![]() |
গোবিন্দ ধর |
একদিন ঠিক সব মিছে মায়া
ভালোবাসা
প্রতারণা
ডিঙ্গিয়ে চলে যাবো গন্তব্যে।
কথাকার শ্যামল বৈদ্য হঠাৎ গত পরশু শুক্রবার ১৯:১০:২০১৮ কথা বলেন ফোনে,"জম্পুই যাবো আপনি যাবেন"?কিছু না ভেবেই হ্যাঁ বলে দিই।বলেছিলেন বিমলদাও যাবেন।শ্বশুড় অসুস্থ থাকায় তিনি আর আসতে পারেননি।তুলসীর নীলুৎপল সম্পাবৌদিসহ শ্যামলদা সকাল নয়টা চল্লিশ নাগদ কুমারঘাট আসেন।
সকালে বার কয়েক কথার ফাঁকে বলেছিলাম আমরা দুজন গেলে অসুবিধে হবে কিনা।না বলায় পদ্মশ্রী, গৈরিকাও সাথী হলো।
আমি গোপালচন্দ্র দাসকেও সাথী করলাম।
একটি জার্নিতে মনের মতো কয়েকজন কবি লেখক হলে জার্নির আনন্দই আলাদা।
বেলা ১১টা নাগাদ কাঞ্চনপুর পৌঁছলাম।অপেক্ষারত হারাধন বৈরাগী ও দিব্যেন্দু নাথ।
আমরা ছড়াকার অমলকান্তি চন্দের বাসায় উঠলাম।
তারপর চা টিপিন।
গেলাম রেভিনিউ বাংলোয়।
রুমে ফ্রেস হয়েই বেরিয়ে পড়লাম।
টার্গেট নাইশিংপাড়া রিয়াং শরনার্থী ক্যাম্প।কিছুদিন ধরে দুদশক থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা মিজোরামের রিয়াংদের রেশনও বন্ধ।কেমন কাটছে তাদের দিন।প্রত্যক্ষ করতেই এই জার্নিতে হ্যাঁ বলেছিলাম।
আমি দশদা অব্দি অনেকবার গেলেও নাইছিং বা নাইশিং পাড়া এই প্রথম।
পথের দুধারে কুঁড়ে বাচই সদৃশ ছনের চাউনিঘর।
কখনো রিয়াং যুবতীর খারাং এ জ্বালানীর কাঠ বয়ে নিয়ে ঘরে ফেরার দৃশ্য। কখনো পানীয়জল।কখনো রিয়াং মেয়েছেলে ঝর্ণায় সমবেত স্নানদৃশ্য এসব দেখতে দেখতে আমরা দিব্যেন্দু নাথ,গৈরিকা ধর,পদ্মশ্রী মজুমদার গোপালচন্দ্র দাস শ্যামল বৈদ্য বৌদি এবং আমি নাইশিংপাড়ার ক্যাম্পে পৌঁছলাম।
মলিন মুখে রিয়াং যুবতীর মাথায় জলের কলসী।কোন ভ্রুক্ষেপ নাই।আমরা গেলাম বলে আলাদা কোন সতর্কতা নেই।আলাদা লজ্জা নেই।আলাদা কোন অভিব্যক্তি নেই।সহজ সরল অথচ তাদের মলিন মুখে ভেসে উঠছে ভারতবর্ষের প্রতি ঘৃণা।নিজ দেশেই ওরা উদ্বাস্তু। নিজের দেশে ওরা পরবাসীর মতো।
তাদের নেই স্বাস্থ্যকর বাসস্থল। নেই স্কুল।নেই পানীয়জল। ঘরগুলো গ্রামীণ ত্রিপুরায় এক সময় যেরকম ছন বাঁশের বাচই ঘর দেখা যেত সেরকম নড়বড়ে দুচালায় ২৫ বছর থেকে এ টিলা ও টিলায় কাটছে দিন।
এমন করেই গছিরাম পাড়া ও নাইশিংপাড়ায় উদ্বাস্তু ক্যাম্প গড়ে উঠেছে।
রাস্তার দুধারে ওরা আছেন।
এখানের রুক্ষ পাহাড়ে জুম হয় বলেও মনে হলো না।
সঠিক পানীয়জল নেই।
আছে ছোট ছোট নালা।
এই ডিঙ্গিয়েই ওদের জীবন যাপন।জীবন বলতে জীবন কই।যাপন কই।
সরলতা তবুও।
শুনেছি রিয়াংরা ক্ষেপে গেলে কেলেঙ্কারী হতে পারে।সুতরাং আমরা যথা সম্ভব সতর্ক থেকে আড়ালে আবডালে নানা ছবি ক্যামেরায় বন্দী করেছি।
কোথাও তাদের ক্ষ্যাপামী দেখিনি।মুখে লেপ্টে আছে এক অনিশ্চয়তা। তারপর কোথায় যেতে হবে।
কাঞ্চনপুর থেকে সাতনালা দশদা হয়ে নাইছিং বা নাইশিং কিংবা নাইসিংপাড়া প্রায় তিরিশ কিমি।
পথে আমি গোপালদা আর গৈরিকা বাইক চড়েই পেরিয়েছি। তাতে লাভ দৃশ্যগুলো দেখা হলো কাছ থেকে।
মাঝে মাঝেই যেখানে সেখানে থেমে গেছি প্রয়োজন অপ্রয়োজনে।
এমন একটি দিন আসে সত্যি নিজেকে ঋদ্ধ করে নেওয়ার জন্যই।
আমি রিয়াং এর কথা বুঝি না।
সঙ্গী চেয়েছিলাম সুকুমার দাস ছোড়দাকে।তিনি ধর্মনগর।না হলে এই জার্নির আনন্দই আলাদা হতো।
আনন্দবাজার ছিলো ছোড়দার বাড়ি।তিনি রিয়াং চাকমা থেকে একুশটি ভাষায় সাবলীল।
বিকেল হয়ে আসায় আমরা ফিরি ডাকবাংলার পথে।
নীলুৎপল সরকার সুন্দরগাড়ি চালিয়ে পাহাড়ি এবড়োখেবড়ো রাস্তায় কখনো আমাদের সামনে কখনো আমাদের পেছনে।তাঁর কোন ক্লান্তি নেই।সারা পথেই চুটকি গালগল্প আর নানা কথায় পথ কখন এসে পৌছলো দাসপাড়া টি এস আর ক্যাম্প।সেখান থেকে বাঁক নিয়ে আমরা চলে যাই জম্পুই পথে।প্রায় বিশ কি মি গিয়ে একটি ওয়াটারফলস।
নীলুৎপল বলে উঠলেন এটা কী।দাঁড়ান ছবি হয়ে যাক।
হলাম।নাইশিংচূড়ায়ও আমরা ছবি হলাম বার কয়েক।
এবার সন্ধ্যা হয় হয়।ফিরে এলাম বন বিভাগের বাংলোয়।বিশাল বাংলো।
ভাড়া মাত্র১২০ টাকা রুম।এর চেয়ে সুবিধে কোথায় আছে ত্রিপুরায় জানি না।
রাতে বসলো আড্ডা।আড্ডায় অনুগল্প পাঠ হলো।
গল্পের নানা কথায় সমৃদ্ধ হলাম।পাঠ করলেন দিব্যেন্দু নাথ,অমলকান্তি চন্দ,হারাধন বৈরাগী, গোপালচন্দ্র দাস ও পদ্মশ্রী মজুমদার।
আমি নীরব।গৈরিকা গেয়ে উঠলো
"ছোট্ট মোদের পানসী তরী"।
দারুণ দারুণ। এরকম সময় যাবে ভাবিনি।তবু মনে কোন শান্তি পাইনি।রিয়াং শরনার্থীরা চোখের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে।
নাইশিংপাড়ার রিয়াং মেয়েটি
যে মেয়েটি নাইশিং টিলা বেঁয়ে কলসী মাথায়
খাবার জল নিয়ে উঠছে
তার সুন্দর মুখে কে যেনো বিষাদ মেখে রেখেছে
তার কচি কচি হাত পা
অথচ তাতেই লেগে আছে রুক্ষতা।
তার পীনোন্নত বুকে
জুমের আগুন
অথচ নীরব অগ্নিগিরি।
কখন জ্বলে উঠবে নাইশিং পাড়ায় আগুন
কে জানে?
কে জানে মেয়েটির মনে প্রেম আছে কিনা?
কে জানে মেয়েটির শরীর থেকে আলো জাগে কিনা।
মুখের ভূগোল জুড়ে অনিশ্চয়তা
বিষাদ আর মলিন রুক্ষ টিলার যন্ত্রণা
রেণু রেণু হয়ে ঘাম পড়ছে।
ঘামের গন্ধের মাঝে লুঁকানো ছাই
উড়ে এসে
সারা শরীর রিয়াং শরনার্থীর কষ্টগুলো
বাতাস হয়ে চাবুক বসায়।
এ রকম দৃশ্যের কথা মনে পড়ে, সারারাতে আমার ঘুম হয়নি।
সকালে শ্যামলদার ফোন জাম্পুই উঠবো।
বেতলিংশিব যাবো।তার আগেই আমি নিদ্রালু অথচ নাইশিং পাড়ার মেয়েটির মুখ দেখি।
দিব্যেন্দু নাথের অনুভব:
""
ঔপন্যাসিক শ্যামল বৈদ্য নতুন উপন্যাসের আকঁর খুঁজতে কাঞ্চনপুরের নাইসিং পাড়ায় পদার্পণ করেছেন ধর্মপত্নী সহ (20-10-18 ইং)। সাথী হয়েছেন কবি গোবিন্দ ধর, কবি গোপাল চন্দ্র দাস এবং গল্পকার তথা ঔপন্যাসিক পদ্মশ্রী মজুমদার আর আমাদের নান্নিমুন্নি ছন্দকার গৈরিকা ধর। সৌভাগ্যক্রমে আমিও তাঁদের ক্ষণিকের সফর সঙ্গী।
তারপর সবাই জম্পুইর পথে। ছুটে এলেন ক্লান্ত শরীর নিয়ে, ঝিমিয়ে পড়া ঝর্ণার কাছে। শুকিয়ে যাওয়া ঘর্মাক্ত ঘ্রাণে কিছুক্ষণ ভাসলেন।
অবশেষে ডুবে যাওয়া সূর্যের সঙ্গে কাঞ্চনপুর ডাক-বাংলোয়। উপস্থিত হলেন পাহাড়ের গন্ধমাখা কবি হারাধন বৈরাগী ও বিশিষ্ট ছন্দকার তথা কবি অমলকান্তি চন্দ। জ্বলে উঠল দীপ, ছেয়ে গেল আকাশ চিমটি চিমটি আলোয়। চলল একটানা সাহিত্য আড্ডা, রাত দশটা পর্যন্ত। জমজমাট আড্ডায় স্ব-রচিত পাঠের সঙ্গে স্ব-রচিত পুস্তকেরও আদানপ্রদান হল, উপহার স্বরূপ।
স্নেহভাজন হয়ে আমি অর্জন করি--
'বুনোগাঙের চর'
(ঔপন্যাসিক শ্যামল বৈদ্যর প্রথম উপন্যাস)
'আনোয়ারা নামের মেয়েটি',
(কবি গোবিন্দ ধর)
'দেওনদীসমগ্র'
(চৈতন্য ফকির)
'শব্দবীজ' কাব্যগ্রন্থ আর
লিটল ম্যাগ.- 'সৃষ্টিলোক' ও 'মনুতট'।
(কবি গোপাল চন্দ্র দাস)
'বনতট'- লিটল ম্যাগ.
(কবি হারাধন বৈরাগী)
'প্রতিভা'- লিটল ম্যাগ.
(কবি মানচিত্র পাল)
শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসাবে অর্পণ করি। আমার প্রথম উপন্যাস
'আইলাইনার', আর লিটল ম্যাগ. 'দোপাতা' (দিব্যেন্দু নাথ)
রঙ বিহীন আলো ভরে উঠল রঙিন আলোচনা মঞ্চ......""
অমলকান্তি চন্দের অনুভব:
""
কথা সাহিত্যিক শ্যামল বৈদ্য মহাশয়ের সঙ্গে আজকের আড্ডায় সরাসরি কাঞ্চনপুর থেকে আমরা (গল্পকার ও উপন্যাসিক পদ্মশ্রী মজুমদার, কবি গোবিন্দ ধর, কবি হারাধন বৈরাগী, উপন্যাসিক দিব্যেন্দু নাথ, কবি গোপাল চন্দ্র দাস, ছড়াকার গৈরিকা ধর, শিল্পী অভিতাভ সিংহ বড়ুয়া আর আমি) ।""
হারাধন বৈরাগীর অনুভব:
"
উপন্যাসিক ও কথাকার শ্যামল বৈদ্য,কবি চৈতন্যফকির,কবি গোবিন্দ ধরের সৌজন্যে গাঙচিল পত্রিকা, দেওনদী সমগ্র,আনোয়ারা নামের মেয়েটি ----প্রাপ্তি স্বীকার।"
যেতে যেতে গৈরিকা ধর একটি ছড়া আওড়াচ্ছিলো:
"
নাইছিং পাড়া
নাইসিং নাইসিং
নাইছিং পাড়া।
যার নাই সিং তাই
নাইছিং পাড়া।
শিং নাই শিং নাই
করে না গো তাড়া।
নাইসিং যাবো আমি
একটু দাঁড়া।
আমার একটি ভাবনা:
সাতনালা দশদা তারপর
আনন্দবাজার।
নাইসিং নাইসিং
নাই সিং-এ নাই খাবার।
কথাকার শ্যামল বৈদ্যের অনুভব:
""দশদা পেরিয়ে আশাছড়া, নাইসিংপাড়া হয়ে আনন্দবাজার পর্যন্ত প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার জুড়ে রিয়াং ডিসপ্লেস পিপলরা ছড়িয়ে আছেন। উলটো দিকে নবজয়পাড়াতেও আছে উচ্ছেদ হওয়াদের শিবির। তারা কেমন আছেন দেখতে সস্ত্রীক গেছি কাঞ্চনপুর, সাথে ছিলেন তুলসী প্রকাশনীর কর্ণধার নীলোৎপল সরকার। গোপালবাবু বললেন এদের শরণার্থী বলা ঠিক নয়, কারণ তাদের দেশান্তরী হতে হয়নি। একই দেশে যখন আছেন তখন শরণার্থী না বলাই ভাল, উচ্ছেদ হওয়া রিয়াংরাও বলেন না বটে। তারা বলেন ডিসপ্লেস পিপল। মিজোরামের মামিথ, লুংলে ও কলাশিব জেলা থেকে উচ্ছেদ হওয়া রিয়াং জনজাতির লোকেরা প্রাণভয়ে মিজো পাহাড় থেকে উচ্ছেদ হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন জম্পুই পাহাড়ে। স্থানীয় রিয়াং এবং বাঙালিদের সাথে ওরা সহাবস্থান করছেন প্রায় দু’দশকের বেশি সময় ধরে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, কুড়ে সদৃশ ঘরগুলির মধ্যে মানুষের বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা। কোথায় এদের শিক্ষা হয়, জীবিকার ব্যবস্থা কী বোঝার চেষ্টা করলাম। শিশু বৃদ্ধ যুবক যুবতি সবার মধ্যেই কেমন আলস্য জড়ানো প্রাক-শীতের বেলা। কারওর বডি লেঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয়নি এই হতভাগ্য অবস্থায়ও কেউ দুশ্চিন্তায় আছেন। অথচ আমি জানতাম তাদের রেশন বন্ধ হয়ে গেছে।
যাই হোক পুবে জম্পুই পাহাড় এবং পশ্চিমে দেও নদী জড়িয়ে রেখেছে গ্রামগুলিকে। জম্পুইয়ের ও’পারে নাকি লঙ্গাই নদী। কাঞ্চনপুর এসে সঙ্গী পেলাম কথাকার পদ্মশ্রী মজুমদার, দিব্যেন্দু নাথ, কবি গোপাল চন্দ্র দাস এবং প্রকাশক গোবিন্দ ধরকে। দিব্যেন্দু নাথ মজার মানুষ, ‘ভ্রমর কইও গিয়া’ সুরে টান দিতেই হৃদয় ভরে গেল। লোকটা পেশায় একজন গাড়িচালক অথচ তাঁর একটা উপন্যাস আছে। এ সব জেনে শ্রদ্ধায় আনত হয়ে গেলাম। তিনি একটা মোক্ষম প্রশ্ন করলেন, শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার সম্পর্ক তো পরকীয়া – তা হলে বিয়ে নামক একটা স্থায়ী সম্পর্কে সিলেটিরা ধামাইলে এসব গান গায় কেন? বিয়েতে পরকীয়া – কেন? আমিও সিলেটি কিন্তু এর অন্বেষণ আমি কখনও করিনি। পদ্মশ্রীদেবী তার একটা ব্যাখ্যা দিলেন বটে তবে দিব্যেন্দুর শব্দগুলি কানে স্থায়ী হয়ে গেল।
রাতে ডাকবাংলোয় দীর্ঘ আড্ডা হল। হারাধন বৈরাগী, অমলকান্তি চন্দ ও তার শ্যালক আমাদের সাথে যোগ দিলেন। পরদিন আবার আমরা চললাম জম্পুই দেখতে। পাহাড়ে ঢুকতেই শুনতে পেলাম মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। একটু পরপরই এই শব্দ আমাকে চমৎকৃত করল! পরে জানলাম এটা একটা পাখির ডাক। একে স্থানীয়রা বলে ঘণ্টাপাখি। প্রথমদিকে ভালো লাগলেও ক্রমশ বিরক্তিকর লাগছিল এই শব্দ। তবে জম্পুই ছাড়া ত্রিপুরার অন্য কোনও পাহাড়ে এই পাখি পাওয়া যায় না। মনপুই থেকে ভাংমুন হয়ে বেটলিংশিপ গেলাম। ত্রিপুরার সবচাইতে উঁচু শৃঙ্গ ছুঁতে। যেতে যেতে লুসাই/মিজো জনজাতির ঘরবাড়িগুলি দেখছিলাম। ত্রিপুরার কোনও দুর্গম পাহাড়ে জনজাতিদের এতটা উন্নতি আমি দেখিনি। সেদিন ছিল রবিবার, গির্জায় গির্জায় চলছে প্রার্থনার প্রস্তুতি। সুসজ্জিত পোশাকের মানুষেরা লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছেন। বেটলিংশিপ-এ গিয়ে দেখলাম, রতনমণি রিয়াং-এর শিব মন্দিরটি আর নেই। কে বা কারা একে ভেঙে দিয়ে তার বুকে পুঁতে দিয়ে গেছে দু-তিনখানা ক্রস। চারদিক থেকে গিটার আর ড্রামের শব্দ, প্রেয়ারের পবিত্র সুর ভেসে আসছিল। ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে মিজো পাহাড় দেখা যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছিল জম্পুই পাহাড়ের অন্তর যেন আমি ছুঁতে পারছিলাম না। অতীব সুন্দর এই পাহাড় যেন আমার হৃদয়ের কাছাকাছি অবস্থান করছে না। এক দিকে নিরন্ন মানুষ অন্যদিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ উজ্জ্বল মানুষদের দেখে হিসেব মিলাতে পারছিলাম না। কেন এত পার্থক্য জম্পুই, আঠারমুড়া, বড়মুড়া ও লংতরাইয়ের গিরিবাসীদের মধ্যে?
সেদিনই চারখানি পাহাড় অতিক্রম করে রাত ন-টায় ফিরে আসি আগরতলা। হারাধনবাবু তাঁর অন্তিমশয্যায় শায়িত পিতাকে ছেড়ে বারবার এসেছেন। তাঁর সহযোগিতা ছাড়া এই যাত্রা অসম্পূর্ণ হত বলাই বাহুল্য। অমলকান্তি চন্দের শ্বশুরবাড়িতে দুপুরে খেয়ে যখন ফিরি তখনই দেখা হয় এক প্রাজ্ঞ ভান্তের (বৌদ্ধ) সঙ্গে। তাঁর প্রাণখোলা হাসি ও আশীর্বাদ নিয়ে ফিরে আসি। ফেরার পথে গাড়িতে বসে বসে আমি আমাদের পুরো জার্নিটা ছবির রিলে যেন দেখছিলাম। সত্যি জীবনে কত বৈচিত্র! কত আপন সব মানুষেরা তার পরও আমরা কত দূরে দূরে অবস্থান করি। দিব্যেন্দু বলেছিল, ফোন করবেন দাদা পৌঁছে। করা হয়নি বটে, তবে শীঘ্রই আবার দেখা হবে বন্ধুরা।""
এরকম অসংখ্য চড়াই উৎরাই ডিঙ্গিয়ে পরদিন জাম্পুই যাত্রা শুরু হয় সকাল সাতটায়।
অমলের বাসায় চা পান। তারপর বাইকে আমি গৈরিকা আর চালক কবি গল্পকার গোপালচন্দ্র দাস।পেছনে পেছনে চলছে বাইক।সামনে তুলসীর নীলুৎপল সরকার।দক্ষ ড্রাইভে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাতে হয়।
ইডেনে পৌঁছি সকাল দশটা নাগাদ।
পথে ওয়াটারফলস।তারপরেই প্রথম কানে আসে ঘন্টার আওয়াজ।ভয় পেয়ে যাই।পরে একটু পর পর ক্রমাগত সারা জাম্পুই রেঞ্জের ঘনজঙ্গলে কে যেনো স্বাগত জানায় ঘন্টার ধ্বনিযোগে।পরে বুঝলাম কোন ছোট পাখি।তাদের আওয়াজ ঘন্টার মতো করে বের হয়।পাহাড়ের সবাই তাকে ঘন্টাপাখি বলে।বেশ মজাই লাগছিলো।সারা কিচক পাহাড় অতিক্রম করলাম ঘন্টাপাখির ডাক শুনে শুনে।ইডেনে চা পানের বিরতি।তারপর ঘুরে আসার কথা থাকলেও আসা আর হলো কই।নীলুৎপলের প্রবল ইচ্ছা আর বৌদির আগ্রহে আমরা ফুলদংশাই পেরিয়ে পাহাড়ি খাড়াই রাস্তা অতিক্রম করে ঘন্টা পাখির ডাকশুনে শুনে ক্লাক্সির সৌন্দর্যরূপ অবলোকন করে করে বেতলিংশিব চূড়ায় উঠলাম বেলা প্রায় ১১টায়।
রতনমনি রিয়াং এখানেই মন্দির গড়েছিলেন শিবের।যা এখন যিশুর ক্রশচিহৃে ঢেকে আছে।চারদিক নোংরা আর খালি বোতল প্লাস্টিক ভরা জনমানবশূন্য ত্রিপুরার উচ্চতম শৃঙ্গ।অদূরে বক্সে যিশুর নতুন নিয়মের বই ইংরেজী বাংলায়।কেউ পাঠ ও বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পূর্ণ্য অধিকার নিয়ে সাজানো।গোপালদা ও পদ্মশ্রী নিলো দুটো করে বই।
চূড়ায় জাম্পুইযুবতীর সাথে নীলুৎপলের কথা হলো।
টায়ার থেকে তাকালে মিজোপাহাড়।কিছু দিন আগেও নীল নীল লাগতো প্রকৃতি।এখন ধুঁয়াটে।সেই সবুজ নেই।
জাম্পুইমেয়েরা অহেতুক লিপস্টিক লাগিয়ে ঠোঁট রাঙ্গিয়ে রাখে।অথচ তাদের এই সাজ আর পাছড়ার চিরাচরিত সাজ মনোরম লাগে।
বেশ চনমনে তারা নিজের মতো পাহাড়ে এলোমেলো ঘুরাঘুরি করে।বেশ সচ্ছল অর্থনৈতিক বুনিয়াদ দেখা যায়।
অথচ হতদরিদ্রের ছাপও পাহাড়ে লেগে আছে।
এই মিশেল মিজো খাসি দারলং আর বাঙালির ভ্রমন বেতলিংশিব সত্যি এখনো দারুণ। বারবার গেলেও মনে হয় আবার যাই।
ফিরতে হবে।ছবি ক্লিক হলো।
তারপর আবার আমি গাড়িতে উঠি।গৈরিকা আর গোপালদা বাইকে।গাড়ি নামছে ধীর সতর্ক।মাঝে মাঝে গোপালদার জন্য অপেক্ষা।দুপুর তখন বারোটা বেজে ২৫মিনিট।
আমরা অমলের বাসায় একটু ফ্রেস হয়ে অপর্নার বাবার বাসায় যাই।অমিতাভ সিংহ বড়ুয়ার মেয়ে একমাসের হলো।তাই ধর্মীয় আচার শেষে নিমন্ত্রিত অতিথিরার সাথে আমরাও অতিথি। আচার চলছে।আমাদেরও তাড়া।শ্যামলদার জরুরী মিটিং আগরতলায়।খেয়ে আমরা তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠতে গিয়ে পরিচিত হই বৌদ্ধ পুরহিতের সাথে।অমায়িক মানুষ।ত্রিপালি শ্লোক,চট্টগ্রামের অনেক ডিটান উনার মুখে লেগে আছে।
আবার আসবো বলে সবাই প্রণত হই।
গাড়ি ও বাইক ছুটলো কুমারঘাটের দিকে।লালজুরি মাছমারা পেঁচারতল সিদং পং ছড়া অতিক্রম করে হালাইমুড়া আমাদের বাসায় একটু চা পান করে শ্যামলদা বৌদি আর নীলুৎপল সরকারকে টাটা দিয়ে যখন ঘরে এলাম মনে হলো সারা ঘরই শূন্য।
দুদিনের জার্নি আর আড্ডার রেশ তখনও মনের গভীর মানুষকে জাগিয়ে রাখছে।নানাহ কথার আবহ গড়ছে ভাঙছে ভাঙছে গড়ছে
ভেতরে বুনোগন্ধে ম ম করছে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন