সোনালী মুখার্জী |
আজ বাড়িতে সকাল থেকেই হুলুস্থূল কান্ড .. বাড়ির একমাত্র আদরের মেয়ে নয়নের মনি .তাকে কিছু তেই সামলাতে পারছেন না নবীন বাবু ..আর তার স্ত্রী মালতি দেবী .ব্যাপার টা হলো সকলের ভাই আছে ..ওর কেন নেই ??ওর বন্ধুরা নীতা ..রিনি ...মাধুরী ..সবাই যে যার ভাই কে রাখী পড়াবে ..ও কাকে পড়াবে ?এই নিয়ে কান্নাকাটি ..ওর নাকি আজ ই একটা ভাই চাই ..কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে যায় বারান্দা টাতে .ওর কষ্ট রাগ অভিমান হলে ও এই বারান্দাটায় এসেই দাঁড়ায় ..তখন ই দেখে পাশের উঠোনে দাঁড়িয়ে আহমেদ চাচা .ওরা এই কিছুদিন হলো এখানে বাড়ি করেছেন ..অদিতি দের পাশেই ..অদিতির মা বাবার সাথেও সামান্য পরিচয় ..তবে অদিতি কে দেখে উনি প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করেন ..কেমন আছো দিতি মা ??ও হাসি মুখে বলে ভালো আছি চাচা .রোজ এটুকুই কথা .আজ ও কাঁদতে কাঁদতে বারান্দায় দাঁড়াতেই আহমেদ চাচা ওর কাছে আসে ..জিজ্ঞাসা করে .কি হয়েছে মা ??অদিতির কান্না আরো বেড়ে যায় ভালোবাসার প্রশ্রয় .সব টুকু শুনে চাচা বলে ..ও এই কথা ?দাঁড়াও .আমার কাছে এসো ..আমি তোমার ভাই এনে দিচ্ছি ..বলে ঘর থেকে তার ছেলে নাসির কে নিয়ে আসে কোলে করে .ওর ডাক নাম রাজু ..চাচা বলে ...এই নাও দিতি মা ..আজ থেকে এই তোমার রাখি ভাই ..আর রাজু ??এই তোমার রাখি দিদি ..এই সব কথার সময় অদিতির বাবা মা ..মেয়েকে নিয়ে উঠোনে বেরিয়ে আসেন ..তারাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে .সবার মুখে হাঁসি ফোটে ..চাচা বলে ...রাজু জীবনে কখনো কোনোদিন যে কোনো দরকারে তুমি তোমার রাখীদিদির পাশে থেকো ..কেমন ??সেদিন ছোট্ট পাঁচ বছরের রাজু হয়তো কিছু না বুঝেই মাথাটা নেড়েছিলো ..অদিতি ও খুশি হয়ে তার রাখী ভাইয়ের হাতে রাখি টা পড়িয়ে দিয়েছিল ..আর সেদিন ই বোধয় হিন্দু মুসলিম জাতের উর্দ্ধে কোনো সম্পর্ক মজবুত হয়েছিল .সেটা ভাই বোনের সম্পর্ক ..
সেই শুরু ..সেদিন থেকে অদিতি রাজু এক প্রাণ .এক আত্মা .বলে না দিলে কেউ জানতেই পারতো না ..ওদের আসল পরিচয় ..অদিতি ও যেমন ছোটথেকে রাজু কে নিজের ভাই ছাড়া কিছু ভাবে নি ..রাজু ও তেমনি সারাজীবন অদিতিকে নিজের দিদি ই ভেবে এসেছে ..
এই ভাবেই দেখতে দেখতে পনেরোটা বছর কেটে গেলো .ওরা বড়ো হয়ে গেলো চোখের সামনে ..এখন দুজনেই কলেজে পড়ে ..দুবছরের ব্যাবধানে .রাজু সব সময় রাস্তা ঘাটে তার দিদির খেয়াল রাখে ..আর অদিতি ও কোথাও গেলে তার ভাই কে সাথে করে নিয়ে যায় .
প্রতি বছর অন্যানো দিন ছাড়াও এই রাখীপূর্ণিমা আর ভাইফোঁটার দিনে ওদের খুব আনন্দ .বিশেষ করে রাজুর ..সারাদিন ভালো ভালো খাওয়া আর তার সাথে গিফ্ট .ভীষণ আনন্দে থাকে রাজু ..
সেদিন রাতে অদিতি বারান্দা থেকে ডাকে রাজু কে .দৌড়ে আসে রাজু ..
অদিতি ...ভাই কাল রাখীপূর্ণিমা .মনে আছে তো ?
রাজু ...মনে নেই আবার ??
অদিতি ...ভাই কাল একটু অন্য রখম ভাবে দিনটা পালন করবি ??
রাজু ..বল ??তুই কি চাস ?
অদিতি ..কাল সকালে আমরা বেরোবো ..প্রথমে গঙ্গার ঘাটে .নৌকা চাপবো ..তার পর সিনেমা দেখবো ..সঙ্গে ফুচকা ..ঘুগনি ..খাবো ..তার পর কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি ফিরবো ..যাবি তো ভাই ??
রাজু তো এক পায়ে খাড়া .
কথা মতো বাড়ির অনুমতি নিয়ে দুই ভাইবোন বেরিয়ে পড়লো ..রাজুর এই বছরের নতুন কেনা বাইকে চড়ে .সারাদিন ঘুরে ফিরে আনন্দ করে রেস্টুরেন্টে খেয়ে ফিরতে ওদের একটু রাত ই হয়ে গেলো ..ওরা একটু তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য শর্টকাট মাঠের রাস্তা টা ধরলো ..যদিও অদিতি একটু মৃদু আপত্তি করেছিল ..তার ওপর আকাশের অবস্থাও ভালো নয় ...যে কোনো মুহূর্তে আসতে পারে বৃষ্টি .কিন্তু রাজু বললো .তুই চুপ করে বসে থাক .আমি তো চালাচ্ছি ..উড়ে চলে যাবো ..প্রাণ থাকতে তোর কোনো ক্ষতি আমি হতে দেব না .অদিতি হেঁসে ওঠে .বলে ..আচ্ছা ..তুই খুব বীর ভাই আমার ..চলো এবার ..একটু তাড়াতাড়ি চালাবি ..রাস্তা টা তো ভালো নয় ..
কিন্তু মানুষ কি কখনো নিয়তির সাথে লড়াই করতে পারে ??ওদের ও নিয়তি তে অন্য কিছু লেখা ছিল ..হঠাৎ জোর বৃষ্টি এসে যায় .আর সঙ্গে আকাশ কাঁপিয়ে মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের ঝিলিক ..ওরা মাঝ রাস্তায় পড়ে যায় .একেই মেঠো রাস্তা ..তার ওপর বৃষ্টি ওরা কি করবে ভেবে পায় না .হঠাৎ দেখে সামনে একটু আগেই একটা মারুতি দাঁড়িয়ে .অদিতি একটু ভয় ই পেয়ে যায় ..ভাই কে আঁকড়ে ধরে .কিন্তু এত সরু রাস্তা যে গাড়িটার পাশ কাটিয়ে ওদের যাবার রাস্তা টা পর্যন্ত নেই ..কি করবে ওরা ??গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ওদের মারুতির দিকে এগিয়ে যায় রাজু ..যদি বলে গাড়িটা একটু সাইড করা যায় ..এই .উদ্দেশ্যে অদিতি বলে ..গাড়িটা ঘুরিয়ে নে না ভাই ??বড়ো রাস্তা দিয়েই না হয় যাবো ..একটু দেরি হবে ..বাড়িতেও একটু বকুনি খাবো ..রাজু বলে ..দাঁড়া না .এতটা এসে আবার পিছনে যাবো ?তাও এই বৃষ্টি তে ??আমি তো আছি .বলে গাড়ি টাতে ধাক্কা দেয় রাজু ..গাড়ির কাঁচ খুলে একজন মুখ বাড়ায় ..রাজু বলে ..গাড়িটা একটু সরাবেন দাদা ??তবে আমার গাড়িটা একটু নিয়ে যেতে পারি ..ওরা নিজেদের মধ্যে হাঁসাহাঁসি করে ...রাজু দেখে ভিতরে পাঁচ জন বসে ..সকলের হাতে গ্লাস ..নেশায় চুড় .সবাই .ওরা বলে আচ্ছা দাঁড়াও ..বলে গাড়িটা সামান্য সাইড করে দেয় .রাজু অদিতি কে বলে তুই আমার পিছনে সাবধানে হেঁটে আয় .. আমি গাড়িটা নিয়ে এগোচ্ছি ..অদিতি ভয় ভয় ভাইয়ের পিছন পিছন হেঁটে যায় ..গাড়িটার পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ ই অদিতির ওড়না টা টান পড়ে ..চমকে তাকায় অদিতি .দেখে গাড়ির ভিতর থেকে একটা লোক তার ওড়না টা ধরে আছে ..অদিতি ভাই ...বলে চেঁচিয়ে ওঠে .গাড়ি ফেলে ছুটে আসে রাজু ..বলে .ছাড়ুন ??কি করছেন ??লোকটি বলে এই বৃষ্টি তে সুন্দরী দিদি কে নিয়ে কোথায় চলেছো ??চাঁদ ??তুমি বাড়ি চলে যাও .বৃষ্টি থামলে আমরা তোমার দিদিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো ..গাড়ির ভিতরে সবাই হেঁসে ওঠে .বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় অদিতির ..হঠাৎ গাড়ির দরজা খুলে ওরা অদিতি কে ভিতরে ঢুকিয়ে নেয় .রাজু পাগলের মতো দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে ..ভিতরে ওরা তিনজনে অদিতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে .রাজু অদিতির চিৎকারে কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে যায় ..হঠাৎ একটা বড়ো ইঁট দেখতে পেয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারে গাড়ির কাঁচে .সশব্দে কাঁচ টা ভেঙে যায় ..রাজু ওই ভাঙা জানলার ভিতর দিয়ে অদিতির উপর থাকা লোকটাকে দুহাতে সরাতে যায় ..হঠাৎ সামনে থেকে একজন আর ড্রাইভার এর সিটে বসে থাকা একজন এই দুজন বেরিয়ে আসে .তাদের একজনের হাতে ভোজালি ..আর অন্যজনের হাতে রড ..বেরিয়ে এসেই একজন রড দিয়ে রাজুর মাথায় আঘাত করে .রাজু ঘুরে তাকে সজোড়ে একটা লাথি মারে ..সে একটু দূরে ছিটকে পড়ে ..আর অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে ভোজালী দিয়ে রাজুর কাঁধে আর পিঠে আঘাত করে .রাজু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ..রক্তে ভেসে যায় শরীর ..অদিতি চিৎকার করে কাঁদে বাঁ ...চা ...ও ...বাঁ ....চা ...ও .কিন্তু কেউ ওর ডাকে ছুটে আসে না সে রাতে ..এর পর প্রায় টানা ঘন্টা দুয়েক অদিতির ওপর অত্যাচার করে ওকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে ওরা . তারপরে ওরা অদিতি কে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় ..কারণ ও বেঁচে থাকলে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা ..এদিকে অদিতি কোনো মতে ভাইয়ের কাছে পৌঁছে যায় ..দেখে রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর .ক্ষীণ নিঃশ্বাস পড়ছে ..ভাইয়ের রাখী বাঁধা হাত টা দুইহাতে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে অদিতি ..রাজু বলে .রাখী দিদি ..অনেক ছোট বেলায় আব্বার কাছে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারলাম না রে আমি তোকে বাঁচাতে পারলাম না .হঠাৎ দেখে গাড়ির জোরালো লাইট ওদের দিকে ছুটে আসছে ..অদিতি কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়িটা ওদের দুজনের শরীরের ওপর দিয়ে চলে যায় ..আবার পিছনে গাড়ি গড়িয়ে আসে ..চাকার তলায় দু দুবার ওদের শরীর দুটো পিষ্ট হয়ে যায় ..মৃত্যু নিশ্চিত দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে গাড়ি টি তার গন্তব্যে চলে যায় ..
রক্তে ভেসে যায় মেঠো রাস্তা ..না .কোনো হিন্দু বা মুসলিম এর রক্ত নয় ..শুধু লাল রঙের রক্ত ..দুটি নিষ্পাপ ভাইবোনের রক্ত ..ওদের দুজনের নিথর দেহের সাথে দুজনের ধরা হাতের মাঝে অদিতির নিজের হাতে তৈরী করা "রাখী ভাই "লেখা রাখী টা সেদিন বড়ো উজ্জ্বল লাগছিলো ..বড়ো সুন্দর লাগছিলো ..সেদিন রক্ত দিয়েই ওরা পালন করেছিল ..রাখী উৎসব ..ঝুলন পূর্ণিমা ...
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন