পীযূষ ভট্টাচার্য, এক আলোকিত নাম : মাধবী দাস

পীযূষ ভট্টাচার্য, এক আলোকিত নাম : মাধবী দাস
পীযূষ ভট্টাচার্য, এক আলোকিত নাম : মাধবী দাস 
 
রাজনৈতিক জীবনের কোণঠাসা অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে খুঁজতে ৩৫ বছর বয়সে লেখালেখির জগতে পাকাপাকিভাবে চলে এলেন এই সময়ের ব্যতিক্রমী লেখক পীযূষ ভট্টাচার্য।বিংশ শতকের শেষ দশক থেকে তাঁর লেখার যাত্রায় ক্রমশ অভিনবত্ব , জীবনের জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে একা হয়ে যাওয়ার নিবিড়তা বাংলা কথা সাহিত্যে তাঁকে স্থায়ী আসন করে দিয়েছে। ছোট গল্পকার ও ঔপন্যাসিক পীযূষ ভট্টাচার্য মূলত কথা সাহিত্যিক হলেও সাহিত্যিক জীবনের শুরুতে কবিতা লিখেছেন। 'মহিম্ন অসুখ মহিম্ন যন্ত্রণা'(১৯৯১) নামে একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়। গল্প গুলিতেও দেখা যায় কবির মতো শব্দে শব্দে বিয়ে দিতে! তাই গদ্যশৈলীতে মিশে যায় কবিতার পরাগরেণু । তাঁর গল্পে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল আন্দোলন থেকে তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস, জরুরি অবস্থা থেকে লোকবিশ্বাস , প্রান্তিক মানুষ আদিবাসী ক্ষেতমজুর সব যেন ভিড় করেছে পরিমার্জিত শব্দবন্ধে ও ব্যঞ্জনাধর্মী কাব্যগন্ধী হয়ে।

মনোবৈকল্য ও মনোবিশ্লেষণ এবং অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের জীবনচিত্রণে তাঁর শিল্পময়তা অসাধারণ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত আজ।প্রচারের বাইরে থেকে নিভৃতে, নির্জনে সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন তিনি। তাঁর গল্প গোলগল্প নয় বলেই; পাঠক মহলও সীমিত। বৌদ্ধিক পাঠক মহলেই তিনি বেশি সমাদৃত। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অর্ণব সেন বলেছেন- "পীযূষ ভট্টাচার্য এমন একজন গল্পকার যাঁর ছোটগল্পের পাঠককে যোগ্য পাঠক হতে গেলে উপযুক্ত প্রস্তুতিপর্বের দরকার হতে পারে । তাঁর গল্পে পুরাণ-ইতিহাস- প্রত্নতত্ত্ব- রাজনীতি লোকায়ত জীবনসংস্কার এবং নানা বিষয় জড়িয়ে থাকে কাহিনী বিন্যাসে ও ভাষায়"। 

বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিক গল্প এবং কাহিনি সর্বস্বতাকে উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছেন অন্য ধারার ভাষা, ভিন্ন আঙ্গিক। খুব ছোটখাটো উপকরণকে লেখার মাধুর্যে অসামান্য করে তোলেন তিনি।রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের ধারাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে যত ছোট গল্প রচিত হয়েছে তা প্রথম ভেঙে দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য জগদীশ গুপ্ত।পীযূষ ভট্টাচার্যকেও দেখি স্বতন্ত্র সাহিত্যধারায় পাঠককে আকৃষ্ট করতে ।জীবনের ক্লেদ, গ্লানি, জিঘাংসা, ভ্রান্তি পীযূষ ভট্টাচার্যের হাতে বারবার গল্প হয়ে উঠেছে।প্রায় প্রতিটি গল্পের অন্তরে যেন আরও গল্প লুকিয়ে থাকে।ফ্রয়েড ও মার্কসের দর্শন তাঁকে যে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল গল্পগুলো পড়লেই সচেতন পাঠক বুঝতে পারে।

১৯৪৬ সালের ৩ ডিসেম্বর দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।পিতা প্রয়াত জ্ঞানরঞ্জন ভট্টাচার্য ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ।মাতা প্রয়াত নিভাননী ভট্টাচার্য ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। স্বভাবতই বোঝা যায় অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা থাকলেও উন্নত জীবনদর্শন প্রাপ্তির সুযোগ তাঁর হয়েছিল। শৈশব কেটেছে কলকাতার চিৎপুরে,অধুনা বাংলাদেশের নীলফামারীতে এবং দার্জিলিং জেলার সোনাদায়।১৯৫৮ থেকে বালুরঘাটে আছেন। বর্তমান নিবাস চকভবানী, পুলক নিয়োগী লেন। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল নীলফামারীর কোনও এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ।সেখান থেকে চলে আসেন বালুরঘাটে। পরবর্তীতে 'ললিতমোহন আদর্শ বিদ্যালয়' ও বালুরঘাট হাইস্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করার পর অর্থনৈতিক কারণে পড়াশুনায় বিরতি আসে।পরে প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল ও বি এ পার্ট ওয়ান করে পি. ডব্লিউ. ডি.- তে গ্রুপ 'ডি' থেকে শুরু করে করণিক হয়ে ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন।১৯৭০ সালে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন মাধুরী দেবীর সঙ্গে। দুই মেয়ে পারমিতা ও সঙ্ঘমিত্রা। 

ছোটবেলা থেকেই ছড়া কবিতা লেখার আগ্রহ ছিল তাঁর ।প্রথম প্রকাশিত গল্প গরম ভাত বালুরঘাটের 'প্রতিলিপি' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কদাচিৎ বানিজ্যিক পত্রিকায় লিখলেও লিটল ম্যাগাজিনেই বেশি লেখেন। কাগজের চাহিদা অনুযায়ী তিনি কখনওই লেখেন না।বালুরঘাটের অভিজিৎ সেন এর প্রতিকূলতার মধ্যেও লিখে যেতে পারা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে, গদ্য লেখার ধৈর্যের ক্ষেত্রে ।আবহমান বাংলা সাহিত্যের নানা দিক তাকে নানা ভাবে অনুপ্রাণিত করেছে । প্রথাগত পড়াশুনায় তথাকথিত ডিগ্রি তেমন না থাকলেও জ্ঞানচর্চায় তিনি যে পিছিয়ে নেই তা তাঁর গল্প উপন্যাস গুলো পড়লেই বোঝা যায়।তিনি মনে করেন- মধ্যযুগ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত মানুষের ব্যক্তি থেকে সমষ্টি, বাস্তব থেকে অবাস্তব, স্বপ্ন থেকে স্বপ্ন ভঙ্গ সবই জড়িয়ে থাকে আখ্যান রীতিতে। তাই কিংবদন্তি পুরাণ এবং লৌকিক অলৌকিক মানবজীবনের ক্রিয়া-কলাপ। অবশ্য এর মধ্যে নৈসর্গিক অনুসন্ধানের খোঁজ থাকে যা শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় মহাজাগতিক।

গভীর জীবনবোধ ,সুঠাম কাহিনী বিন্যাস ও চরিত্র চিত্রণের নৈপুণ্যে পীযূষ ভট্টাচার্যের ছোটগল্প সমৃদ্ধ হয়েছে। তাঁর প্রথম গল্প সংকলন 'কুশপুত্তলিকা'(১৯৯৫) তারপর একে একে 'পীযূষ ভট্টাচার্যের গল্প'(১৯৯৮), 'কীর্তিমুখ'(২০০১), 'পদযাত্রায় একজন' (২০০৪),'নির্বাচিত গল্প'(২০০৪) ,'ঠাকুমার তালপাখা ও অন্যান্য গল্প'(২০০৬) শ্রীযুক্ত কিশোরীমোহন এবং তার মাদি মোষ (২০০৯)কৃষ্ণবর্ণ ষাঁড়ের পিঠে (২০১৩),জলের বর্গক্ষেত্র(২০১৬)। ৫০টি গল্প নিয়ে প্রকাশিতব্য 'উৎসর্গের উপকথা'।পীযূষ ভট্টাচার্য তাঁর উপন্যাসগুলোতে মানবমনের অন্ধকার দিককে বেশি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। আটপৌরে মানুষের অন্তরও যে কতটা কলুষ তা তিনি দেখাতে চেয়েছেন। পরাবাস্তববাদী ভাবনা পীযূষ ভট্টাচার্যের উপন্যাসে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়, যা মানুষকে বোধের গভীরে টেনে নিয়ে যায়। তাঁর উপন্যাসে কাহিনির ঘনঘটা নেই ,বরং বলা চলে অবচেতনে উঠে আসা শব্দ রাশির পিছনে চলে আসে খণ্ড-খণ্ড ঘটনার আবহ। আত্রেয়ী-পুণর্ভবা, টাঙ্গন এর তীরবর্তী বাসিন্দা তাঁর উন্যাসের মূল চরিত্র। প্রথম উপন্যাস জীবিসঞ্চার(২০০১)তারপর 'নিরক্ষরেখার বাইরে', 'তালপাতার ঠাকুমা'(২০১২) ও 'সূর্য যখন মেঘ রাশিতে'(২০১৩)।

এই চারটি আখ্যানের সঙ্গে 'নিরুদ্দেশে রূপকথা' সহ মোট পাঁচটি আখ্যান 'তৃতীয় পরিসর' প্রকাশনা থেকে ২০২০- র কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে 'চারনম্বর প্ল্যাটফর্ম' নামে একটি ওয়েব ম্যাগাজিনে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'অন্তেবাসী' ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর লেখালেখি নিয়ে ইতিমধ্যেই নানারকম গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ক্রোড়পত্র। তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননাগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত (২০১০) 'শান্তি সাহা স্মারক পুরস্কার'।তাছাড়া রয়েছে উত্তরবঙ্গ নাট্যজগত প্রদত্ত 'বিশিষ্ট সাহিত্যিক সম্মাননা ও পুরস্কার ',কবি জীবনানন্দ স্মারক সম্মান, বদরীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায় সম্মান -কথাজাতক,বর্ণালী স্মারক সম্মান, মধ্যবর্তী সাহিত্য পত্রিকার সংবর্ধনা, কবিতাপাক্ষিক এর সম্মাননা, দিবারাত্রি কাব্যের সম্মাননা,বিমলা বর্মন স্মৃতিস্মারক পুরস্কার প্রভৃতি।

মানুষ হিসেবে অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ পীযূষ ভট্টাচার্য। আত্মসম্মানবোধ প্রচন্ড তীব্র। অত্যন্ত আন্তরিক ও স্নেহশীল। সত্তর পেরিয়েও অসীম প্রাণশক্তি নিয়ে এখনও তিনি স্বপ্ন দেখেন কথাসাহিত্যের গতানুগতিকতা ভেঙ্গে নতুন ফর্ম সৃষ্টি করার।

মাধবী দাস
কোচবিহার
৮০১৬৫৮১৮৪৪
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.