![]() |
মৃদুল শ্রীমানী |
১
সেই যে সেই বিধবাদের গল্প বলছিলাম, আর বলছিলাম মায়ের চাইতে মাসির দরদ বেশি কমের কথা ...তো আমাদের গোরা উপন্যাসে সুচরিতা, যার পিতৃদত্ত নাম হল রাধারাণী, যে তার বাপ মা অকালে মারা যেতে ছোটো ভাই সতীশ এর সাথে পিতৃবন্ধু পরেশবাবুর বাড়িতে মোটের ওপর স্নেহে সম্মানে বড় হচ্ছিল, সেই সুচরিতার মাসির কথা বলি।
পরেশবাবু ব্রাহ্ম। কিন্তু তাঁর আচার আচরণে ঋজু সরল ভদ্রতা ছাড়া আর কিছু নেই। শান্ত স্নিগ্ধ সৌম্য মানুষ বললে লোকে যা বোঝে পরেশবাবু মানুষটি তাই। বিপরীতে তাঁর ব্রাহ্মিকা স্ত্রী বরদাসুন্দরী একেবারে জাঁদরেল মহিলা। কোন জিনিসটা ব্রাহ্ম পরিবারে খাটে আর কোনটা খাটে না, এ একেবারে তাঁর কণ্ঠস্থ। তিনি যে পাড়াগেঁয়ে সংকীর্ণ পরিবেশে লেখাপড়ার সংশ্রব না পেয়ে খামোখাই ব্রাহ্ম ভদ্র পরিবারে এসে পড়েছেন, এই বাস্তবতাকে বেশ করে ভুলতে চাইতেন। পরেশবাবু তাঁর স্ত্রীর মেজাজের অন্ধিসন্ধি বেশ জানতেন আর তাঁকে তিনি বিশেষ ঘাঁটাতেন না। গোলমাল থেকে যতটা সম্ভব সাবধানে এড়িয়ে পারিবারিক শান্তিরক্ষা ছিল তাঁর লক্ষ্য।
এই পরিবারে হঠাৎ এসে পড়লেন বিধবা হরিমোহিনী, সুচরিতার আপন মাসি। সুচরিতার এই মাসি মোটের ওপর প্রবীণা। তার উপর শ্বশুরবাড়ি থেকে একরকম বিতাড়িত। এহেন ভদ্রমহিলাকে নিজের ব্রাহ্ম পরিবারে সুচরিতার মুখ চেয়েই আশ্রয় দিলেন পরেশবাবু। ভাবলেন, যত যাই হোক, হিন্দুর ঘরের অসহায় বিধবা, বেচারি যাবেন কোথায় ?
হরিমোহিনীকে পরেশবাবুর বাড়িতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হত। কিন্তু সুচরিতা ক্রমে ক্রমে নিজের মাসির সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক অনুভব করত।
সুচরিতাকে বরদাসুন্দরী বিশেষ দেখতে পারতেন না। তিনি বেশ জানতেন বিয়ের বাজারে যাকে সুন্দরী মেয়ে বলে সেই মাপকাঠিতে সুচরিতা তাঁর পেটের মেয়েদের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে। সেই মনের ক্ষোভে বরদাসুন্দরী কিছুতেই সুচরিতাকে সহজভাবে নিতে পারতেন না। কিন্তু তাঁরই মেয়ে ললিতা সুচরিতাকে অত্যন্ত ভালবাসত। ললিতার ভাষা ছিল শক্ত। সে তার মায়ের অন্যায় আচরণ মেনে নিত না। বরদাসুন্দরী তার এই মেয়েকে বেশ একটু সমঝে চলতেন। ধাক্কাটা গিয়ে পড়ত সুচরিতার ঘাড়ে, আর সেই সূত্রে তার মাসির উপরেও। পরেশবাবু এসব দেখেশুনে সুখের চেয়ে শান্তি ভাল ভেবে সুচরিতার জন্য নিকটেই পৃথক বাড়ি দেখে দিলেন। সে সঙ্গতি অবশ্য সুচরিতার জন্মদাতা পিতা রেখে গিয়েছিলেন। পরেশ ছিলেন তার অছি। নতুন বাড়িতে গিয়ে ক্রমে ক্রমে সুচরিতার বিধবা মাসিটি অন্য রূপ ধরলেন। দুর্বল যদি কখনো ক্ষমতার স্বাদ পায়, সে যে কী হয়ে ওঠে, দেখাতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। একদা দুর্বলের অত্যাচারী রূপ দেখে শঙ্কিত হই।
২
রাধারাণী জানতো সে আর তার সহোদর ভাই সতীশ পিতৃমাতৃহীন। তার পিতৃবন্ধু ব্রাহ্ম ভদ্রলোক পরেশবাবু অত্যন্ত উদার। তিনি পিতৃস্নেহে নিজের সন্তানদের সাথে সমান মর্যাদায় তাদের দুই ভাই বোনকেও পালন করছেন। নানা কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ রাধারাণীর হয় নি। কিন্তু পরেশবাবু নিজের উদ্যোগে তাকে নানা বিষয়ে পুষ্ট করে থাকেন।ছোট ভাইটি স্কুলে যায়।
পরেশবাবু উদার হলেও তাঁর স্ত্রী বরদাসুন্দরী আদৌ উদার নন। বরং তিনি প্রয়াত বন্ধুর সন্তানদুটির প্রতি পরেশবাবুর এই মায়া মমতাকে নিচু চোখেই দেখেন। বন্ধুর অনাথ সন্তানদের প্রতি এই দায়িত্ব পালনকে তিনি বোকামি বলেই বিবেচনা করেন। বরদাসুন্দরী ব্রাহ্মধর্ম বলতে বোঝেন হিন্দুর পৌত্তলিকতাকে প্রাণপণে ঘৃণা করা। কিন্তু এই পৌত্তলিক অভ্যাস ছাড়া হিন্দুয়ানির অন্যান্য বদভ্যাস তিনি নিজের ভিতরে সযত্নে লালন করেন। ধর্মপালন তাঁর মতে কতকগুলি বাঁধা ধরা নিয়ম আর পদ্ধতির অনুবর্তন। নিজের সম্প্রদায়ের বাইরে কোনো সুসভ্য লোক থাকতে পারে এমন ধারণাকে তিনি আমল দেন না। আর যে কোনো কিছু গ্রহণীয় বা মান্য কি নয়, তা বোঝার জন্য ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের আচার অভ্যাসের পক্ষে তা কতটা অনুকূল, সেটাই তিনি একমাত্র বিবেচ্য মনে করেন। তিনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্ম মহিলা হিসেবে রাধারানীকে যথেষ্ট ব্রাহ্ম করে তোলার তাগিদে তার পিতৃদত্ত নাম ছেঁটে সেটাকে সুচরিতা বানিয়ে দিয়েছেন। বাড়িতে ও সমাজে মেয়েটির রাধারাণী পরিচয় লুপ্ত করেছেন। কিন্তু পরেশবাবুকে তিনি এই জায়গায় এঁটে উঠতে পারেন নি। পরেশবাবুকে দেখে ভদ্রতা নম্রতার বাস্তব উদাহরণ মনে হলেও ভেতরে ভেতরে তিনি অত্যন্ত ঋজু। তিনি মেয়েটিকে তার পিতৃদত্ত রাধারাণী নামেই ডাকেন। বরদাসুন্দরী তাকে নানাভাবে হেনস্থা করে চললেও পরেশবাবু তাকে স্নেহভরে "রাধে" বলে ডেকে তার সব কষ্ট ঘুচিয়ে দেন।
একটি ব্রাহ্ম পরিবারে সুচরিতা ও রাধারাণী, এই দুই আলাদা পরিচয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে একটি সুশ্রী মার্জিত মনের মেয়ে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন