সেই ছোট্টবেলার বন্ধু আমার অপূর্ব ( নাম পরিবর্তিত)! গত শতাব্দীর '৯০ এর দশকের রীতিমতো স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে ! কিন্তু ভাগ্যচক্রের আবর্তনে চাকরি পায়নি ! তাহলে উপায় ? অপূর্বর বাবা অনেক ভেবে চিন্তে বেহালার বুকে তাকে একটি জুয়েলারি দোকান খুলে দিল ! প্রথমদিকে রমরমিয়ে চলছিল সেই সোনার দোকান ! আর অপূর্ব ব্যবসার আটঘাট ক্রমশই রপ্ত করে ফেলেছিল ! ছোট্ট একটা দোকান, কিন্তু বেশ পরিপাটি করে সাজানো গোছানো ! সপ্তাহে দুদিন জ্যোতিষী বসেন সেখানে ! আর অপূর্ব তার পাল্লা বাটখারায় এবং শোরুমে টাঙানো বিভিন্ন দেবদেবীর ছবিতে স্পর্শ করে ক্রেতাদের নির্জলা মিথ্যা কথা বলতে দ্বিধা বোধ করে না ! ছোটোবেলার বন্ধু তো , তাই স্বাভাবিকভাবেই একটা টান রয়েছে !
এবার পুজোয় একদিন আড্ডা মারবার অছিলায় অপূর্বর শোরুমে সশরীরে উপস্থিত হলাম ! " বহুদিন পরে দেখা হল , নে প্রথমেই একটা সিগারেট ধারা " বলে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল আমাকে ! আমি বললাম নারে ভাই ! তোর দোকানে ঢোকবার আগেই একটা সিগারেট খেয়ে এলাম রে!" অপূর্ব আমার চোখ চোখ রেখে বললো " তোর বুকে যতই নিকোটিন জমবে, ততই আমার একজন কম্পিটিটর কমবে !" কথাটা শুনেই আমার লেখক স্বত্বা বুঝে গেল যে , বিশ বছর আগের অপূর্ব আর এখনকার অপূর্বর আকাশ পাতাল ফারাক ! যেকোনো মূল্যে সে আকাশকে ছুঁতে বদ্ধপরিকর ! অগত্যা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলাম ! " বাই দ্যা ওয়ে , তোরা তো বদ্যি ! তোদের গোত্র কি রে ?" শান্ত গলায় বললাম " ছন্নছাড়া !" অপূর্ব আকাশ থেকে পড়ল ! তোর সেই পুরোনো ঢ্যামনামো এখনও গেল না রে ! " আমি বললাম " কেন ! লেখকরাতো বোহেমিয়ান জীবন যাপন করতে পারদর্শী ! আজ এখানে তো কাল ওখানে ! তাই ছন্নছাড়া !" অপূর্ব এবার শান্তস্বরে বললো " তোর কাজ কেমন চলছে ? " বললাম " দিনরাত নিজের পেশাগত লেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকি ! চলে যাচ্ছে কোনোরকমে !" " তোর ব্যবসা এখন কেমন চলছে এবার বল !" অপূর্ব ঢোঁক গিলে কোনোরকমে বললো " লক ডাউনের পরে পুরো মার্কেটটাই ডাউন হয়ে গেছে রে ভাই ! বাজারে দেনাও প্রচুর পরিমাণে বাড়ছে !" বললাম " কেন ? তোর দোকানে তো পুরানো সোনা রূপোও কেনা হয় !" আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বন্ধু বললো " ওই পর্যন্তই !
মানুষের হাতে টাকা নেই ! সারাটা দিন দোকানে থেকে বেশ বুঝতে পারছি , মধ্যবিত্তের আর নিম্নবিত্ত পরিবারের নাজেহাল অবস্থা ! কতো সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা পর্যন্ত আমার এই দোকানে এসে তাঁদের গলার সোনার চেন , ব্রেসলেট বিক্রি করে গেছেন ! আকাল লেগেছে বুঝলি আকাল !" আমি আর অপূর্বর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না ,!" ধরা গলায় বললাম " কি বলছিস এসব ?" অপূর্ব আমার হাতটা ছুঁয়ে বললো " তিন সত্যি করে বলছি রে ভাই ! মানুষের হাতে টাকা নেই ! একেবারেই নেই !"। ( কিছুক্ষণ থেমে ) " জানিস বন্ধু, আমি কিছু কাউকে ঠকাই না ! সামান্য কিছু লাভ রেখে ন্যায্য দাম দিয়ে দিই ! " দেখলাম চোখটা ছলছল করছে অপূর্বর ! " বিশ্বাস কর বন্ধু, আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে আমি নিজেও ভুক্তভোগী ছিলাম ! আমার মা মরণাপন্ন ! হাতে টাকা নেই ! আত্মীয় স্বজনের ফোন করলে ফোনটা রিসিভ পর্যন্ত কেউ করতো না ! যদি আমি তাদের কাছে টাকা চেয়ে বসি! সবাই পাশ কাটিয়ে চলে যেত ! "
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন