![]() |
মুখাগ্নি : চাষী সিরাজুল ইসলাম |
চিতার আগুনে দাউ দাউ পুড়ছে সাধন রায়ের দেহাবশেষ। মহুর্তেই ছাই হয়ে গেল বর্নাঢ্য একটা মানুষ। চিতার পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রু ধরে রাখতে পারলোনা টিনা রহমান ঝর ঝর কেঁদে ফেলল। কয়েক ফোঁটা তপ্ত অঁশ্রু গড়িয়ে পড়লো পায়ের ওপর।
সাধন রায় ছিলন সিনেমাটোগ্রাফার। সেলুলয়েডের ফিতায় ছবি তুলতে তুলতে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তার দৃষ্টিনন্দন ফটোগ্রাফী, অালোছায়া সিনেমায় ধ্রুপদী হয়ে ওঠতো। সেই বিখ্যাত রায় সাহেবকে প্রায়ই ছবিতে নিতেন চলচ্চিত্র পরিচালক টিনা রহমান। কাজ করতে গিয়ে এক সময় দু'জনের মধ্যে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সাধন রায় হয়ে ওঠেন টিনা রহমানের পিতৃতুল্য। টিনা রহমান হয়ে ওঠেন পুত্রসম। এক বৃন্তে দুই ফুল হিন্দু-মুসলমান।
শ্যুটিংয়ের অবসরে একদিন টিনা রহমানকে ডেকে রায় সাহেব বললেন,
--টিনা,আমার মৃত্যুর পর তুমি কী আমার মুখাগ্নি করতে পারবে ? তোমার সাহস আছে। তবে তুমি মুসলমান? একজন মুসলমান একজন হিন্দুর মুখাগ্নি করতে পারে কিনা অামি জানিনা। টিনা,তুমিতো জানো আমার একটা মেয়ে। সে কলকাতার টালীগঞ্জে থাকে। এই পিতৃভূমি বাংলাদেশে আমার আত্নীয় স্বজন কেউ নেই। তুমি আমার পুত্রতুল্য। তুমি ধর্মান্ধ নও। জানি ধর্মের ভেদাভেদ তোমার মধ্যে নেই। আমি চাই তুমি আমার মুখাগ্নি করবে।
টিনা রহমান রায় সাহেবের মুখাগ্নি করবেন সন্মতি দেওয়ার পর একদিন শুটিংয়ের বিরতিতে রায় সাহেব টিনা রহমানকে এফডিসির শ্যুটিং ফ্লোরের বাইরে ডেকে এনে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখাগ্নি করার লাঠি হস্তান্তর করে বললেন,
-নাও ধরো। অামার মৃত্যুর পর এই লাঠি দিয়ে তুমি অামার মুখাগ্নি করবে।
দিন যায়। রাত যায়। দিন যায়। টিনা রহমান শুটিং ডাবিং এডিটিং নিয়ে মহাব্যস্ত। উপরন্ত মানিকগঞ্জের ঝিটকায় 'মরাগাঙ পোড়াফসল' উপন্যাসের চিত্রায়ণ করে চলেছেন। এই ব্যস্ততার মধ্যেই হঠাৎ একদিন টিনা রহমানের কাছে খবর এলো-তার পিতৃতুল্য সাধন রায় সাহেব অার নেই,স্বর্গত হয়েছেন।
টিনা রহমান সাধন রায়েরর মুখাগ্নি করবেন সে কথা ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রির সবাই জানতেন। তাই মানিকগঞ্জের ছিটকায় ঢাকা থেকে লোক পাঠানো হল টিনা রহমানকে নিয়ে আসার জন্য। যেন তিনি দ্রুত এসে মুখাগ্নি করতে পারেন।
তখন গভীর রাত। সাধন রায় সাহেবের মরদেহ চিতায় উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। অপেক্ষা শুধু টিনা রহমানের জন্য। তিনি অাসবেন। মুখাগ্নি করবেন।
এক সময় টিনা রহমান শ্নশানতলায় এসে পৌঁছান।হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুসারে সাদাথান পরে মন্ত্রপাঠ করে পুরোহিতের সংগে ধীরলয়ে বিনম্র ভক্তিতে চিতার কাছে গিয়ে রায় সাহেব প্রদত্ত সেই লাঠি নিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর আগুন জ্বালিয়ে সেই লাঠি দিয়ে মুখাগ্নি করলেন চিতায় শোয়ানো রায় সাহেবের। সংগে সংগে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠলো কাষ্ঠ নির্মিত চিতা। চিতার পাশে দাঁড়িয়ে বিমূঢ় অছির দু'চোখের জল ছেঁড়ে দিয়ে মনে মনে বললেন,
- তুমি হিন্দু। আমি মুসলমান। অামাদের মধ্যে ধর্মভেদ ছিলনা বলেই তোমার অন্তিম ইচ্ছে ছিল মুখাগ্নি যেন অামি করি। তাই করলাম । হিন্দু-মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ববোধের কথা সেই মহাত্না গান্ধী থেকে অনেকেই বলেছেন। কিন্তু এমন দৃষ্টান্ত আগে কেউ করেছেন কিনা অামি জানিনা। জানিনা ঠিক করেছি না বেঠিক। আমার ধর্ম অামার জায়গায় ঠিক আছে। এটাতো একটা কর্ম মাত্র। এরপর অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন চিতার সামনে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন