নদীয়ার ছেলে ব্রাজিলেল সেনাবাহিনীতে লেফটেনেন্ট
দেবব্রত মন্ডল
(মাত্র সতেরো বছর বয়সে ছেড়েছিলেন দেশ; হয়েছেন ব্রাজিলের সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট - এমনই কাহিনী নদীয়ার যুবকের)
এই কাহিনী বাঙালির এক দুর্ধর্ষ নায়কের।যার হাত ধরে কোনো একসময় বাঙালি পাড়ি দিয়েছিল সপ্তসমুদ্র,যার হাত ধরে বাঙালি এক লহমায় ঝেড়ে ফেলেছিল তার ভীতু কাপুরুষ অথবা চিরাচরিত ঘরকুনো অপবাদকে।তার পরিচয় দেওয়া যাবে তার আগে দুটি ঘটনার উল্লেখ করে নেওয়া যাক।
ঘটনা - ১:- নদীয়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নাথপুর।শেষ বিকেলের রোদ্দুর নব রঙে রঙিন করে তুলেছে গ্রামের মেঠো পথঘাটকে।গ্রাম ছাড়া রাঙা মাটির পথ ধরে ঘরে ফিরছে এক বছর বারোর কিশোর। হঠাৎই পাশের জঙ্গল থেকে ছুটে এলো একটি বন্য শূকর হিংস্র দৃষ্টিতে তেড়ে গেলো সেই বছর বারোর কিশোরের দিকে।তারপর কিছুক্ষণের অসম লড়াই।কাছেই ছিলেন কিছু নীলকর সাহেব।তারা যতক্ষণে ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছেন ততক্ষনে শূকরটিকে মাটিতে ফেলে শরীরের ধুলো পরিষ্কারে ব্যস্ত সেই অসমসাহসী কিশোরটি।
ঘটনা - ২: - মাদ্রাজ তখনও চেন্নাই হয়ে ওঠেনি।পুরোনো দিনের গন্ধ গায়ে মেখে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার নিজস্ব গর্বকে সঙ্গী করে।দিনের মাদ্রাজ রাতের নিয়ণ আলোর রোশনাই কে তার অলঙ্কার করে প্রতিমুহূর্তে যেনো আরও মোহময়ী হয়ে উঠছে।এমন সময় সস্তার এক ধর্মশালা থেকে বেরিয়ে এলো সুঠাম এক যুবক।সকালের ট্রেনেই কলকাতা থেকে মাদ্রাজ এসেছে সে।রাতের অন্ধকারে সুন্দরী মাদ্রাজের রূপ রস গন্ধকে উপভোগ করতে রাস্তায় নেমেছে এই যুবক।এমন সময় পাশের গলিতে শোনা গেলো এক মহিলাকণ্ঠের আর্ত চিৎকার।শোনা মাত্র একছুটে পাশের গলিতে হাজির যুবকটি। অসীম সাহসের পরিচয় দিয়ে একদল আততায়ীর হাত থেকে সে উদ্ধার করলো বিপন্ন মহিলাকে।
উপরের দুটি ঘটনার অবিসংবাদিত নায়ক যিনি তিনি হলেন কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস।ঊনবিংশ শতকের বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষ যখন ঠাকুরবাড়ির হাত ধরে নব চেতনার উন্মেষ ঘটাতে ব্যস্ত যে সময় জন্ম নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের মতো বিরল থেকে বিরলতর প্রতিভা ঠিক সেই সময়ই নদীয়ার এক অজ পাড়াগাঁয়ে জন্ম নিচ্ছেন সুরেশ বিশ্বাস নামক এক অগ্নিস্ফুলঙ্গ।সুরেশের বাবা ছিলেন ছাপোষা চাকুরে অন্যদিকে সুরেশ চিরদিনই ছিল ভিন্ন ধাতুতে গড়া।কিশোর বয়স থেকেই চূড়ান্ত অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় সুরেশের দৌরাত্ম্যে গ্রামের প্রায় প্রতিটি সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন।ফলে কিছুদিনের মধ্যেই একপ্রকার বাধ্য হয়ে নদীয়ার বাস ওঠাতে হলো সুরেশের বাবাকে।কলকাতা এসে ডেরা বাঁধলেন বালিগঞ্জ অঞ্চলে।কিন্তু নতুন শহরটাকে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে একমুহূর্তে আপন করে নিয়েছিল সুরেশ পাশে পেয়েছিল লন্ডন মিশন কলেজের প্রফেসর মি: আটসনকে।মূলত তার উৎসাহেই সুরেশ আরও আকৃষ্ট হয় অ্যাডভেঞ্চারিজমের প্রতি।অন্যদিকে সময় কিন্তু থেমে থাকেনি।কালের নিয়মে সময় সুরেশকে তৈরি করে নিচ্ছিল নিজের মতো করে।একদিকে চাকরির খোঁজ অন্যদিকে দেশ বিদেশের বইপত্র পড়া দুইই চলছিল সমানতালে।তারই সঙ্গে তাল রেখে বাড়ির সঙ্গে পরিবার পরিজনের সঙ্গে সুরেশের দূরত্ব বাড়ছিল ক্রমাগত।দূরত্ব বেড়ে গেলে যোগাযোগ নিভে যায় তেমনই একদিন বাড়ির সঙ্গে সমস্ত নাড়ির টান ছিন্ন করে দেসভ্রমণে বেরিয়ে পড়লো নদীয়ার নেহাত অজ পাড়াগাঁয়ের এক ছেলে সুরেশ বিশ্বাস।
এরপর আমরা চলে যাবো জার্মানির হামবুর্গ শহরে।সময়টা বসন্তকাল,প্রেমের ঋতু।জার্মানির আকাশে বাতাসে তখন নবপ্রেমের সুসংবাদ।ঠিক এই সময়ই জার্মানির হামবুর্গ শহরের একপ্রান্তে একটি মাঠে দেখা মিললো বেশ কিছু তাঁবুর।বসন্তের সমাগমের সঙ্গে সঙ্গে সার্কাসের দলও হাজির তাদের হরেকরকম মজার খেলার পসরা নিয়ে।এখানেই জার্মানবাসী পরিচিত হন এক বাঙালি যুবকের সঙ্গে।যে অভূতপূর্ব দক্ষতায় কাবু করে ফেলছে সার্কাসের ভয়াল সিংহকে এমনকি জার্মানির এই সার্কাসের মধ্যেই খোঁজ মেলে ফ্যানি নামক একটি বাঘের যাকে অদ্ভুতভাবে নিজের বশে রাখতে সক্ষম হন কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস।
তবে শুধু সার্কাস নয় আরও একটি কারণে হামবুর্গ খ্যাত হয়ে আছে সুরেশের জীবনে।এখানেই সে দেখা পেয়েছিল তার প্রেয়সীর।জার্মান তরুণীটি সুরেশের অসীম সাহস দেখেই তাকে মন দিয়ে ফেলেছিলেন কিনা জানা যায়না তবে শেষ পর্যন্ত তাদের প্রথমপর্বের সেই প্রেম পূর্ণতা পায়নি।কারণ জার্মান তরুণীটি ছিলেন সেই সময়কার এক ডাকসাইটে সুন্দরী ফলে পানিপ্রার্থীর অভাব ছিল না তার।তার সেই সমস্ত প্রেমিকরা একনাগাড়ে খুনের হুমকি দিতে থাকে সুরেশকে ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়ে জার্মানি ত্যাগ করে সে,না এবার রেঙ্গুন বা কাছেপিঠের কোনো দেশ নয় সুরেশ পাড়ি জমালো সুদূর ব্রাজিলে।জার্মানি ছাড়ার আগে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে তার উক্তি ছিল : -
" তোমার আমার মাঝে আকাশ পাতাল ব্যবধান।আমাদের বিয়ের সম্ভবনা নেই।পারলে আমায় ভুলে যেও।"
১৮৮৭ সালে ব্রেজিলের অশ্বারোহী বাহিনীর কর্পোরাল পদে অধিষ্ঠিত হলেন সুরেশ বিশ্বাস।১৮৯৩ সালে হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল।এই সময়ই আধুনিক যুদ্ধবিদ্যা পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়ে মাত্র পঞ্চাশ জন সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে ব্রাজিলের সেনা বিদ্রোহকে দমন করেন তিনি।
ঊনবিংশ শতকের বাংলা তথা সমগ্র ভারতের বুকে সাহসিকতার লেলিহান অগ্নিশিখা জ্বেলে দিয়েছিলেন এই বীর বাঙালি সন্তান সুরেশ বিশ্বাস।নদীয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম নাথপুর থেকে ব্রাজিল পথটা সহজ ছিল না কিন্তু তারপরেও তাকে অবলীলায় অতিক্রম করেন এই অগ্নিপুরুষ।আত্মবিস্মৃতিতে জর্জরিত বাঙালি কি তাদের ঘরকুনো বা ভীতুর তকমা ঘুচিয়ে তাদের এই বীরত্বের কাহিনী মনে রেখেছে?
তথ্যসূত্র : - আনন্দবাজার পত্রিকা,২৩ আগস্ট,২০১৬
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন