বন্ধুত্ব : কর্ণধর মন্ডল

কর্ণধর মন্ডল
বন্ধুত্ব

        ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, অতীতের সেই সোনালী শৈশবের হাসী-খুশী মাখা সোনা ঝরা স্কুল জীবনের হারানো দিনের স্মৃতিমেদুর ইতি কথা।যা  কখনো ভোলার নয় ,আর ভোলা যায় না।যা স্মৃতি-রোমন্থনে বার বার মনের দুয়ারে করা'ঘাত করে।আমরা ছিলাম বেশ কয়েক জন সহপাঠী-সতীর্থ বন্ধু।যারা একত্রে সর্বদাই সঙ্গী হয়ে ঘুরতাম,ক্লাসে একই বেঞ্চে বসতাম।অমিত,রজত,তন্ময়,সৌভিক,রনিতা,রুমকি ও সপ্তর্ষি।এদের মধ্যে অমিত ও রজত এরাই দুজনে ছিল সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ।এরা পরস্পর-পরস্পরকে খুব মিস করতো।এদের মধ্যে অমিত ও রজতের পরিবার অন্য বন্ধুদের চেয়ে অস্বচ্ছল।স্কুলে কোন দিন টিফিন নিয়ে যাওয়ার মত সমর্থ ছিল না।মাঝে মধ্যেই একটু আধটু স্কুলে সামান্য দু-এক টাকার কিছু কিনে দুজনেই ভাগা-ভাগি করে খেত।অমিত না স্কুলে গেলে রজত যেত না ,আবার রজত না গেলে অমিতও যেত না।এই রকম অঙ্গাঙ্গীন বন্ধুত্ব ছিল দু'জনের মধ্যে।ক্লাস-'ফাইভ' থেকে ক্লাস-'টেন' পর্যন্ত কেটেছে ,স্কুল জীবন দুজনের একই সাথে।

           কিন্তু রজতের খুব পরিশ্রম করতে হতো।বাবা একা সংসারের বোঝা টানতে টানতে নাজেহাল।তাই সে বাবার হাতে কাজ করতে কাঁধে তুলে নিল পরিশ্রমের বোঝা।চাষ-বাসের সময় এমন কি অবসর সময়ে বাড়ীর যাবতীয় কাজ করতে হতো রজতের।বছরের কোন কোন সময় কাজের সুবাদে মাঝে মাঝে দু-এক সপ্তাহ স্কুল ছুট পর্যন্ত করতে হয়েছে রজতের।অমিত খুব মিস করতো,মনে মনে কষ্ট পেত।কারণ আমাদের বন্ধুত্বটাই ছিল এমন নিবিড়।অন্যান্য বন্ধুদের কাছে খোঁজ খবর নিতো।তাদের কাছে রজত দেখ ভাই আর মাত্র কয়েকটা দিন।তারপর স্কুলে গিয়ে একসাথে ঘুরবো,গল্প করবো টিফিন খাবো।আমার যে কাজ না করলে চলবে না ভাই।এই বলে অমিতকে বোঝাতো।এটা যে ভাগ্যের পরিহাস,একে মেনে নিতে হবে।

          এই ধরুন ক্লাস-''সিক্স''-''সেভেন'' হবে তখন থেকে রজতের সোনালী শৈশব জীবনে জোটে কঠোর পরিশ্রমের বোঝা। তার ফাঁকে পড়াশুনা।এই ভাবে কেঠেছে অমিত ও রজত দুজনের স্কুল জীবনের বন্ধুত্ব পুর্ণ সোনালী শৈশবের  দিনগুলি।

         এর মাঝে অমিত একদিন উদাসীন হয়ে পড়ে।রঙীন স্বপ্নের ডানা মেলে ওড়ার স্বপ্ন জাগে।মনে মনে কাউকে ভালো লেগেছে,তখন ক্লাস-''এইট''এ পড়ে অমিত। হ্যাঁ তার আগে বলি, অমিত ভালো কবিতা আবৃত্তি করতো।আর রজত টুকিটাকি গল্প-কবিতা লেখা লিখি করতো,টুকিটাকি ছবি আঁকতো।এই ভাবে চলেছে অমিত ও রজতের স্কুল জীবনের পড়াশুনা পর্ব।

           একদিন ক্লাসে বাংলা টিচার ক্লাস নিতে এসে জানায়,''পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা দপ্তর কতৃক-নিখিল বঙ্গ শিক্ষা সমিতি''-একটি প্রতিযোগীতার আয়োজন করেছে।সেখানে থাকবে গান,কবিতা আবৃত্তি,গল্প-প্রবন্ধ লিখন ও অঙ্কন প্রতিযোগীতা।যারা নাম দিতে ইচ্ছুক তোমাদের পিটি স্যার বিকাশবরণ মন্ডল মহাশয়ের কাছে নাম নথিভুক্ত করবে।শুনে অমিত ও রজত দুই বন্ধু খুব খুশী।কেননা তারা প্রতিযোগীতায় অংশ নেবে বলে।

           অমিত আবৃত্তি প্তিযোগীতায় নাম দেয় এবং রজত গল্প-প্রবন্ধ লিখনে নাম দেয়।দুজনের মনে খুব কৌতুহল জন্মায়,শুধু সেই দিনের অপেক্ষায়। দেখতে দেখতে সেই দিন উপস্থিত,বিভিন্ন স্কুল থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা উপস্থিত হয়েছে।প্রথমে গানের প্রতিযোগীতা পর্ব শেষ হয়েছে।তারপর আবৃত্তি প্রতিযোগীতা।তারপর গল্প-প্রবন্ধ লিখন প্রতিযোগীতা। তারপর অঙ্কন প্রতিযোগীতার পর্ব শেষ হয়েছে।

          এর পরের অনুষ্ঠান,পুরস্কার বিতরনী পর্ব।মঞ্চে ঘোষনা করছে বাসন্তী ব্লকের ১২ টি বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিযোগীতা মুলক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।তার মধ্যে যেন কোন স্কুলের দুটি ছাত্রী সংগীত প্রতিযোগীতায় ১ম ও ২য় হয়েছেন।আবৃত্তি প্রতিযোগীতায় ১ম হয়েছেন অমিত নস্কর ও দ্বিতীয় হয়েছেন অন্য স্কুলের এক ছাত্র।এরপর গল্প-প্রবন্ধ প্রতিযোগীতার ফলাফল ঘোষনাকরা হবে, তখন আমাদের সবার মনে ধুক ধুক করছে কি হয়,কি হয়।গল্প-প্রবন্ধ প্রতিযোগীতায় ১ম হয়েছেন ''নারায়নতলা রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দির''-এর ছাত্র রজত মন্ডল।তখন তো রজতের খুশীর সীমা নেই।অমিত পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার বই।আর রজত পেয়েছিল শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ''বিপ্রদাস''।সময় কাল ছিল যত সম্ভব ২০০২ সাল।

         এই অনুষ্ঠানে গিয়ে অমিত সেই মেয়েটিকে দেখতে পায়।যাকে ও মনে মনে পছন্দ করতো।কিন্তু কোন মতে কথা বলার সাহস পেল না।প্রতিক্ষা করতে করতে সময় শেষ যে যার বাড়ীতে রওনা দিল।পরের দিন যথারীতি স্কুলে গিয়ে হঠাৎ অমিত সেই মেয়েটিকে দেখতে পায়।মেয়েটিও অমিতের দিকে দেখে,বেশ  কিছুক্ষণ চললো একই ভাবে দুজনের দৃষ্টি বিনিময়।ক্লাসের বন্ধুদের দ্বারা জানা গেল মেয়েটি ক্লাস-''সেভেন''এ পড়ে।অমিত শুধু ঘুরে ফিরে তার কথা বলছে।এই ভাবে সপ্তাহ খানেক যাওয়ার পর রজত অমিতকে জিঞ্জাসা করে কিরে,ভাই তই কি ওই মেয়েটির প্রেমে পড়লি নাকি ? অমিত প্রথমে লজ্জিতবোধ করলেও পরে সায় দেয়।যে মেয়েটির সঙ্গে তার চোখে চোখে আলাপ হয় এবং কখন মনের অজান্তে মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছিল সে নিজেই জানে না।রজত মেয়েটিকে দেখলে ও সেই ভাবে গুরুত্ব দেয়নি।কে বা জানতো অমিত ওকে ভালোবেসে ফেলবে ? কয়েক দিন যাওয়ার রজত প্রিয় বন্ধু অমিতের ভালোবাসার স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য,মৃন্ময়কে জিঞ্জাসা করে যে,ঐ ক্লাস ''সেভেন''এর রুমের সামনে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে ওকে চিনিস ? মৃন্ময় বললো হ্যাঁ ওকে চিনি-তো ।ওর নাম শিপ্রা,আমাদের বাড়ীর কয়েক টি বাড়ীর পর ওদের বাড়ী।এই ভাবে মৃন্ময়ের সাহায্যে রজত,তার বন্ধু অমিতের প্রেমের প্রথম ধাপটা এগিয়ে নিয়ে যায়।

          এই ভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর,মৃন্ময়ের সহযোগীতায় শিপ্রার সঙ্গে অমিতের আলাপ হয়।এই ভাবে দুজনের মধ্যে বেশ কিছু দিন কথা বার্তা চলতে থাকে।একদিন হঠাৎ অমিত মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়।মেয়েটি প্রথমে লজ্জায় কিছু বলতে পারেনি,কিন্তু পরে সায় দেয়।তারপর থেকে দুজনের মধ্যে প্রেমের পর্ব শুরু হয়।এই ভাবে প্রায় দেড় বছর কেটে যায়।তারপর একদিন অমিত ও শিপ্রা দুজনের সুখের মাঝখানে বিষাদময় তমসাঘন ছায়া নেমে আসে।শিপ্রার বাড়ীর লোক জেনে যায়।অমিতকে  নিয়ে শিপ্রার বাড়ীতে অশান্তি শুরু হয়ে যায়।
              কারন,শিপ্রার বাবা ছিল প্রতিপত্তিবান ধনীলোক,কাপড়ের ব্যবসায়ী।আর অমিত ছিল সাধারন গরীব পরিবারের ছেলে।তাই শিপ্রার বাবা কোন মতেই দুজনের প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিলো না।ধীরে ধীরে অমিত ও শিপ্রার প্রেমময় সম্পর্কের দুরত্ব বাড়তে বাড়তে এক সময় যোজন যোজন মাইল দুরত্ব ছাড়িয়ে গেল।দুজনের প্রেমের প্রণয় পরিনতির শেষ সমাপ্তি ঘটলো না।ওর বাবা জোর করে স্কুল ছাড়িয়ে দিল।অমিত খুব ভেঙে পড়ে।রজত অনেক বোঝাতে চায় ।কিন্তু কিছুতেই অমিত মনে প্রাণে মেনে নিতে পারছে না।পরে একদিন মৃন্ময়ের কাছে খবর নিয়ে জানা যায় ওর বিয়ের ঠিক করে ফেলেছে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে ।ছেলেটি নাকি ব্যবসা করে।সবি ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস।রজত অনেক বুঝিয়ে বন্ধুত্বপুর্ণ ভালোবাসার সংস্পর্শে ,ধীরে ধীরে অনেক ব্যথা-বেদনার মধ্য দিয়ে অমিতকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনে।
    
         তারপর কয়েক মাস পর অমিত ও রজত দুজনে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়,সময় কাল ছিল ২০০৪ সাল।তারপর অমিত পড়াশুনা বন্ধ করে দেয় আর বাড়ী থেকে কোন রকম আগ্রহী না থাকার জন্য স্কুল জীবনের পড়াশুনা পর্ব শেষ করে দিল।

           রজত কোন প্রকারে কাজকর্ম করে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়।আর অমিত উপার্জনের তাগিদে প্রাইভেট টিউশন করতে লাগলো।অমিত ও রজতে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য দুজন দুজনের বাড়ীতে আসা যাওয়া হতো।এরপর রজত উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর,পারিবারিক সমস্যার কারনে রজতের জীবন থেকে পড়াশুনার পরিসমাপ্তি ঘটে।এবং ভাগ্যের পরিহাসে বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য হতে হয়, মায়ের অসুস্থতার কারনে।অমিতকে জানানোর সুযোগ হয়নি।পরে খবর পেয়ে এসেছিল রজতের বাড়ী।আজো দুজন দুজনের বাড়ীতে আসা যাওয়া হয়।বেশ কয়েক বছর পর অমিত বিয়ে করে।

             এখন অমিত ও রজতের দাম্পত্য জীবন বেশ সুখের।রজতের একটা ছেলে আর অমিতের একটা মেয়ে।অমিত এখন প্রাইভেট টিউশন করার পাশাপাশি একটা সোসাইটির কর্মধ্যক্ষ।এখন অমিত একজন স্বাধীন ব্যক্তি।আর রজত অস্থায়ী পদের সরকারী কর্মী।কিন্তু রজতের ধ্যান'ধারনা-স্বপ্ন একটাই লেখালিখি।গল্প-কবিতার মধ্য দিয়ে নিজের মনের ভাবনাকে সবার সামনে বিলিয়ে দেওয়া একমাত্র নেশা ও পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে।

           কিন্তু,স্কুল জীবনের বন্ধুত্ব আজো অমিত ও রজতের মধ্যে অটুট রয়েছে।সংসারিক ব্যস্ত জীবনের ওঠা পড়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া আসা একটু কম হলেও ফোনের মাধ্যমে দুজনের মধ্যে সাক্ষাৎ সব সময় হয়।আমিও চাই অমিত ও রজতের মতো আন্তরিকতা পুর্ণ বন্ধুত্ব সবার মধ্য গড়ে উঠুক।

         এই রকম  স্কুল জীবনের মতো নিঃস্বার্থপুর্ণ বন্ধুত্ব প্রত্যেক মানুষের জীবনে,আনন্দময় ও প্রেরণাদায়ক ইতিহাস হয়ে থাকুক সবার জীবনে। দৈনন্দিন চলার পথে.........
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.