![]() |
আমি কেন লিখি : সিদ্ধার্থ সিংহ |
'কেন লিখি? এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করায় বিশ্ববন্দিত লেখক আঁদ্রে জিদ বলেছিলেন, ‘লিখি, কারণ না লিখলে হাত ব্যথা করে।‘ গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন, ‘লিখি, যাতে আমার বন্ধুরা আমাকে আরও একটু বেশি ভালবাসে।‘ হেমিংওয়ে বলেছিলেন, ’বাঘ যে কারণে হরিণ শিকার করে, আমি সেই একই কারণে লিখি‘। তাঁদের এই ধরনের উত্তর শুনেই বোঝা যায়, প্রশ্নটাকে তাঁরা হালকা ভাবেই নিয়েছিলেন। এও বোঝা যায়, এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে তাঁরা একটু বিব্রতও হয়েছিলেন। কারণ এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সত্যিই দুরুহ।
অনেক লেখক অবশ্য বেশ গুরুত্ব দিয়েই এই প্রশ্নের মোকাবিলা করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘লেখা ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে যে-সব কথা জানানো যায় না, সেই কথাগুলি জানাবার জন্য লিখি।‘
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে জীবনানন্দ দাস তো গোটা একটা নিবন্ধই লিখে ফেলেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার এবং যাদের আমি জীবনের পরিজন মনে করি তাদের অস্বস্থি বিলোপ করে দিতে না পেরে জ্ঞানময় করার প্রয়াস পাই। এই কথাটি প্রচার করে যে জীবন নিয়েই কবিতা।‘
এগুলো হল সাহিত্যের দিকপালদের কথা। কিন্তু আমি কেন লিখি? বিশেষ করে কবিতা কেন লিখি? তার কারণ কিন্তু একটাই--- যাঁরা কবি বলে নিজেদের দাবি করেন, অথচ এক লাইন কবিতা তো নয়ই, একছত্র গদ্যও লিখতে পারেন না, তাঁরা যাতে আমার সম্পর্কে কুৎসা রটাকে পারেন, আমার যে কোনও কাজ, এমনকী ভাল কাজ নিয়েও যাতে তাঁরা কটাক্ষ করতে পারেন এবং আমাকেই জীবনের একমাত্র শত্রু ভেবে, সব কাজ ফেলে আমার বিরুদ্ধচারণ করার জন্য তাঁরা যাতে আরও একটু বেশি দিন বাঁচতে পারেন, মূলত তাঁদের জন্যই আমি কবিতা লিখি।
লিখি মানে এখন লিখি। কিন্তু প্রথম কবিতাটি কেন লিখেছিলাম বা প্রথম দিকে কেন একের পর এক কবিতা, গল্প, ছড়া, গান, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাসের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও কলম ধরেছিলাম, এখন আর তা বলতে পারব না। না, কেউ আমাকে বাহবা দেবে কিংবা কবিতা পড়ে ভাল লাগলে কোনও সুন্দরী মেয়ে আমার প্রেমে পড়বে এবং প্রেমে পড়লে লোকে যা যা করে... আমি সেগুলো তাঁদের সঙ্গে অনায়াসে করার সুযোগ পাব; না, সে সব ভেবে আমি যে মোটেও লেখালিখি করতে আসিনি, এটা হলপ করতে বলতে পারি।
আসলে কবিতা লিখে আমি আনন্দ পাই। বেঁচে থাকার রসদ পাই। আত্মঘাতির অবিরাম হাতছানি থেকে নিজেকে একটু একটু করে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি।
তবে আমার মনে হয়, 'কেন লিখি' বা 'কেন কবিতা লিখে'--- এ প্রশ্নের জবাবদিহি করতে কোনও কবি বা লেখক বাধ্য নন। যেমন, কোনও মা বাধ্য নন, কেন তিনি সন্তান ধারণ করেন এবং তার জন্ম দেন, তার জবাবদিহি করতে। যেমন বরুণদেব বাধ্য নন, কেন তিনি বৃষ্টি হয়ে ঝরেন, তার জবাব দিতে। যেমন কোনও ময়ূর বাধ্য নয়, কেন সে পেখম মেলে নাচে, তার জবাব দিতে। ঠিক তেমনি, কোনও সৃষ্টিশীল মানুষই তাঁর সৃষ্টিকর্মের কারণ, কারও কাছে ব্যাখ্যা করতে বাধ্য নন। যদি বাধ্য হয়ে জবাবদিহি করেনও, সেটা হবে তাঁর কাছে আত্মহত্যার সামিল।
তবু কি কেউ মুখ খোলেন না? খোলেন। যেমন--- ম্যাক্সিম গোর্কি একবার কথা প্রসঙ্গে লেনিনকে বলেছিলেন, ভাল গদ্য লেখার চেয়ে পদ্য লেখা বরং অনেক সহজ কাজ। এতে সময়ও কম লাগে। সে কথা শুনে লেনিন রেগে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ’কবিতা লেখা মোটেও সহজ কাজ নয়। আমি তো ভাবতেই পারি না। জ্যান্ত ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে নিলেও তুমি আমাকে দিয়ে কবিতার দুটো লাইন লিখিয়ে নিতে পারবে না!’ লেলিন কিন্তু চাইলেই কবিতা সলিখতে পারতেন। সেই মেধা আর মনন তাঁর ছিল। কিন্তু সেটি মুখ্য নয়। বিষয়টি হচ্ছে কবিতা ও কবির প্রতি তাঁর ধারণা ও সম্ভ্রম। কবিতা লেখা যে সহজ কোনও কাজ বা ছেলেখেলা নয়, সেটিই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন।
কবিতা লিখতে এসে কি আমার কোনও ক্ষতি হয়নি? প্রচুর হয়েছে, প্রচুর। লেখা নিয়ে মেতে থাকার জন্য মামুলি কোনও চাকরি তো নয়ই, একটা ভাল, দুর্দান্ত চাকরির জন্যও কখনও কোনও অ্যাপলিকেশন করিনি। সুখকে বারবার বিমুখ করেছি। পারিবারিক অগাধ সম্পত্তি অবলীলায় হারিয়েছি। হারিয়েছি একের পর এক প্রেমিকা। ভবিষ্যৎ নিয়ে কক্ষনো কিচ্ছু ভাবিনি। ঠিক করেছিলাম, যদি সত্যিই হেরে যাই, না-হয় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ব।
কিন্তু তা বলে কি কবিতার কাছ থেকে আমি কিছুই পাইনি? যদি এটা বলি, তা হলে সেটা হবে ডাহা মিথ্যে কথা। আমি সেটা বলবও না। কারণ, এই লেখাজোঁখা করতাম বলেই, লেখকদের লেখক, সম্পাদকদের সম্পাদক, রমাপদ চৌধুরীর মতো মানুষ আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে আনন্দবাজারের মতো জায়গায় চাকরি দিয়েছিলেন। যাঁকে হাজার অনুরোধ-উপরোধ করেও তাবড় তাবড় লেখকদের বইয়ের সমালোচনা করাতে পারতেন না কেউ, সেই রমাপদবাবুই আমার একের পর এক বই, শুধু আলোচনাই করেননি, প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। আমি যাতে সাহিত্যের বড় পুরস্কারগুলো পাই, সে জন্য চিঠি চালাচালি পর্যন্ত করেছেন। এগুলোও তো এক ধরনের পাওয়াই, নাকি?
তবে যাঁরা লেখালিখি করেন, তাঁদের সবারই কিন্তু প্রথম লেখা, সে কবিতাই হোক, কিংবা গল্প--- সেই লেখার পিছনে একটা গল্প থাকে। আমারও আছে। আমার মাস্টারমশাই ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি। কাস্তেকবি দিনেশ দাশ। পড়া না পারলেই তিনি আমাকে প্রচণ্ড মারতেন। একবার স্কেল দিয়ে এমন মার মেরেছিলেন যে, আমার সারা গায়ে কালশিটে দাগ পড়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, উনি কবিতা লেখেন বলে বুঝি ওঁর খুব দেমাক। কবিতা লেখা যে এমন কিছু আহামরি ব্যাপার নয়, সেটা প্রমান করার জন্যই আমি ঠিক করি, আমিও কবিতা লিখব।
তখনও টিভি আসেনি। বেতারের যুগ। তখন বুধবার বুধবার রেডিয়োতে যাত্রা হত। সেই যাত্রাতেই শুনেছিলাম--- এই রণে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনি। 'রণ' শব্দটা আমার ভাল লেগে গিয়েছিল। ডিকসেনারি খুলে দেখেছিলাম, রণ মানে যুদ্ধ। সে দিনই অঙ্কের খাতায় রণ নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলেছিলাম।
পর দিন পড়াতে এসে সেই কবিতাটা পড়ে উনি কয়েকটি শব্দ কারেকশন করে, আমাকে ওটা কপি করে রাখতে বলেছিলেন। আমি করে রেখেছিলাম। তার পর দিন পঁচিশ পয়সা ডাকটিকিট লাগানো একটা খাম নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেই খামে ওই কবিতাটার সঙ্গে দু'লাইন চিরকুট লিখে, আমার এখনও মনে আছে, খামের ওপরে উনি লিখে দিয়েছিলেন--- সাগরময় ঘোষ / দেশ পত্রিকা / ছয় ও নয় সুতারকিন স্ট্রিট, কলকাতা বারো।
এক মাসের মধ্যেই সেই কবিতাটা ছাপা হয়েছিল।
তখনই টের পেয়েছিলাম, অক্ষরের সুড়ঙ্গপথ দিয়ে এই চেনা পৃথিবী ছাড়িয়ে অন্য এক পৃথিবীতে অনায়াসে চলে যাওয়া যায়। সেই যাওয়ার পথটা এতটাই মাদকতা মেশানো ছিল যে, আমার মনে হয়েছিল প্রেম, স্বাচ্ছন্দ, ঐশ্বর্য, সুখ, আরাম, এমনকী ডি এম টি ড্রাগও তার কাছে কিচ্ছু না।
সেই মাদকতাতেই মজে আছি এখনও। আমার বিশ্বাস, এই নেশার হাত থেকে আমি আর কোনও দিনই নিস্তার পাব না। তাই 'কেন লিখি' বা 'কবিতা কেন লিখি' বানিয়ে বানিয়ে মনগড়া একটা জবাব দেওয়ার চেয়ে, আমার মনে হয় একটা-দুটো নয়, একশোটা কবিতা লিখে ফেলাও আমার কাছে অনেক সহজ।
তবে 'আমি কেন লিখি', লেখালিখি শুরু করার দিনগুলিতে এই প্রশ্ন করলে আমার পক্ষে তার জবাব দেওয়াটা হয়তো অনেক সহজ হত। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, ততই জড়িয়ে যাচ্ছি কবিতার সঙ্গে আর যত জড়িয়ে যাচ্ছি, আমার কাছে ততই যেন ঝাপসা হয়ে আসছে এই প্রশ্নের উত্তর।
আসলে আমি বোধহয় লেখালিখি করি অনেকগুলো কারণে। আর সেই কারণগুলো এখন একটার সঙ্গে একটা জড়িয়ে, মিলেমিশে এমন একটা দলা পাকিয়ে গেছে যে, ঠিক কোন কারণে আমি লিখি, সেটা আলাদা করার আর কোনও উপায়ই নেই। ছুরি, কাঁচি, চিমটা নিয়ে বসলেও কোনওটাকেই আর আলাদা করতে পারব না। কিছুতেই পারব না।
তার চেয়ে বরং বলে দেওয়া অনেক সহজ--- লিখি, বেশ করি। আরও লিখব। যদি কিছু করার থাকে, করে নেবেন, যান।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন