সুখ বন্ধন : সোনালী মুখার্জী

সোনালী মুখার্জী
সুখ বন্ধন

সকালের  চা টা নিয়ে মিতা টেবিলের ওপর  রাখে .. খাটের দিকে তাকিয়ে দেখে অরুন আর ওদের তিনবছরের ছোট্ট মেয়ে দিয়া দুজনে দুজন কে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে ..
ডাকার ইচ্ছে না থাকলেও অফিস এ লেট হয়ে যাবার ভয় আলতো করে হাত দিয়ে ঠেলা মারে মিতা অরুন কে ...অরুন জেগে যায় ..মেয়েকে সাবধানে সরিয়ে উঠে বসে ..তারপর চায়ে চুমুক দেয় ...
স্ত্রী র দিকে তাকায় মুগ্ধ দৃষ্টিতে ..বলে ..সত্যি মিতা ..সকালে উঠে তোমার হাতের এই চা টা না আমাকে সারাদিন তরতাজা রাখে ..মিতা সামান্য হাসে ..বলে আচ্ছা ..বৌয়ের চায়ের গুণগান আর করতে হবে না ..গত 5বছর ধরেই তো করছো ?এখন উঠে রেডি  হও ..আমি তরকারি  চাপিয়েছি ..বলে মিতা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় ..
প্রায় মিনিট পনেরো পর মিতা দেখতে আসে ..অরুন রেডি হলো কিনা ..দেখে পাশে চায়ের কাপ টা রেখে অরুন চুপ করে বসে আছে ..
মিতা বলে ..কি গো ?এখনো স্নানে যাওনি ?দাড়ি কামাবে .স্নান করবে ..ব্রেকফাস্ট করবে ..দেরি হয়ে যাবে তো ..
অরুন ..আসলে মিতা ..সকাল থেকে শরীর টা যেন কেমন করছে ..ভালোলাগছে না কিছু ..
মিতা ..সে কি গো ??জ্বর হয়নি তো ?এই সময় টা ...
অরুন ..না না তেমন কিছু নয় ..বুক টা একটু চাপ চাপ লাগছে ..মনে  হয় কালকে রাতে চাপা অম্বল হয়ে গেছে ..তুমি এক কাজ করো ..একটা এন্টাসিড রাখো ..আমি স্নান সেরে আসছি ..খেয়ে নেবো ..
মিতা ..আজ কি অফিস না গেলেই নয় ?শরীর টা যখন ভালো নয় ..
অরুন ..না না অসুবিধা হবে না গো ..আর আজ একটা ভাইটাল মিটিং আছে ..ওটার জন্য যেতেই হবে ..ও তুমি চিন্তা কোরো না ..ফেরার পথে Dr  মুখার্জী কে একবার দেখিয়ে আসবো ..ওকে? ?বলে অরুন তৈরী হবার জন্য উঠে  পড়ে ..
বেলা 9.30 এ অরুন অফিস এ বেরিয়ে যায় ..মিতা বার বার বলে দেয় আসার পথে যেন ডাক্তার দেখিয়ে আসে ..অরুন ও বলে ও অবশ্যই ডাক্তার  দেখিয়েই ফিরবে ..
অরুন চলে যাবার পর মিতা মেয়ের পাশে এসে বসে ..মেয়ে  তখনো ঘুমোচ্ছে ..মেয়ের মাথার চুল গুলো  আলতো হাতে সরিয়ে দেয় সে ..কি মিষ্টি দেখতে হয়েছে মেয়েটা ..একটুকরো চাঁদ যেন তার  ঘরে জোৎস্নার আলো ফেলেছে ..নিজেই নিজের মন কে শাসন করে ..না ..এভাবে নিজের মেয়ের সৌন্দর্য মায়েদের দেখতে নেই ..
ও ভাবে .. এত সুন্দর নাতনি কে দেখেও তার ঠাকুমার মন. গললো না ..শুধুমাত্র অনাথ মিতা কে অরুন ভালোবেসে বিয়ে করার দায়ে সমস্ত সম্পত্তি টাকা পয়সা বাড়ি থেকে তাদের বিতাড়িত করেছেন তার শাশুড়ি মা ..মিতা না গেলেও দিয়া কে নিয়ে অরুন বার কয়েক মায়ের কাছে গেলেও উনি ফিরেও তাকান নি ..ছেলে বা নাতনির দিকে ..তিনি দেশের বাড়িতে ছোট ছেলে বরুন কে নিয়েই থাকেন ..
মিতা মেয়েকে জাগিয়ে আদর করে ওকে ফ্রেস করিয়ে খাইয়ে খেলনা দিয়ে বসিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে ..
দেখতে দেখতে 12 টা বেজে যায় ..এই সময় পাশের বাড়ির বিন্তি রোজ এসে দিয়া কে নিয়ে যায় ..দিয়া ও ওর এই পাতানো পিসিমনির  কাছে থাকতে ভালোবাসে ..তাই ওকে খাইয়ে  বিন্তির সাথে পাঠিয়ে দিয়ে এই টাইমটায় বাকি কাজ সেরে স্নান করে খেয়ে দিয়া কে এনে ঘুম  পাড়ায় ..

আজ ও বিন্তি দিয়া কে নিয়ে চলে যাবার পর মিতা ভাবে একবার অরুন কে ফোন করবে ..ফোনটা রিং করে ..বাজতে থাকে ..
মিতা ..হ্যা ..হ্যালো ??অরুন ?
অরুন ..হ্যাঁ ..বলো মিতা .. এবার মিটিং এ ঢুকবো ..
মিতা ..ও ..খেয়েছো ?কিছু ?
অরুন ..না গো ..শরীরটা একদম চলছে না ..কি হলো বলো তো ??বুক টা যেন বড্ডো চাপ লাগছে ..
মিতা ..মিটিং টা কি না করলেই নয় ?তুমি একবার দেখো না  বলে ?
অরুন ...আ ...মা ..র ... ঘা . . ..ড় ..টা ..যে ..ন .....
মিতা ...অরুন ??অ....রু....ন ....কি হলো তোমার ??এই অরুন ??কি হলো ??কথা বলছোনা কেন ??এমন গোঁ ..গোঁ ..আওয়াজ করছো কেন ??অ.....রু.......ন ....
মিতা শুনতে পায় ফোনের ভিতর নানা কথোপকথন ..ফোনটা কানে চেপে ধরে বসে পড়ে সে ..বুঝতে পারে অরুন কথা বলতে বলতে চেয়ার থেকে নিচে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে ...মিতা পাগলের মতো ফোনে চিৎকার করতে থাকে ..কিন্তু কেউ অরুনের ফোন টা তোলে না ..
কিছুক্ষন পরে কেউ একজন ফোনটা তোলে ..বলে ..হ্যালো ??
মিতা ..কে বলছেন ?অরুনের কি হয়েছে ?একটু বলুন না ...চিৎকার করে ওঠে মিতা ..
ওদিক থেকে ভেসে আসে ..আপনি একটু শান্ত হন ..মিসেস সেন ..আমি তমাল বলছি অরুনের কলিগ ..কথা বলতে বলতে অরুন হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে যায় ..ওকে নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ..আপনি  এক্ষুনি চলে আসুন ..আমার মোবাইল নম্বর আর ঠিকানা টা লিখে নিন ..মিতা তাড়াতাড়ি সমস্ত লিখে নেয় ..তমাল বলে ..be steady..মিসেস সেন ..আপনি শক্ত হন ..চলে আসুন ..
ফোনটা রেখে মিতা কোনোরখমে  নাইটি টা ছেড়ে শাড়ি টা পড়ে  নেয় ..দরজায় তালা লাগিয়ে বিন্তি কে সমস্ত টা বলে দিয়া কে ওর কাছে রেখে ও নার্সিংহোম এর  উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ..
মিতার মনে  হয় এক একটা মুহূর্ত যেন এক একটা  যুগ ..কিছুতেই মন কে শান্ত রাখতে পারে না ..কি করবে ও ??অরুন যদি পাশে না থাকে কোথায় কার কাছে দাঁড়াবে ও ??সেই মুহূর্তে মিতার মনে নানা কুচিন্তা ঘুরতে থাকে ..আবার ভাবে ..কিছু হবে না অরুনের ..ও ভাবে ..কেন ওকে সকালে যেতে দিলো ?কেন dr দেখাতে সকালেই বললো.. না ??নানা চিন্তা করতে করতে অটো নার্সিং হোমের
সামনেএসে দাঁড়ালো ..দৌড়ে নেমে মিতা ভিতরে ঢুকলো. ..তমাল কে ফোন করলো. ..
হ্যা ..লো ??হ্যাঁ হ্যাঁ ..চলে আসুন. দোতলার 3নং ঘরে ..হ্যাঁ ..হ্যাঁ ...ICU তে ..মিতা পৌঁছে যায় কয়েক সেকেন্ড এ ..হ্যাঁ ..dr ভিতরেই আছেন ..সকলে বাইরে অপেক্ষা করছে ..তমাল বলে .মিসেস সেন ..আপনি ভিতরে যান ..ডক্টর আপনি এলে ভিতরে যেতে বলেছেন ..মিতা ভিতরে যায় ..দেখে অরুন মাঝে মাঝে ঘাড়  টা নাড়াচ্ছে ..আর কোনো মুভমেন্ট নেই ..মিতা আস্তে ডাকে ..অরু ?
খুব আস্তে চোখের পাতা টা নড়ে ওঠে ..dr.ওনাকে বাইরে আসতে বলেন.. মিতা dr.এর সাথে বাইরে আসে ..বন্ধুদের মধ্যে আর একজন কে আসতে বলেন...মিতা আর তমাল যায় ড: এর চেম্বারে ..
ড :বলেন.. দেখুন ..আমি আপনাদের কি বলবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না ..ওনার হার্টএটার্ক হয়েছে ..আর ওই সময় মাথায় রক্ত উঠে হঠাৎ মাথার শির ছিড়ে গেছে ..ভিতরে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে ..সব টা আমাদের হাতের বাইরে ..অপরেশন করার জন্য যে সময় টার প্রয়োজন সেটাও আর নেই ..কিচ্ছু করার নেই আর ..I am hopeless .
মিতা শক্ত হাতে চেয়ার এর হাতল টা ধরে বসে থাকে ..তার পর ধীরে ধীরে উঠে ICU এর দিকে এগিয়ে যায় ..চোখের সামনে তাদের রঙিন দিনগুলো একটা একটা করে সরে সরে যায় ..পায়ে পায়ে ঘরে ঢোকে সে ..দেখে চোখ বুজে শুয়ে আছে অরুন ..ও ডাকে ..অরু ??কোনো সাড়া পায় না
আবার ডাকে ..খুব কষ্টে অরুন চোখ খোলে ..মিতা কে দেখে ..যেন ওকে দেখার জন্যই এতক্ষন প্রাণ টা বেড়োতে  পারে নি ..চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ..কি যেন বলতে চায় ঠোঁট নেড়ে ..
না ..আর বলা হলো না ..ঘাড় টা হেলে যায় ..অরুন সাড়া জীবনের মতো চোখ বোজে ..

এর পর মিতা কি ভাবে বাড়ি ফিরেছিল ..কে ওকে এনেছিল ..কিছুই ওর মনে নেই ..ও ঘরের এক কোনে খাটের হাতল ধরে বসে আছে ..অরুনের ডেডবডি আনা হয়েছে .বাড়ি ভর্তি লোক জন.. ..ওর শাশুড়ি ছেলের বুকের ওপর শুয়ে আছাড়  কাছার খাচ্ছে ..আর  বৌ কে গালমন্দ করে যাচ্ছে ..ওকে বিয়ে করার জন্যই ছেলের .এতোবড়ো ক্ষতি হয়ে গেলো ..এটাই উনি কাঁদতে কাঁদতে সবাই কে জানাচ্ছেন .. ওর দেওর মা কে সামলাচ্ছে ..
মিতা যেন নিস্তব্ধ ..নির্বাক ..চোখে একফোঁটা জল নেই ..কিছুতেই মিতা কাঁদতে পারছে না কেন ??ওর মন শুন্য অনুভূতিহীন.. হয়ে পড়েছে ..পাশাপাশি অনেকেই ওকে কাঁদানোর অনেক চেষ্টা করছে ..কিন্তুকিছুতেই মিতা কাঁদতে পারছে না ..সকলে বলছে না কাঁদলে ওর মানসিক ক্ষতি হতে পারে ..মিতা নির্বিকার ভাবে বসে আছে চুপ করে ..সেই মুহূর্তে বিন্তি আসে দিয়া কে কোলে করে .. আস্তে দিয়া কে কোল  থেকে  নামায় ..বলে যাও তো সোনা ..গিয়ে মাম্মাম এর গলা টা জড়িয়ে ধরো ..বলে সকলকে বলে ..সবাই চলো ..আমরা একটু বাইরে যাই ..বৌদি একটু একা থাকুক ..মেয়ে কে নিয়ে ..সকলে বাইরে চলে যায় ..হতবম্ভ দিয়া কিছুই বুঝতে পারে না ..তার  বাপি বাইরে শুয়ে ..ঠাম্মা  ওভাবে  কাঁদছে . এতো লোক বাড়িতে ..মাম্মাম  এমন করে বসে ...ও পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে ..তখন ই স্তম্ভিত ফেরে মিতা র ..মেয়েকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে ..তার বুকফাটা কান্নায় সকলের চোখেই জল এসে যায় ...

একটু একটু করে সময় এগিয়ে চলে ..অরুনের কাজ কর্ম ভালোভাবেই  মিটে যায় ..অফিসের কলিগ রা ..বিশেষ করে তমাল সব কিছুতে ওদের পাশে থাকে ..দেখতে দেখতে এক মাস কেটে যায় ..মিতা অনেক টা শোক কাটিয়ে উঠেছে ..যে যাবার সে তো চলে গেলো ..কিন্তু দিয়া ??ওর জন্য তো ওকে থাকতে হবে ..বাঁচতে হবে ..ওকে মানুষ করতে হবে ..মন টা শক্ত করে সে ...
আরো একটা মাস কেটে যায় ..অরুনের অফিস এই যাতে মিতার চাকরি টা  হয় ..সকলে সেই চেষ্টা করে ..যদিও অরুনের মা তার ছোট ছেলের জন্য সুপারিশ করেছিলেন ..তার জন্য অনেক চেষ্টাও করেছিলেন ..কিন্তু অফিস কর্তৃপক্ষ সমস্ত বিচার বিবেচনা করে চাকরি টা মিতা কেই দেন ..এবং সেই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই মিতা চাকরিতে জয়েন করে ..
দেখতে দেখতে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সব কিছু সামলে উঠলো মিতা ..ওকে বাঁচতে হবে ..মেয়েকে মানুষ করতে হবে ..ওকে সুন্দর  জীবন উপহার দিতে হবে ..হ্যাঁ ....একজন সর্বদা ছায়ার মতো ওদের পাশে রইলো ..সে তমাল ..না ..মিতার জন্য নয় ....ওই একরত্তি তিনবছরের মেয়েটা ওকে এক  নিবিড় ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিলো ..কারণ অরুন মারা যাবার সাথে সাথেই তমাল দুহাত দিয়ে ওকে আগলে রেখেছিলো ... কখনো একটা দিনের জন্য ও তাকে  বাবার অভাব বুঝতে দেয় নি ..আর দিয়ার কাছে তার  বাবার কোনো স্মৃতি নেই ..যা আছে সবটাই তমালের সাথে ...সুখস্মৃতি ...
দিয়ার জীবনে সবকিছুতেই ওর কাকু ..ছোট্ট থেকে তার রাগ অভিমান কষ্ট আনন্দ সবকিছু তার কাকু যেভাবে বোঝে ওভাবে কেউ বোঝে না ..না  মাও নয় ..কাকু ঠিক বোঝে ওর কি হয়েছে ..সেই অনুযায়ী কথা বলে ওকে ঠিক মানিয়ে নেয় ..
এইভাবেই দেখতে দেখতে আঠারো  বছর কেটে যায় ..এখন দিয়া নবযৌবনা ..তরুণী ..হ্যাঁ এখনো তার কাকুই তার সব ..তার বেস্ট ফ্রেন্ড ..তার জীবনের যত কথা সব কাকুর সাথে সে আলোচনা করে ..কাকুই ঠিক রাস্তা টা দেখিয়ে দেন ..
আর এতগুলো বছর মিতা বার বার বলা সত্ত্বেও তমাল কেন যে বিয়ে করে নি সেটা কেউ না বুঝলেও মিতা বোঝে ..তমালের সাথে এতগুলো বছরের সম্পর্কে কখনো কেউ মুখে কিছু না বললেও কবে যেন দুইটি হৃদয় চুপি চুপি এক সুতোয়  বাঁধা পড়ে গেছে ..সেটা ওরা কেউই কখনো বুঝতে পারে নি ..

এই বছর দিয়ার কলেজ শেষ ..এবার ওর ইচ্ছে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে পড়াশোনা করার ..তার অবশ্য আরো একটা কারণ আছে ..ওর বন্ধু এবং ভালোবাসার জন.. সৌম..  এখন ওখানেই চাকরি করছে ..আর এ  ব্যাপারে মিতা বা তমালের ও. কোনো আপত্তি নেই ..আর দিয়ার মতো এমন মিষ্টি মেয়েকে নিজেদের একমাত্র ছেলের বৌ.. করতেও সৌম্যর বাবা মায়ের কোনো সমস্যা নেই ..
কিন্তু দিয়ার সমস্যা হলো তার মা কে নিয়ে ..মায়ের পুরো জগৎ  টাই তো ওকে নিয়ে ..ও চলে গেলে মা কি নিয়ে থাকবে ?কি করে কাটাবে বাকি  জীবন টা ?হ্যাঁ ...যদিও কাকু থাকবে ..কিন্তু কাকু তো মায়ের সাথে আছে ..জীবনে তো নেই ..এই সব ভেবে সৌম কে  ফোন করে দিয়া ..এসব নিয়ে প্রায় দুতিন দিন ধরে অনেক আলাপ. আলোচনা করে একটা উপায় বার করে ..পরের দিন ভোর বেলাই দিয়া চলে যায় তমালের বাড়ি ...এমনিতেই যখন তখন   চলে আসে দিয়া ..কিন্তু এত  ভোরে দিয়া কোনোদিন ই আসে নি ..তমাল কলিং বেল এর আওয়াজেই বোঝে যে এটা দিয়া ..কারণ ও এক ভাবে দরজা না খোলা পর্যন্ত বেল বাজায় ..এটা বড়াবড় এর অভ্যাস  দিয়া র ..তাই  এত সকালে দিয়া ??খানিক টা অবাক হয়েই দরজা খোলে তমাল ..তখন ই ঝড়ের গতিতে ঢুকে পড়ে দিয়া তমালের ঘরে ..আর তমাল কেও হাত ধরে বসায়  ওর পাশে ... ? বলে ..কাকু ?আমি কি খুব স্বার্থপর ?নিজের ছাড়া কিছুই কখনো বুঝিনি আমি ? বলো ?নাহলে এই কদিনে সৌম্যর চোখে যেটা খুব সহজে ধরা পড়লো ..এতগুলো বছর তোমাদের সাথে থেকেও আমি কেন সেটা বুঝিনি বলতে পারো ??
তমাল কিছুই বুঝতে পারে না ..দিয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ..এই কি তার ছোট্ট দিয়া ??যখন তখন এটা চাই ওটা চাই বলে যে তমালের গলা জড়িয়ে  ধরতো ??এতদিনের যত আবদার তার কাকুর কাছে ..সেই দিয়া আজ এসব কি বলছে ??
তমাল বলে ..কি হয়েছে স্পষ্ট  করে বল না মা ?কেউ কি কিছু বলেছে তোকে ?মা কি বকেছে ??
না কাকু না ...কেউ কিছু তোমরা বলো নি বলেই তো আমার  এত কষ্ট ..আমার জন্য তোমরা জীবনের এতগুলো বছর নষ্ট করেছো ..সেটাই তো আমার কষ্ট ..তারপর কিছুক্ষন দিয়া কাকুর হাত দুটো ধরে কেঁদে যায় ..এই মুহূর্তে তমাল ও কি বলবে কিছু ঠিক করতে পারে না .
এবার চোখ মুছে কাকুর দিকে সরাসরি তাকায় দিয়া ..বলে ..কাকু আজ আমি যা বলবো ..আশা করি তুমি  আর মা দুজনেই আমার ইচ্ছে কে মূল্য দেবে ..যদিও অনেক বসন্ত তোমাদের জীবন থেকে চলে গেছে ..তবু এই বৈশাখে আমি চাই তোমাদের দুটো হৃদয় এক হয়ে যাক ..এতদিন তোমরা আমায় দিয়েছো ..আজ আমি তোমাদের এইটুকু দিতে চাই ..তুমি মা কে প্রপোজ করো কাকু ..
তমাল বলে ..এটা  হয় দিয়া মা ?
দিয়া ..কেন হবে না ?আর তুমি যদি এটা না করো আমি কিন্তু অনর্থ করবো ..এই বলে রাখলাম ....
তমাল ..কিন্তু তোর মা কি রাজি হবে ?
দিয়া ..সেটা তুমি আমার ওপরেই i ছেড়ে দাও ..এর পর দিয়া বাড়ি চলে যায় ..
শুভ নববর্ষের দিন সকাল থেকেই দিয়ার মনে খুব আনন্দ ..মিতা কেও দিয়া রাজি করিয়ে ফেলেছে .. কিন্তু মিতার  মনে একটা দ্বিধা একটা কিন্তুবোধ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে ...বার বার অয়নের ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো জলে ভরে যাচ্ছে ..তাদের দিয়া আজ সত্যি কত বড়ো হয়ে গেছে ..
হঠাৎ দরজায় কলিং বেলের  আওয়াজে চমক ভাঙলো মিতার ...কিছুটা কুন্ঠিত পায়ে দরজাটা খুললো মিতা ..দেখলো বাইরে দাঁড়িয়ে  তমাল ...অন্যদিন নিঃসঙ্কোচে কত কথা হাঁসি ঠাট্টা হয় ..কিন্তু আজ তমাল কে দেখেই যেন বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা পড়ছে ..আপনাআপনি লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে গাল ..নিজের মনের না বলা কথারা  যেন  ছুটে বেরোতে চাইছে বুক চিরে ..ধীরে ধীরে দরজার পাশে সরে দাঁড়ায় সে ..
তমাল ....দিয়া মা কোথায় ??
মিতা ....ওর ঘরেই আছে ..
তমাল. .চলো আমার সাথে ..
বলে তমাল আর মিতা একসাথে দিয়ার ঘরে ঢোকে ..
দিয়া ঘর সাজাতে ব্যাস্ত ..আজ তার মায়ের এত আনন্দের দিন ..ও সেলিব্রেট করতে চায় ..তমাল দরজা থেকে ডাক দেয় ...দিয়া মা ???
দিয়া ...কাকু .. এসে গেছো ?? এসো ...নাও যা  আনতে বলেছিলাম এনেছো তো ??এবার  মাকে প্রপোজ  করো ..দাঁড়াও ...আমি ছবি তুলবো ..মোবাইল টা কোথায় গেলো ...
তমাল ধীরে দিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ..দিয়াকে দাঁড় করিয়ে ওর সামনে  হাঁটু মুড়ে বসে ..দিয়ার দিকে বাড়িয়ে দেয় গোলাপের তোড়াটা ..আর একটা বড়ো ক্যাটবেরি ...বলে ...আমি তোর মায়ের  স্বামী হবার আগে তোর বাবা হতে চাই দিয়া মা ..পারবি ??আমায়  বাপি বলে ডাকতে ??বল না মা ..পারবি ??
দিয়া ওর কাকুর হাতদুটো জড়িয়ে  ধরে নিজেও বসে পড়ে ..তারপর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে থাকে ...
 বাপি ... বাপি ...আমার সোনা বাপি ....আমার বাপি ...তিনজনের চোখেই তখন আনন্দাশ্রু ...
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.