চারিদিকে থৈ থৈ বন্যায় একটুখানি উঁচু মাটির ঢিবি পেলে বাঁচার জন্য সেখানে মানুষ, কুকুর-বিড়াল, পিঁপড়ে, ব্যাঙ, সাপ-সরীসৃপ, বেজি সকলেই আশ্রয় নেয়। সকলেই ভুলে যায় একে অপরের খাদ্য বা খাদক। তখন সবার একটিই লক্ষ্য থাকে বাঁচা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখনো কখনো প্রকৃতির জীবেদের এই পর্যায়ে নিয়ে এসে ফেলে দেয়।
এই মুমূর্তে কোভিড-19, নভেল করোনা ভাইরাসের আক্রমণকে পৃথিবীর মানুষের জন্য তেমনি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বললে ভুল হবে না। সেই সঙ্গে এটা বললেও ভুল হবে না যে, কিছুদিন আগে পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের মানুষ যেভাবে জাতি, ধর্মমত, বর্ণ, ভাষা এবং বাসস্থানের পার্থক্য করে পরস্পরের মধ্যে বিভেদ করছিলেন এক লহমায় এই করোনা ভাইরাসের আক্রমণ সেই বিরোধ থেকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে একই সমতলে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ, দেশের সকল ধর্মমতের, সকল বর্ণের, সকল ভাষার, ধনী-দরিদ্র সকল মানুষের একটিই আকুতি সকলকে বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে। কাউকে টপকিয়ে কেউ বাঁচতে পারবেন না। কোভিড-19 করোনা এমন একটি মারাত্মক রোগ জীবাণু যা রোগগ্রস্ত মানুষের সংস্পর্শ বা ছোঁয়া লাগলেই কেউ আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা এই ভাইরাস কমিউনিটির মধ্য দিয়ে এত দ্রুত ছড়াচ্ছে যে, যে বা যাঁরাই রোগগ্রস্ত মানুষের সংস্পর্শে আসছেন, তাঁর বা তাঁদের শরীরে ভাইরাস অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছে। আর সবচেয়ে ভয়ের এখনো পর্যন্ত এই ভাইরাসকে প্রতিহত করার মতো কোনো প্রতিষেধক ওষুধ আবিষ্কার হয়নি । সর্বোপরি এই ভাইরাসের চরিত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও বিজ্ঞান এখনো পর্যন্ত নীরব । আসলে এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞান যে ফর্মুলায় জীবপঙ্কীয় সৃষ্টিচক্রে সূক্ষ্মতম সত্তা হিসেবে কার্বন বা কার্বন-পরমাণুর কথা বলে আসছিল এই করোনা ভাইরাস সেই ফর্মুলার অণুজীবৎ নয়। ফলে এই ভাইরাসের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য অজানাই শুধু নয়, নিয়ন্ত্রণের পথও বিজ্ঞানীদের নাগালের বাইরে ।
অনেকের জানা এবং অনেকের অজানা হলেও একটি আশার কথা বলি, এই ধরণের অণুজীবৎ সম্পর্কে এই শতাব্দীর এক নব বিজ্ঞান রহস্যের উদ্গাতা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার 1986 খ্রিষ্টাব্দে 'মাইক্রোবাইটাম -- ভূমাচৈত্তিক ধাতুর রহস্যজনক উৎসারণ' বলে একটি বিজ্ঞান রহস্যের কথা বলে গেছেন । সেই বিজ্ঞান তত্ত্বে তিনি সৃষ্টি রহস্যের মুলীভূত পার্টিক্যাল হিসেবে কার্বন ও কার্বন-পরমাণুর চেয়েও সূক্ষ্মতর একটি অণুজীবতের কথা বলেছেন। এই সূক্ষ্মতর অণুজীবৎ গুলির দেহ সংরচনা প্রচলিত কার্বন বা কার্বন-পরমাণুর দেহ সংরচনার মতো নয়। মাইক্রোবাইটামের দেহ সংরচনা কার্বন বা কার্বন-পরমাণুর চেয়েও সূক্ষ্ম এবং এদের গতিবিধিও কার্বন বা কার্বন-পরমাণুর মতো নয়। এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানের ফর্মুলায় ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসরা যে মাধ্যমে চলাচল করতো বা করে মাইক্রোবাইটাম তারচেয়েও সূক্ষ্ম মাধ্যমে চলাচল করে। যেমন, শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ, এমনকি আলোক তরঙ্গে এবং চিন্তা তরঙ্গেও মাইক্রোবাইটামরা চলাচল করতে পারে। বেঁচে থাকতে পারে এবং বংশ বিস্তার করতে পারে। আজ এই 'কোভিড-19 নভেল করোনা' ভাইরাস যেভাবে স্পর্শ তন্মাত্রের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মানুষের শরীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে তা দেখে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বের কথা মনে পড়ে গেল । শ্রীসরকার মাইক্রোবাইটামের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে পজেটিভ, নেগেটিভ ও নিউটাল এই তিন ধরণের মাইক্রোবাইটামের কথা বলেছেন । বলেছেন, জড় অজড় সমগ্র সৃষ্টি প্রক্রিয়ার শারীরিক সংরচনা এবং উন্নত জীবের মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সংরচনা ঘটণের জন্যও এই তিন ধরনের মাইক্রোবাইটামদেরই ভূমিকা। সর্ব ক্ষেত্রেই পজেটিভ বা নেগেটিভ মাইক্রোবাইটামই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞান গবেষণায় এই মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বটা যেহেতু অনালোচিত থেকে গেছে সেই হেতু এর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও মানুষের হাতে নেই। ফলে পরিচিত কার্বনিক বা কার্বন-পরমাণবিক সংরচনার বাইরের অণুজীবৎ বা মাইক্রোবাইটাম মানুষের সংস্পর্শে এলে মানুষ তার চরিত্র-বৈশিষ্ট্যও যেমন বুঝতে পারে না, তেমনি নিয়ন্ত্রণও করতে পারে না । অসাহায়ের মতো মার খেতে হয় সেই অজানা অণুজীবতের কাছে । বললে হয়তো অত্ত্যুতি হবে না যে 'এই কোভিড-19 নামক নভেল করোনা তেমনই একটি অণুজীবৎ । শুধু এই নভেল করোনা নয় , এই রকম অন্য আরও যে কোনো অণুজীবৎ পৃথিবীতে সৃষ্টি হতে পারে বা ভিন্ন গ্রহ থেকে আসতে পারে । সে ক্ষেত্রে বিপদ বা সুবিধা দুইই হতে পারে। অণুজীবৎ বা মাইক্রোবাইটাম যদি পজেটিভ হয় , তবে তার দ্বারা পৃথিবীর বা পৃথিবীর মানুষের কল্যাণ হবে। অণুজীবৎ বা মাইক্রোবাইটাম যদি নেগেটিভ হয়, তার দ্বারা পৃথিবীর বা পৃথিবীর মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হবে ।
আর এটাই এই মুহূর্তে সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে ত্রাস। আর যেহেতু কমিউনিটির মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে, তাই এই মুহূর্তে এই রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে কমিউনিটির সচেতনতাই প্রধান প্রতিকার। রোগ যাতে এক সঙ্গে বহু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে না পারে তার জন্য রোগগ্রস্ত মানুষ থেকে পরস্পরের দূরত্ব মেইনটেইন করার জন্য সব দেশের, সব ভাষার, সব ধর্মমতের মানুষ এক মত হয়েছেন। এবং শুধু সকলে একমতই হননি, অন্তত এই মুহূর্তে সকলে পরস্পরের প্রতি বিভেদও ভুলে গেছেন। দেশ, জাতি, ধর্মমত, ভাষা ভুলে সকল মানুষ নিজ নিজ ধর্মমতীয় বিশ্বাসে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা শুরু করেছেন নিজের এবং সকলের বাঁচার জন্য।
এই ভাইরাসের আগমন নিশ্চয় পৃথিবীর জন্য শুভ নয় ! কিন্তু এই ভাইরাসের আগমনে মানুষ বিপদে পড়ে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ভুলে গেছে। ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কিছুটা হলেও ঘুচে গেছে। না, এতে উৎফুল্ল হয়ে এটা বলবো না যে এই ধরণের বিপদ আরও অসুক , আর মানুষ পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যাক। বরং এটা বলবো যে কোনো কিছুতেই মানুষের এতটা অহংকার করার কিছু নেই যে এই পৃথিবীতে শুধু অমুক জাতির মানুষ, অমুক ধর্মমতের মানুষ, অমুক ভাষার মানুষ, অমুক দেশের মানুষ বসবাস করবে আর অন্যেরা করতে পারবে না। অন্যেরা অভিশপ্ত, অন্যেরা জঙ্গি,অন্যেরা শরণার্থী। করোনা ভাইরাস নামক ছোট্ট একটি অণুজীবৎ বরং এটা শিক্ষা দিয়ে গেলো, মানুষ তুমি যত বড়ই হও, তুমি ক্ষুদ্র । তুমিও স্রষ্টার শরণার্থী। তোমার বাঁচা-বাড়া তাঁর (স্রষ্টার) স্মরণের ওপর নির্ভরশীল। আমরা সবাই একই সমতলে স্রষ্টার কাছে শরণার্থী।
এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের প্রতিটি শহর, রাস্তা-ঘাট, দোকান-মল, স্কুল-কলেজ , অফিস-আদালত সর্বত্র শুনশান। সবাই নিজ নিজ গৃহে নিজেরাই বন্দি হতে শুরু করেছেন। আমি ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গের মানুষ। আমি বিশ্ব জানি না। কিন্তু বিশ্ববাসীর এই অসহায় অবস্থার কথা ঘরে বসে জানছি । বিশ্ববাসীর সঙ্গে আমি, আমার ভারতবর্ষ, আমার পশ্চিমবঙ্গ, আমার উত্তরবঙ্গও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এই বিপদের হাত থেকে বাঁচতে তৎপর হয়েছে।
উত্তরবঙ্গের বহু দরিদ্র মানুষ ভিন রাজ্যে কাজ করতে যান। তাঁদের অনেকে ফিরে এসেছেন। ভালো কথা। প্রতিটি পরিবার চান নিজের মানুষ নিজের ঘরে ফিরে আসুক। কিন্তু আপনারা যাঁরা ভিন রাজ্য থেকে ফিরে এসেছেন,তাঁরা সরকারকে জানান। স্বাস্থ্য দফতরকে জানান। নিজেরা নিজেদের, নিজেদের পরিবারের এবং কমিউনিটির সকলের স্বার্থে সহযোগিতা করুন। কমিউনিটি ডিজিজকে কেবল কমিউনিটির সতর্কতার মাধ্যমেই প্রতিহত করা সম্ভব । একজন কেউ এড়িয়ে গেলে দ্বিতীয় জন আক্রান্ত হবেন। দ্বিতীয় জন এড়িয়ে গেলে তৃতীয় বা তিনগুণ মানুষ আক্রান্ত হবেন। সর্বোপরি মহামারি রূপ নেবে। আশার কথা সম্ভবত প্রথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উত্তরবঙ্গের মানুষ অনেকটাই সচেতন হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া উত্তরবঙ্গের স্বাস্থ্য প্রশাসন সহ সাধারণ প্রশাসন ব্যাপক তৎপর হয়েছেন এই ভাইরাসের মোকাবেলা করতে। সর্বোপরি উত্তরবঙ্গের আবহাওয়াও অনেকটাই অনুকূল। চিন যতই উত্তরবঙ্গের উত্তরে হোক , হিমালয় পর্বতমালা শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, সমগ্র ভারতবর্ষকে উত্তরের যে কোনো আক্রমণকে প্রতিহত করতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে । সেদিক থেকেও আমরা অনেকটা নিরাপদ। এটাও আমাদের কাছে ঈশ্বরের দান। না, অলীক বিশ্বাসের ঈশ্বর নয় ; আমরা মেনে চলব প্রকৃতি ঈশ্বরের বিধান। আমরা আমাদের পরিবেশ ঠিক রাখবো। পরিবেশে পজিটিভ থিঙ্কিঙ বাড়াবো। সবার ভালোর মধ্যে দিয়ে নিজে ভালো থাকবো। সুস্থ সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকবো। আনন্দের সঙ্গে বেঁচে থাকবো। সমবেত এই ভালোর কামনার মধ্য দিয়ে যে কোনো কালো করোনাকে আটকাতে হবে। অন্য সব ক্ষুদ্র চিন্তা ভুলে গিয়ে । এটিই কমিউন প্রতিরোধ ব্যবস্থা। একই সমতলে আমরা পৃথিবীর মানুষ। সকলে সুস্থ সুন্দর ভাবে বাঁচতে চাই।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন