![]() |
পীযূষ ভট্টাচার্য, এক আলোকিত নাম : মাধবী দাস |
মনোবৈকল্য ও মনোবিশ্লেষণ এবং অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের জীবনচিত্রণে তাঁর শিল্পময়তা অসাধারণ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত আজ।প্রচারের বাইরে থেকে নিভৃতে, নির্জনে সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন তিনি। তাঁর গল্প গোলগল্প নয় বলেই; পাঠক মহলও সীমিত। বৌদ্ধিক পাঠক মহলেই তিনি বেশি সমাদৃত। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অর্ণব সেন বলেছেন- "পীযূষ ভট্টাচার্য এমন একজন গল্পকার যাঁর ছোটগল্পের পাঠককে যোগ্য পাঠক হতে গেলে উপযুক্ত প্রস্তুতিপর্বের দরকার হতে পারে । তাঁর গল্পে পুরাণ-ইতিহাস- প্রত্নতত্ত্ব- রাজনীতি লোকায়ত জীবনসংস্কার এবং নানা বিষয় জড়িয়ে থাকে কাহিনী বিন্যাসে ও ভাষায়"।
১৯৪৬ সালের ৩ ডিসেম্বর দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।পিতা প্রয়াত জ্ঞানরঞ্জন ভট্টাচার্য ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ।মাতা প্রয়াত নিভাননী ভট্টাচার্য ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। স্বভাবতই বোঝা যায় অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা থাকলেও উন্নত জীবনদর্শন প্রাপ্তির সুযোগ তাঁর হয়েছিল। শৈশব কেটেছে কলকাতার চিৎপুরে,অধুনা বাংলাদেশের নীলফামারীতে এবং দার্জিলিং জেলার সোনাদায়।১৯৫৮ থেকে বালুরঘাটে আছেন। বর্তমান নিবাস চকভবানী, পুলক নিয়োগী লেন। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল নীলফামারীর কোনও এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ।সেখান থেকে চলে আসেন বালুরঘাটে। পরবর্তীতে 'ললিতমোহন আদর্শ বিদ্যালয়' ও বালুরঘাট হাইস্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করার পর অর্থনৈতিক কারণে পড়াশুনায় বিরতি আসে।পরে প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল ও বি এ পার্ট ওয়ান করে পি. ডব্লিউ. ডি.- তে গ্রুপ 'ডি' থেকে শুরু করে করণিক হয়ে ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন।১৯৭০ সালে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন মাধুরী দেবীর সঙ্গে। দুই মেয়ে পারমিতা ও সঙ্ঘমিত্রা।
গভীর জীবনবোধ ,সুঠাম কাহিনী বিন্যাস ও চরিত্র চিত্রণের নৈপুণ্যে পীযূষ ভট্টাচার্যের ছোটগল্প সমৃদ্ধ হয়েছে। তাঁর প্রথম গল্প সংকলন 'কুশপুত্তলিকা'(১৯৯৫) তারপর একে একে 'পীযূষ ভট্টাচার্যের গল্প'(১৯৯৮), 'কীর্তিমুখ'(২০০১), 'পদযাত্রায় একজন' (২০০৪),'নির্বাচিত গল্প'(২০০৪) ,'ঠাকুমার তালপাখা ও অন্যান্য গল্প'(২০০৬) শ্রীযুক্ত কিশোরীমোহন এবং তার মাদি মোষ (২০০৯)কৃষ্ণবর্ণ ষাঁড়ের পিঠে (২০১৩),জলের বর্গক্ষেত্র(২০১৬)। ৫০টি গল্প নিয়ে প্রকাশিতব্য 'উৎসর্গের উপকথা'।পীযূষ ভট্টাচার্য তাঁর উপন্যাসগুলোতে মানবমনের অন্ধকার দিককে বেশি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। আটপৌরে মানুষের অন্তরও যে কতটা কলুষ তা তিনি দেখাতে চেয়েছেন। পরাবাস্তববাদী ভাবনা পীযূষ ভট্টাচার্যের উপন্যাসে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়, যা মানুষকে বোধের গভীরে টেনে নিয়ে যায়। তাঁর উপন্যাসে কাহিনির ঘনঘটা নেই ,বরং বলা চলে অবচেতনে উঠে আসা শব্দ রাশির পিছনে চলে আসে খণ্ড-খণ্ড ঘটনার আবহ। আত্রেয়ী-পুণর্ভবা, টাঙ্গন এর তীরবর্তী বাসিন্দা তাঁর উন্যাসের মূল চরিত্র। প্রথম উপন্যাস জীবিসঞ্চার(২০০১)তারপর 'নিরক্ষরেখার বাইরে', 'তালপাতার ঠাকুমা'(২০১২) ও 'সূর্য যখন মেঘ রাশিতে'(২০১৩)।
এই চারটি আখ্যানের সঙ্গে 'নিরুদ্দেশে রূপকথা' সহ মোট পাঁচটি আখ্যান 'তৃতীয় পরিসর' প্রকাশনা থেকে ২০২০- র কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে 'চারনম্বর প্ল্যাটফর্ম' নামে একটি ওয়েব ম্যাগাজিনে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'অন্তেবাসী' ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর লেখালেখি নিয়ে ইতিমধ্যেই নানারকম গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ক্রোড়পত্র। তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননাগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত (২০১০) 'শান্তি সাহা স্মারক পুরস্কার'।তাছাড়া রয়েছে উত্তরবঙ্গ নাট্যজগত প্রদত্ত 'বিশিষ্ট সাহিত্যিক সম্মাননা ও পুরস্কার ',কবি জীবনানন্দ স্মারক সম্মান, বদরীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায় সম্মান -কথাজাতক,বর্ণালী স্মারক সম্মান, মধ্যবর্তী সাহিত্য পত্রিকার সংবর্ধনা, কবিতাপাক্ষিক এর সম্মাননা, দিবারাত্রি কাব্যের সম্মাননা,বিমলা বর্মন স্মৃতিস্মারক পুরস্কার প্রভৃতি।
মানুষ হিসেবে অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ পীযূষ ভট্টাচার্য। আত্মসম্মানবোধ প্রচন্ড তীব্র। অত্যন্ত আন্তরিক ও স্নেহশীল। সত্তর পেরিয়েও অসীম প্রাণশক্তি নিয়ে এখনও তিনি স্বপ্ন দেখেন কথাসাহিত্যের গতানুগতিকতা ভেঙ্গে নতুন ফর্ম সৃষ্টি করার।
মাধবী দাস
কোচবিহার
৮০১৬৫৮১৮৪৪
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন