![]() |
সুবীর সরকার |
বন্ধুর বাড়িতে তালগাছে ঢোলে...
১।
এক প্রবীণ মানুষের গল্প শোনাই। প্রবীণ এই মানুষটি এক মহার্ঘ্য ইতিহাসের আলোবাতাস জড়ানো ব্যক্তিত্ব। কোচবিহারের প্রবীণতম ব্যক্তিত্ব শ্রী অজিত গুহ।লোকসমাজে যিনি কালু গুহ নামেই পরিচিত।জন্ম-1918 তে।কোচবিহার তখন দেশীয় রাজ্য।দাদা ছানা গুহ রাজ এস্টেটের উচ্চপদে কাজ করতেন।কালু গুহ মহারাজার ফুটবল টিমে খেলেছিলেন।মহারাজা জগদ্বীপেন্দ্র নারায়ণ ভুপ বাহাদুরের শাসনকাল পুরোটাই প্রত্যক্ষ করেছেন।খুব কাছ থেকে দেখেছেন রাজকুমার ইন্দ্রজিৎ ও রাজকুমার গৌতম নারায়ণকে।চোখ বন্ধ করলেই পরিষ্কার দেখতে পান রাজকুমারী গায়েত্রী দেবী ও রাজকুমারী মেনকা দেবীর বিবাহের উৎসব।ভোরবেলায় মহারাজা ও রাজকুমারদের দেখতেন সারা শহর ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যেতে।প্লেনমাঠ এ পোলো খেলা।শীতকালে শিকারযাত্রার জুলুস।সাগরদিঘির পারে রাজকীয় সেনাদলের প্যারেড।ক্যাপ্টেন পূর্ণেন্দু নারায়ণ,অধ্যাপক চুনিলাল বসু ও কোচবিহারের ছাত্র বিক্ষোভ।মেলার মাঠে হিতসাধনীর সভা।আব্বাসউদ্দীন এর ভাওয়াইয়া গান।তার কাছ থেকে রাজ আমলের একেবারে শেষের দিনগুলো কি জীবন্তভাবেই উঠে এলো।শোনালেন মহারানী জর্জিনার গল্প।মহারাজার খেলার গল্প।রাজ আমলের পরিছন্ন প্রশাসনব্যবস্থা।রূপকথার মতন এই শহর কোচবিহারের ছবিগুলি কেমন থরে থরে উঠে এলো।কালু গুহ নিজে কোচবিহারের আননোন ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্টাতা ছিলেন(1945)।আমি সমৃদ্ধ হলাম।সত্যি তো,আমি নিজেও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই মহারাজা ও রাজকুমারদের ছুটে যাওয়া অশ্বক্ষুরধ্বনি।আর আব্বাস সুরেন নায়েব আলীর ভাওয়াইয়া।আর তোর্ষাপাড়ে হস্তীকইন্যার গান গাইছেন রাজার হাতির সব মাহুতেরা।
আমি ভাগ্যবান যে আমি এই ইতিহাস,কিংবদন্তি ও সোনারবরণ মানুষ ঘেরা জনপদের মানুষ।এ আমার জন্মভূমি।
ভালো থাকুন অজিত গুহ। প্রনাম জানবেন।
২।
'বন্ধুর বাড়িতে তালগাছে ঢোলে
ওরে হ্যাচকা টানে পিরিত খসে
মাঘমাসী শীতে'
আমার পৃথিবী নাচগানের পৃথিবী।গঞ্জহাটের ধুলোয় ভুমিলগ্ন লোকমানুষের অবহমানের বেঁচে থাকাটা আমাকে বিস্মিত করে।সাহস যোগায়।এই উত্তর জনপদের রোদ হাওয়া লোকগান জড়িয়ে বেশ আছি।ভালো আছি।আর মেঘের নীচে উড়ে যাওয়া অনন্তের সব পাখিদল।আর বিবাহবাজনা থেকে উড়ে আসছে বিমল মালির জাদুবাজনা।আর 'আইলে আইলে আইল কাশিয়া গাত পরে হালেয়া'...
আমার বেড়ে ওঠা বড় হয়ে ওঠা যে জনপদে,উত্তরের এক জঙ্গল চা-বাগান রাজবংশী ও পুর্ববঙ্গের মানুষদের ঘেরাটোপের ভিতর;সেই অপরূপ বাল্যকাল আমার জীবনে আবহমানের এক জীবন ঢুকিয়ে দিয়েছিল।বাবা জ্যাঠা পিতামহের খড়মের শব্দ, ধানের গোলা কীর্তন গান, ঠাকুমার পুঁথি পা্ঠ, রাত জেগে পালাগান শোনা, জঙ্গলের দিক থেকে আসা হাতির ডা্ক চা-বাগানের ভেতর ছুটে যাওয়া শেয়াল ও খরগোশ, মথুরার হা্ট , ভরা হাটে আদিবাসীদের নাচগা্ন, হাড়িয়ার বাথান,মাহুত বন্ধুর গা্ন, এতোয়ারী এক্কা, জার্মান রাভা, শিবজি , পাতলাখাওয়া ফরেস্টের শিকারকাহিনি, শেষ রাজা ও রাজআমলের মিথ, ডানকান সাহেবের সফেদ ঘোড়া, আঞ্চলিক নদীর ওপর ঝুকে পড়া মেঘদল, ভুমিলগ্ন প্রান্তিক মানুষের সহজসরল যাপন আমাকে নেশার মতোন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিল।আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমার জীবন কবিতাজীবন!সন্নাসী ও সৈনিকের জীবন!আমার জীবন অভিশাপের জীবন!জন্মমরণের দিকে আবহমানের এক মানবজীবন আমাকে শিক্ষিত করেছে।পুষ্ট করেছে।মরণ অবধি এই জীবন জড়িয়েই আমি বাঁচবো।আমার কাজ করবো।সচেতনভাবে কিছুই নির্মাণ করিনি আমি।নির্মিতই হয়ে গেছে এভাবে সব!দীর্ঘ ১০ বছরের পরিশ্রম ও ক্ষেত্র সমীক্ষার শেষে এবারে লেখা শুরু করছি আমার স্বপ্নের সেই কাজে।যেখানে উত্তরাঞ্চলের ভুমিলগ্ন লোকসমাজ লোকজীবন,নাচঘেরা গানঘেরা বাজনাঘেরা ইতিহাস মিথ পুরাকথার অনন্ত জীবনের জীবন্ত ছবিগুলিকেই স্থাপন করতে চাই।জানি না পারবো কি না!পাশাপাশী জানি,নিশ্চিতভাবেই পারবো।খুব আনন্দ হচ্ছে!যে জীবনের প্রতি আমার অনন্তের মায়া সেই যাদুজীবনকে এবার মনের মতন করে লিখবো। আবহমান এক সময়ের জলছবি ধরা থাকবে সেখানে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন