উৎপল কুমার বসুকে নিয়ে একটি গদ্য : বিশ্বজিৎ লায়েক

উৎপল কুমার বসু

 "দুঃখের দিনে তুমি আমারই লেখার কাছে ফিরে আসো।"


মানুষ কি নিঃসঙ্গে হাঁটেন! হাঁটতে হাঁটতে তিনি কোথায় পৌঁছান! আবেগে! বৌদ্ধিকতায়!
এই হাঁটা কি জলের মতো! এই হাঁটা কি আলোর মতো! মোহময় নৈমত্তিক!
সহজ উপলব্ধির ভিতর, স্বতন্ত্র ধ্বনিময়তায় আমরা যখন সংক্রামিত হই আমাদের বোধের কাছে তখন "সুখ-দুঃখের সাথী" এসে কথা বলে---
"পেয়েছো মানব জন্ম। অন্য কিছু হলেও তো হতে পারতে।                                                                                                
এই ধরো আমার মতন পাকচক্রে জায়ফল, হলুদ ও ধনেপাতা,                                                                                          
কাসুন্দি ও ফুলবাড়ি --- এই কবিতার স্তবকের ফাঁকে ফাঁকে ঝর্ণার                                                                  
জল পতনের শব্দ।
...      ...                ...                    ...              ...      
শুধু মানুষই মানুষকে ধন্যবাদ দেয়। কৃতজ্ঞতা বোধে তার দুখ চোখ।                                                                                      
জলে ভরে ওঠে। তারা ইহলোক সৌন্দর্যে কাটায় -- ব্যয়ে ও অর্জনে                                                                                        
ভিন্ন ভিন্ন বস্তু ও প্রাণীর নামকরণেই কতকাল নষ্ট করে। বলেঃ                                                                                                    
'এদের জেনেছি'। আমরা, বাইরে যারা,  অতিকষ্টে হাসি চেপে                                                                                                                                                                                                                 থাকি"
এই তাঁর কবিতা। এই তাঁর 'অধরা মাধুরী'। আমাদের জীবনের গভীরতম অন্ধকারের ভিতর দীপ্যমান শিখা।
ভাষার দিকে কবির ভ্রমণ, উড়ে উড়ে যাওয়ার প্রবণতা, অনির্ণেয় নয় বরং প্রশ্নচিহ্নের মতো জেগে জেগে থাকা গোপন বিভা থেকে বেরিয়ে আসে করতলে আঁকা 'কহবতীর নাচ'----
"দু-হাত শূন্যে তুলে কেঁদে উঠি, 'প্রভু, ওটা আমাকেই দিতে হবে'                                                                                                        
লোকে প্রচন্ড আমোদ পায়-- বলে, 'তোর আমড়াগাছির যেন শেষ নেই                                                                                              
আবার দেখা তো দিকি ঐ খেলা,' আমি আবারো দেখাই                                                                                                                    
মাঝে- মধ্যে অতিরিক্ত কিছু হাঁপ জুড়ে দিই, যথা, 'এসেছিনু ভবে'             
...                ...                    ...              ...        ...
মূক ও মৃত্যুমুখী, শরীরের নীল আলো জ্বলে কারো কারো।"

কবিতার ভাষা বদলায়। বদলাতেই থাকে। কবি ২৫ বছর বয়সে যে ভাবে লেখেন ৫০ বা ৭৫ - এ পৌঁছে তিনি সেভাবে লেখেন না। এও তো এক ভ্রমণ, এই ভ্রমণেও তৃষ্ণা থাকে। আত্মার জিজ্ঞাসা থাকে। থাকে আত্মদহনের অমিত রসায়ণ।
"তারপর ঘাসের জঙ্গলে পড়ে আছে তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি।/ এবং আকাশ আজ দেবতার ছেলেমেয়েদের নীল শার্ট পাজামার মতো বাস্তবিক।/ একা ময়ূর ঘুরছে খালি দোতলায়।/ ঐ ঘরে সজল থাকতো।'

জুতো নয়, চপ্পলও নয়, নেহাতই  ম্যাড়ম্যাড়ে চটি। আর তার আগে 'ব্যক্তিগত' ও 'বসন্তদিন' -- দু'দুটো সম্ভ্রান্ত বিশেষণ-- আমাদের মোহিত করে না, অন্যরকম ভাবে বিষণ্ণ করে কারণ 'ঐঘরে সজল থাকতো'। এই বিষাদ জলের বুদ্ বুদ্।  কোথাও গিয়ে মিলিয়ে যায় আবার কোথাও গিয়ে তৈরী হয়, সেখানে অন্য কেউ থাকে।
"দরজায় কেউ কি দাঁড়িয়ে আছে---  ভেবে হুড়কো নামিয়ে দেখি বোঝাপড়া/ পাড়ার পিয়ন আমাকেই খুঁজছেন,/ বললেন--- নুরপুর থেকে আপনার একটা রেজিস্ট্রি এসেছে,/ ভুল ঠিকানায়, দিতে অনর্থক দেরী হল,/ কোথায় থাকেন মশায় সারাদিন"

উৎপল কুমার বসু কোথায় থাকেন আমরা তা জানি। তাঁর  নিজের ভাষায়---"আমি যেন বারবার জেগে উঠি লোকাল ট্রেনে --- বর্ধমান, বনগাঁ, মেদিনীপুর, ডায়মন্ডহারবার, যাতায়াতের পথে--- লোকের কথায়, হকারের ডাকে, পিকনিক যাত্রীদের হাসিঠাট্টায়, কলহবিবাদে, থুতু ছেটানো ক্রোধে ও অনন্ত কোলাহলে।" ( সদা ভ্রাম্যমাণ)

তিনি চেয়েছিলেন একটা ওপেন ইউনিভার্সিটি তৈরী করতে। সঙ্গী ছিলেন দীপক মজুমদার। ভাবনা ছিল সেখানে ইন্টার ন্যাশনাল ট্রেড পড়াবে জেলেপাড়ার মাছের কারবারী যে বাংলাদেশ থেকে মাছ আমদানি করত। আইন পড়ানোর জন্য ঠিক করেছিলেন উত্তর কলকাতার গুন্ডা ফাটাকেষ্টকে। উৎপল কুমার বসু এই ইউনিভার্সিটির নাম দিয়েছিলেন উদাসী বাবার আখড়া। শেষমেশ তা হয়নি কারণ দীপক বলেছিলেন এরকম নামের কোনো ইউনিভার্সিটি হতে পারে না।

তাঁর অসীম কৌতুহল কীটপতঙ্গ, পশুপাখির জগত- সম্পর্কে। প্রকৃতির সঙ্গে অনাদি অনন্ত জীবন বোধের অন্বয় যদিও তিনি বরাবর sophisticated নাগরিক--- জীবনে অভ্যস্ত ফতুয়া, সাদা ঢোলা পাজামা আর ঝোলাব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলেছেন এক টেবিল থেকে আর এক টেবিল। নাটমন্দিরে এসে দাঁড়িয়েছেন রূপনারায়ণপুর লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। দেখেছি অনির্বচনীয়, অননুকরণীয় ভঙ্গিমায় তিনি আবারও এগিয়ে গিয়েছেন। পিছনে পড়ে রয়েছে আমার অসীম মুগ্ধতাবোধ-----
"ভেবেছিলাম মুখে নিতে হবে।/ দাঁত দিয়ে একে চেপে ধরতে হবে--/ মানব জন্ম নামে আবর্জনা পূর্ণ এই পিলিথিন ব্যাগখানি,/ ভ্রণের মতোই তাকে ময়লার গাদা থেকে টেনে আনতে হবে/ আরো বহু কুকুর বেড়াল পার হয়ে, ভুল চিল- শকুনের চোখের আড়ালে,/ মহিমা, আত্মস্থকুণ্ড, নুনজল নিজেই ফুটছে,/ শোধন যোগ্য, যদি আমাকেও রান্না করো।"

বাস্তব ও অবাস্তবের অন্তর্লীন স্তরে তাঁর যাতায়াত। নিজের মতো মঞ্চ সজিয়ে, নিজের মতো করে কথা বলা। আত্মদহনের ভিতরকার নৈব্যক্তিক প্রকরণে দেখতে শেখানোর এই যে প্রয়াস জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতায় তিনি এক এবং অদ্বিতীয় স্রষ্টা।
"কিন্তু হায়, বিধানসভার গেটে আমাকেও বোবা হয়ে / যেতে হল। এত মিথ্যেবাদীদের, দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে / আমি একসঙ্গে কখনো দেখিনি। ওদেরকে কোনো কিছু/  প্রশ্ন করা অর্থহীন। লোকে আমাকেই পাগল বলবে।"

তাঁর কবিতার এই বাস্তব পরিগ্রহণ, সময়কে জাগিয়ে রাখার ideolect আমাদের চৈতন্যে ঘোর লাগায় আর বলে-- " বাবুল, আমার নৌকা যে ছুটে গেল/ অবরোধ তুলে নাও, অন্তত আমাকে এগোতে দাও।"

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠির একটি অংশে তিনি বলছেন-- "দেশের থেকে যারা আসে সবাই বলে অবস্থা খানিকটা ভালোর দিকে। বাজারে জিনিষপত্র পাওয়া যাচ্ছে। লোকে সময় মতো কাজে যাচ্ছে। সাধারণ লোকে আর ডেমোক্রেসি বা Freedom of speech নিয়ে মাথা ঘামায় না। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। পার্লামেন্ট, আইন, ডেমোক্রেসি ইত্যাদির ধাপ্পা আর ভবিষ্যতে কাজে লাগবে না। যে দেশের সমাজব্যবস্থা fair এবং just নয় - সে দেশের সকল Instituion- ই অকেজো এবং সামান্য ঝড়ে ধ্বসে পড়ে যায়।"
সারা জীবন জুড়েই তিনি এই আগুনটা জ্বেলে গেছেন। তাঁর গদ্যগ্রন্থে সেই ভাঙচুরের গনগনে আঁচ। কবিতায় ঘুম ভাঙানিয়ার নতুন জাগরণ মন্ত্র--- ' কবিতা, পাঠক এবং কবির মধ্যে এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী পদ্ধতির আবিষ্কারক, আপাদমস্তক এক শিল্পী, স্বতন্ত্র কবি।

" খিলান, জগতগ্রন্থি, মা- হারা মাতাল যেন ধায় ছিন্ন বেশে,/ শেয়াল, উজানসিন্ধু, তাহলে বাসায় ফিরি, আমি নাগরিক/ ক্ষতচিহ্নবহ বীর অফিস-ফেরত-------/
তুমি সত্যিকথা--- তাই তোমাকেই এত কথা বলি।"

উৎপলবাবু এ আমার অক্ষমতা। আমার অজ্ঞান। আপনার সৃষ্টিকে নিয়ে দু-কলম লেখার যোগ্যতা নেই। কোনো কালেই হবে না। কেবল জেগে থাকবে সাহসী মুগ্ধতা বোধ। অবিচ্ছিন্ন, অবিরল--
" শুষ্ক নয়ান বোধে/ হাত দিয়ে চোখে/ দেখি, ও মা---/ এ যে জলে ভেসে যায়।
এই তবে অক্ষরহীনতা/ পাঠরোধ, ভুল লেখাপড়া,/ স্কুলভীতি, আতঙ্ক বিঞ্জান,/ বিফল গণিত।
গল্পে ও নক্ষত্রে কীর্ণ/ আজ এক মহাজাগতিক ত্বক- প্রসারিত- স্পর্শাতুর/ সেকি এক্সায় কেউ এসে চুলটা আঁচড়ে দিক?/ তাই জেগে আছে মাতৃভাষা
আর অতি দীন কাঠের চিরুনি আর/ স্নানশেষে এক মাথা ভিজে চুল---/ বাংলা ভাষাই এসে গল্প বলে, / মুখ আদরে মোছায়, সিঁথি কেটে দেয়।"

উৎপলবাবু আপনাকে ছুঁতে পারার মতো ব্যক্তিত্ব আমার নেই। মেধাও নেই-- নেই যথার্থ নিরুপণ ক্ষমতাও। আমি যে মানদণ্ড চিনি না-- শুধু চিনি আমার এ ক্ষীণ পরিসরে ভালোবাসার অধ্যয়ন--- অধ্যয়নের ভালোবাসা আর আপনার মতোই  'জীবনটাকে মজা করে কাটিয়ে দেওয়া-- এর বাইরে খুব একটা ভাবনা চিন্তা, থিওরি টিওর এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা --- এসব আমার জন্য নয়।'

"এখন আমার কোনো দায় নেই। শুধু লেখার খাতাটি নিয়ে/ সমুদ্র ও বনের দিকে চলে -- যাওয়া ছাড়া। ঢেউ গোনা ছাড়া কোনো দরকারী কাজ নেই। নির্জনতা আছে।
...                 ...                  ...                     ...
আমার সাশ্রয় এই সৈকত মাপবার যন্ত্রখানি--- এই খাতা --- এই বোঝাপড়া"
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.