়েছে বইটিতে)
৮] হরপ্পা, তবুও প্রয়াস প্রকাশনি
৯] 'কামরাঙাগাছ রাজি হচ্ছে না', পাখিরা পুরুলিয়া থেকে প্রকাশিত ।
ঢাকা থেকে অনেকদূরে থাকেন কবি । পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা হিলি থেকে ২০-২৫ কিমি ভেতরে এক জীবনানন্দীয় গ্রামে কবির বাস । কবির কোনও সীমান্ত নেই । কবিতার কোনও দেশ নেই । ভাষার কোনও কাঁটাতার নেই । তাই তো কবি বারবার কাঁটাতারের বেড়া ঠেলে সীমান্তের শূন্যরেখায় ছড়িয়ে দেন বাংলাভাষার মায়াজাল । তাকে ভাষার জন্য, সৃষ্টির জন্য শূন্যরেখায় আবেগ আদান প্রদানের নিমিত্তে নিয়ত আসতে হয় ।
  কিছু মানুষ আছেন, যারা কেবল কবিতার জন্যই বাঁচেন, সে রকমই এক ভুতগ্রস্থ মানুষ,  কবি মাসুদার রহমান । কবিতা তাঁর ধ্যান । কবিতার জন্য তিনি অনর্গল কথা বলা এক অতিমানব । বাংলার খেটে খাওয়া গরীব–গুঁড়বো মানুষের অন্তরের ভীষণ কাছাকাছি থাকেন তিনি। হৃদয়ের আবেগের উচ্ছলতা দিয়ে কবিতা ভাসিয়ে দেন তিনি, নদীমাতৃক বাংলাদেশের একুশের ভিটায় ।
    চাঁদে পাওয়া মানুষের কবিতা লেখেন তিনি । সোনাপাড়ার কথা বলেন । তাঁর কবিতায় ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের রোদ – বৃষ্টি – আকাশ । তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘হাটের কবিতা’ । সেখানে কবি রচনা করেন আবহমান গ্রাম জনপদের নতুন ভাষ্য । যে গ্রাম নিয়ত বদলে যাচ্ছে । তারপরেও এখনো যে সব গ্রামের মানুষেরা প্রতিবার হাট শেষে রাত্রিতে টর্চ হাতে গ্রামে ফেরে, তাদের কাব্যভাষা রচনা করেন তিনি । ‘পাখিরা পাখিনির কোমড় জড়িয়ে ভরিয়ে তুলছে আদ্র আকাশ’ । কবি লিখছেন---
    বৃষ্টিরা বেদনানাশক ; তবে আর
    প্যারাসিটামলে কোন কাজ আছে ?

পাঠক পড়ুন ---

    নিহত হবার আগে দু’পেগ গলাতে ঢালা ভালো
    তাতে করে মৃত্যুটা মৌজ প্রবন হয়ে ওঠে
    ধান ভাঙতে শিবের গীত – হোক না তা মন্দ কি
    শিবও একটা মেটার

মেয়েরাই তো ঝাঁক বেঁধে মন্দিরে মন্দিরে শিব লিঙ্গে
পুজো দিচ্ছে
   
    ভগবান শিব যদি স্বয়ং তোমার অ্যাপার্টমেন্টে এসে ওঠে
    কেন তুমি বার বার নিহত হবে না
এখানে কবির কিছু কবিতার বিদ্যুৎ পর পর তুলে দিলাম ।

 পাঠক চোখ রাখুন –
‘বড়বাবুর ফ্লাটে ঋতুবতী কামরাঙা গাছ’
‘সব্জিহাটার টমেটোর রোদ লেগে আকাশ হাসছে’
‘তোমাদের প্রিয় রাতে আমার শরীর ঘিরে ভোজনের উৎসব হোক’
‘আমাদের বউরা খুব সাধারণ মাদি ঘোড়া, পাছাভারি নধর শুকুরি’
‘জিরাফ রোদের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে সারি সারি ভোর’

সীমান্ত-যন্ত্রণা কবির কাব্য ভাবনায় ভীষণভাবে প্রভাবিত ।
‘সীমান্ত অতিক্রমের ভিসা পিঁপড়েদের আছে ?
সীমান্ত রক্ষীরা তুলছে দৃষ্টির এতো শক্ত দেওয়াল
তা ভেদ করে যাওয়া পিঁপড়েদের পক্ষে কোন ব্যাপারই নয়
কবি মাসুদার রহমান

পিঁপড়েরা পেরিয়ে যাচ্ছে ওই সীমান্তরেখা, এই কাঁটাতার’ ।
নিম্নবর্গীয় মানুষের ধর্মীয় রূপান্তরের ছাপ কবির লেখায় ধরা পরে । তিনি লিখেছেন – ‘তারপর সাহেবরা সেই বুনোগাছ পুতে বাগান বানালো, ফ্যাক্টরি বানালো , টোপেন মুন্ডা হলো মারটিন টোপেন মুন্ডা’ ।
    তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সামাজিক ব্যাধির নানান রূপ মাসুদার এর লেখায় আছে, যা পাঠককে ভীষণ আলোড়িত করে । যেমন – ‘মেয়েটিকে বাঘে ধরেছিল’ এই কবিতায় পাই মেয়েদের অসহায়তা, ধর্ষিত হওয়ার খবর ।
কবির দ্বিতীয় কবিতার বই – উত্তরবঙ্গ সিরিজ । বইটিতে  মোট ৪০ টি কবিতা আছে । সমস্ত কবিতার শিরোনাম বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের কোনও না কোনও জায়গার নাম । যেমন ঠাকুরগাঁও, বগুরা, নাটোর , রাজশাহী, হিলি , জয়পুরহাট ইত্যাদি । প্রথম বইটিতে কবিকে পাই গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে থাকা হাটের সৌন্দর্য, মায়া ইত্যাদি । সমাজ বদলের চিত্র, গ্রাম বাংলার রূপান্তরের নিদর্শন, বাংলার ‘হাটের কবিতার’ ছত্রে ছত্রে প্রদর্শিত । পাশাপাশি ‘উত্তরবঙ্গ সিরিজ’ এ কবিকে পাচ্ছি একটু অন্যভাবে । এখানে কবি নির্দিষ্ট জায়গার সুখ দুঃখ, ভালো লাগা – মন্দ লাগার বিভিন্ন অনুভূতি গেঁথে কাব্যমালা তৈরি করেছেন । উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গার সঙ্গে কবির জড়িয়ে থাকা আবেগ নিখুঁতভাবে পাঠকের কাছে হাজির । আমরা যারা এ পার বাংলার মানুষ, যাদের অধিকাংশের নাড়ি পোতা আছে ওপারে , তারা এই বইটিতে পাবেন নস্টালজিয়ার অপূর্ব গন্ধ ।
যে গন্ধ আপনাকে অনেকক্ষণ স্মৃতিমেদুর করে তুলবে । ‘পীরগঞ্জ’ কবিতায় একটু চোখ রাখুন-
    সজনে গাছের নিচে যে প্রৌড় মহিলা দাড়িয়ে আছেন
মায়ের ঢঙয়ে । তিনি প্রায় আমাদের মা
যত গ্রাম আসে যায়, আমাদের গ্রাম
...      ...        ...

এইসব পথ ধরে হেঁটে ফিরেছিলো আমাদের পূর্বজ পুরুষ এক হেয়াত মামুদ !

...        ...     ...

হলুদ সর্ষেক্ষেতে একটি বিকেল ; রোদ নিয়ে নেমে গিয়ে
আজাবধি তেমনই হলুদ’ ।

কবি নাগরিক নন । নগর জীবন থেকে শত যোজন দূরে বাংলার কুটিরে জ্বলা পিলসুজের কাছেই কবিকে ভালো মানায় , এখানেই সাবলীল তিনি । 'জ্বরের ঘোরে পুরোপুরি ঘুম হয় না। আধোঘুম আর শরীর জুড়ে কষ্ট আচ্ছন্ন করে রাখে। গতরাতে জ্বর নিয়ে ঘুমোতে গেলে এর সবকিছু ছিল। তবে বাড়তি এক প্রাপ্তিও ছিল। আধোঘুমের ভেতর দেখছি, মাথার অনেক উঁচুতে এক বাঁকনো ব্রিজ। তার উপর দিয়ে হাঁটছি। এতো উঁচু যে গা শিরশিরিয়ে উঠছে। নিচে রুপোলি ফিতের মতো হারাবতি গ্রামগঞ্জ হাটবাজার পথঘাট লোকজন দেখে শিউরে উঠেছি। সকালে একটু দেরিতে ঘুম ভাঙলো। সেই ব্রিজটির কথা মনে করে ভলোলাগা সারাদিন ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলো। আজও জ্বর শরীরে ঘুমোতে যাব। উঁচু ব্রিজটিতে আর একবার উঠতে চাই।'


কবির সমাধিফলকে লেখা কবিতাটি পড়ুন

সমাধিফলকে লেখা নিজের নাম
দেখে হাসলাম

শীত সন্ধ্যার আগে কুয়াশা শিশির
গোধুলির মেয়েটিও সিঁদুর পরেছে

দূরের রাস্তা দূরে
ধুলোছাই মাখা মাখা টয়েটা বাইক
শেষ আলোয় পাখি গাছ
কবিতার দাঁড়ি কমা নড়েচড়ে

কেবল ক্যামেরা টিপে ধরে রাখা
ছবিটিই স্থির


তাঁর নানান সম্মান প্রাপ্তির মধ্যে কয়েকটি
'দ্বৈপায়ন ( অচেনা যাত্রী) সাহিত্য সম্মাননা-১৪২১',
'ইতিকথা মৈত্রী সাহিত্য সম্মাননা-১৪২৩'।

গ্রাম জনপদের নতুন ভাষ্য - কবি মাসুদার রহমানকে স্যালুট ।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.