ড্রয়ার ভর্তি হাহাকার : মাসুদ সুমন

 মাসুদ সুমন
ড্রয়ার ভর্তি হাহাকার

নানা বাড়ি আর আমাদের বাড়ি পাশাপাশি। একদিন দুপুর বেলা নানা বাড়ি থেকে ভাইয়া আর আমি এসে দেখি আমাদের বিছানাপত্র সব উঠানে ফালানো। বেশকিছুদিন থেকেই কানাঘুষা চলছিল আমাদের আলাদা করে দেয়া হবে। আব্বা চাকরি-বাকরি কিছু করেন না। আগে জমি-জিরাত দেখাশুনা করতেন। এখন তাও করেন না। সারাদিন পড়ে থাকেন ভিলেজ পলিটিক্স নিয়ে। এবার আবার মেম্বারি নির্বাচন করলেন। নির্বাচন মানেই টাকা-পয়সার খেলা। হালার জনগণের এমন খাই-খাই অভ্যাস, নির্বাচন আসলে ফাউ চা আর আকিজ বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ার নেশায় চা-দোকানের আড্ডা রাত দশটা বেজে গেলেও ভাঙতে চায় না। কেন্ডিডেটদের এইসমস্ত চা-দোকানদারদের সাথে নির্বাচনকালিন সময়ে আলাদা হিসাবের খাতা খুলতে হয়। তিন গ্রামের (তখন বর্তমানের তিন ওয়ার্ড মিলে এক ওয়ার্ড ছিল) বিভিন্ন ক্লাব-মসজিদ-মন্দিরে চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া নির্বাচনী প্রচারণা খরচ তো আছেই। নির্বাচনের আগের রাতে ভোটারদের টাকা দিয়ে বুক করে রাখতে হয়। এইসব কিছু করেও আব্বা ফেল করে বসলেন। নির্বাচনে হারার পরপরই বাড়িতে রব উঠল আব্বা সব নষ্ট করে ফেলতেছেন। দাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তি দুই হাতে উড়াচ্ছেন। তাই আমাদের আলাদা করে দেয়া হবে। কিন্তু মেজ চাচাকে রাজি করানো যাচ্ছে না। তার কথাÑ আমার ভাই তার বাপের জমি নষ্ট করে তাতে কার কী? বড় ফুপা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, আরে গাঁধা তার বাপের জমি তোর বাপের জমি না? মেজ চাচা বলেন, এর লাইগ্গা আলাদা করা লাগবে ক্যান? ‘অরে জুদা কইরগা দিলেই দ্যাহা যাইবে ‘ও’ ঠিক অইয়া গ্যাছে। সংসার কী জিনিষ ‘ও’ হেইডা বোঝে? জুদা কইরগা দিলে সংসারের চাপ ঘারে পরবে, তহন বাইধ্য য়োইয়াই ঠিক য়োইয়া যাইবে।’ মেজ ফুপা বলেন, হ দুলাভাইতো কারেট কতাই কইছে। ফুপুরাও সায় দেয়। তখন বড় ফুপা দাদীর দিকে তাকান, আম্মায় কী কন? দাদী পানের কৌটা থেকে পান বের করে মুখে পুরতে পুরতে বলেন, তোমরা সবাই মিলগা যেডা ভালো মনে করবা হেইডাই করো।

আমরা তখন নতুন বাড়িতে কেবল আসছি। আব্বা-মা আর দুই ভাই মিলে আমাদের ছোট সংসার। সেই সংসারে ভীষণ টানাটানি। আমরা ছোটরা অবশ্য টানাটানি বুঝতে পারি না। কারণ ভাতের কষ্ট আমাদের করতে হয় না। তবে আমাদের চারিদিকে যে একটা অভাব ঝুলে আছে সেটা বুঝতে পারি। পুরান বাড়িতে আমরা খাটে ঘুমাতাম। নতুন বাড়িতে ঘুমাতে হয় মাটির বিছানায় হোগলা বিছিয়ে। খেতে বসে দেখা যায় আমাদের পর্যাপ্ত প্লেট নাই। প্রথম যেদিন নতুন বাড়িতে আসি সেদিন দুপুর বেলা আমরা কলাপাতায় করে ভাত খেয়েছিলাম। সেটা দেখে পাশের বাড়ির এক ফুপু দুইটা প্লেট দিলেন। এখন অবশ্য এসবের অভাব কমেছে। কিন্তু আমাদের সমস্যা ভিন্ন। পুরান বাড়ি দক্ষিণ কান্দি। আর নতুন বাড়ি হলো উত্তর কান্দি। উত্তর কান্দির পোলাপানের সাথে এখনও আমাদের খাতির জমে ওঠে নাই। আমাদের বন্ধু-বান্ধব সব দক্ষিণ কান্দি। দুপুর বেলা পড়ার টেবিলে বসে আমরা উশখুশ করি। আমাদের মন পড়ে থাকে দক্ষিণ কান্দির দিগন্ত জোড়া মাঠ আর বিভিন্ন ঝোপ-ঝাড়ে। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি, মা কখন ভাতঘুম দিবেন। মা ঘুমালেই পা টিপে টিপে বের হয়ে দক্ষিণ কান্দি যাই। ভাইয়া আর আমি পিঠাপিঠি। আমাদের ভিতরে যেমন গলায় গলায় ভাব তেমন আবার অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হাতাহাতি হতে সময় লাগে না। আব্বা একটা কালো রংয়ের হাতঘড়ি এনেছেন। ঘড়িটা দেখতে এত সুন্দর! আমি সেটা কিছুতেই ভাইয়াকে দেব না। আর সে-ও নাছোড়বান্দা। শেষমেষ মা এসে বললো, এইডা মিতুলরে দে। তুই হাইস্কুলে ওডলে তোরেও এইরকম এট্টা কিন্না দিমু। ভাইয়া আমার তিন ক্লাশ উপরে পড়লেও আমরা সারাক্ষণ একসাথে থাকি। একারণে গ্রামের পোলাপান আমাদের দেখলেই ছড়া কাটেÑ

মিতুল শিমুল দুই ভাই
পতে পাইল মরা গাই
শিমুল কয় খাইয়া যাই
মিতুল কয় মার লাইগ্গা লইয়া যাই।

আমি আর ভাইয়া ফুটবল আনতে পুরান বাড়িতে গিয়েছি। ফুপাতো বোনরা ফ্রক পড়ে মস্ত বড় উঠানে দৌড়া-দৌড়ি করছে। পাকের ঘর থেকে ফুপুদের হাসির আওয়াজ আসছে। রান্নার ঘ্রাণে বাতাস ম-ম করছে। ভাইয়া বললো, আমি উঠানে খারাই তুই যাইয়া বল লইয়ায়। বারান্দার খাটে ফুপাতো দুলাভাইরা আর ফুপাতো বোনরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। আমার দিকে তারা কেউ খেয়াল করল না কিংবা খেয়াল করলেও পাত্তা দিল না। আমি ভেতরের ঘরে গিয়ে মেজ চাচীকে জিজ্ঞেস করলাম, কাকি ছোড কাকায় বলডা কোতায় রাকছে কইতারেন? চাচী বললো, খাডের তলায় রাকছে মনে অয়! আমি হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলা থেকে ফুটবল নিয়ে বের হলাম। মেজ ফুপুকে তখন দেখা গেল এক গামলা মোরগ পোলাও হাতে ঘরে ঢুকলেন। গামলা থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছে। একটা চমৎকার ঘ্রাণ নাকে এসে ঝাপটা দিল। মেজ ফুপু গামলা নিয়ে জামাইদের কাছে গেলেন। আমি ফুটবল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো, হেবি রান্ধা-বারা অইতে আছে মনে অয়? আমি বললাম, হ মোরগ পোলাউ রানছে। ভাইয়া বললো, তোরে কেউ দ্যাহে নাই?
: হ দ্যাকছে।
: তোরে খাইতে হাদলো না?
ভাইয়ার কথায় আমার চোখ দিয়ে প্রায় পানি চলে এলো। আমি বললাম, না। মাজা ফুভু গামলা লইয়া আমার সামনে দিয়া গেল। আমারে ইট্টু হাদলোও না। ভাইয়া বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে হাটলেন। তারপর বললেন, শিমুল, এইগুলা বুঝি মা’র ধারে ক’ছ? মা’য় হোনলে কষ্ট পাইবে। আমি বললাম, আচ্ছা কমু না। কিন্তু সন্ধ্যা বেলা বাড়িতে এসে মায়ের কাছে আমি সব বলে দিলাম। মা আমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। তারপর পাশের বাড়ির ফুপুকে ডেকে বললেন, লতা তুই ইট্টু অগো লইয়া বয়। আমি আইতেআছি। আমাদের নতুন বাড়িটা বেশ জংগলা জায়গা। চারপাশ ঝোপঝাড়। সন্ধ্যার পরই কেমন গা ছমছম করে। ঘন্টা দুই পরে পাটখড়ি দিয়ে বানানো মশাল হাতে মা ফিরে এলেন। সাথে মায়ের চাচাতো বোন রঙ্গিলা খালা। রঙ্গিলা খালার কাঁখে সিলভারের পাতিল। পাতিলে পোলাও চাল। অন্যহাতে একটা মোরগ। মা লতা ফুপুকে বললেন, লতা যাইছ না। রঙ্গিলারে লইয়া চুলাহালে যা। যখন রান্না শেষ হলো আমি আর ভাইয়া দুজনেই তখন ঘুমে বিভোর। রঙ্গিলা খালা আমাদের ডেকে তুললেন, শিমুল, ও বাজান ওডো, ও মিতুল! আমরা চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে ঘুমঘুম চোখে মোরগ-পোলাও খেলাম।

কিছুদিন পর বড় মামা এসে ভাইয়াকে খুলনা নিয়ে গেলেন। বড় মামা একটা পাট কোম্পানিতে চাকরি করেন। বড় মামা বললেন, মিতুলরে আমি নিয়া যাই। এইখানে থাকলে অর পড়াশোনা হইবে না। গ্রামের পোলাপানের লগে সারাদিন টো-টো কইরা ঘুইরা বেড়াবে। মা ক্ষীণ গলায় বললেন, দেখি অর বাপের লগে আলাপ কইরগা। আব্বা প্রথমে খানিকটা আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। ভাইয়া যেদিন খুলনা গেলেন আমি আর মা তাকে বাসে উঠিয়ে দিতে টেকেরহাট পর্যন্ত গেলাম। আমরা বাসের জন্য কাউন্টারে অপেক্ষা করছি। মা ভাইয়ার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, খুলনা গিয়া দুষ্টামি করবি না। মামার কথা সবসময় শুনবি। ঠিকমত পড়ালেখা করবি। ভাইয়া লোকজনের সামনে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ায় সম্ভবত লজ্জা পাচ্ছেন। সে মাথা নিচু করে হু হা করে যাচ্ছে। আর মাথাটাকে সরানোর চেষ্টা করছে। খুলনার বাস আর আসে না। আমি মনে মনে অধৈর্য্য হয়ে উঠলাম। আমার মন পড়ে আছে দক্ষিণ কান্দি, যেখানে খালেক-জব্বার-হাবলু-মিন্টুরা মার্বেল খেলছে। মামা আমাদের জন্য তিলের খাজা কিনে আনলেন। তিলের খাজা খেতে খেতে খুলনার বাস চলে আসল। মামা আর ভাইয়া তাদের ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠে গেলেন। মা ভাইয়াদের বসার জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভাইয়া জানালার পাশে বসেছে। সে আমাকে ডাক দিল, শিমুল! আমি কাছে যেতেই ভাইয়া তার হাত থেকে কালো রংয়ের ঘড়িটা খুলে বললেন, নে এইডা রাক। এইডা তোরে দিলাম। আমি হাত বাড়িয়ে ঘড়িটা নিলাম আর তখনই বাসটা চলতে শুরু করল। হঠাৎই আমার মনে হল ভাইয়া আমাকে ছেড়ে চলে গেল! বাসটার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললাম। মা আমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল মা আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছছেন।

ভাইয়া খুলনা চলে যাবার পর ভাইয়ার কথা আমার বেশ মনে পড়তে লাগল এবং এতো খারাপ লাগতে লাগলো যে আমি প্রায়ই নদীর পাড়ে গিয়ে একা একা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। অথচ ভাইয়া যখন বাড়িতে ছিলেন প্রায়ই তার সাথে এটা-সেটা নিয়ে মারামারি বেঁধে যেত। বেশিরভাগ সময়ই আমি ভাইয়াকে আৎকা একটা ঘুষি মেরে নিজের চেয়ারে এসে চিৎকার দিয়ে উঠতাম, মা দ্যাহো ভাইয়া আমারে মারে...। একবার ভাইয়া আব্বার সাথে শহরে আব্বার এক বন্ধুর বাড়িতে গেছে। আমার জ্বর। তাই আমি যেতে পারলাম না। ফিরে এসেই ভাইয়া আমার কাছে এলেন, ফিসফিস করে বললেন, শিমুল হা কর। আমি হা করলাম। ভাইয়া আমার মুখের ভিতরে একটা খাবার গুজে দিল। এমন নরোম আর মিষ্টি যে জ্বর মুখেও চমৎকার লাগল। ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো, কী ফাইন না! আমি বললাম, হ ফাইন। আনলেন ক্যামনে? ভাইয়া বললেন, খাইতে খাইতে টপ কইরগা পকেটে ঢুকাইয়া হালাইছি।
: কেউ দ্যাহে নাই?
: না।
এইসমস্ত অসংখ্য ছোট ছোট স্মৃতি মনে পড়ে আর আমার বুকের ভিতরে ভাইয়ার জন্য কেমন একটা করে ওঠে।

সামনেই কোরবানির ঈদ। আমি অপেক্ষায় থাকি কবে ঈদ আসবে। ঈদের ছুটিতে ভাইয়া বাড়ি আসবে। ঈদের তিন দিন আগে ভাইয়া বাড়িতে এলেন। সন্ধ্যা বেলা পড়ার টেবিলে বসে পড়ছি। হঠাৎ ভাইয়ার কন্ঠÑ শিমুল, দরজা খোল। দরজা খুলে ভাইয়াকে দেখে আমার এতো ভালো লাগলো যে আমার চোখ ভিজে উঠলো। ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সে-রাতে আব্বা, মা, আমি আর ভাইয়া মিলে অনেক রাত পর্যন্ত আমাদের ছোট্ট উঠানে মাদুর বিছিয়ে গল্প করলাম। বাইরে বেজায় হাওয়া। ফিনফিনে জোছনায় সাড়া উঠানে বিশুদ্ধ-মায়া ঝরে ঝরে পড়ছে। আব্বা বললেন, রাত অনেক হইছে। এইবার সবাই ঘুমাইতে চল। কেন জানি না এই রাতটা আমার এতো ভালো লেগেছিল। আমার খুব মন খারাপ হলে এই রাতটার কথা মনে পড়ে যায়। আমার চোখের সামনে উঠানের ভেন্না গাছের পাতাগুলো বাতাসে দোল খায়। আর আমি হাত বাড়ালেই উঠোন ভরা জোছনা মুঠি করে ধরে ফেলব। অথচ আমরা কত বদলে গেছি। আমাদের ছোট্ট উঠান। বাড়ির চারপাশের ঝোপ-ঝাড় কোথাও সেই মমত্বময়ী ছায়া নেই। শুধু জমে উঠছে ড্রয়ার ভর্তি হাহাকার।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.