অথচ জীবনটা তাঁর কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ১৯৩৬ সালে মাত্র ১৬ বৎসর বয়সে অমৃতার বিবাহ হয়েছিল প্রীতম সিং এর সঙ্গে। প্রীতম সিং ছিলেন সাহিত্য সম্পাদক। কিন্তু বিবাহটি সুখের হয় নি। ১৯৬০ সালে তিনি স্বামীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক ছেদ করেন। কবি শাহির লুধিয়ানভির সাথে অমৃতার একতরফা প্রেম ছিল। এই প্রেমের কাহিনী তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা 'রশিদি টিকেট' এ ধরা পড়েছে। শাহিরের জীবনে জনৈক সঙ্গীত শিল্পী সুধা মলহোত্র এসে গেলে অমৃতা ইমরোজ নামে একজন লেখক শিল্পীর সঙ্গে বসবাস শুরু করেন।
ছিয়াশি বছরের জীবনের শেষ চল্লিশটি বছর তিনি ইমরোজের সাহচর্যে কাটিয়েছেন। তাঁর উথাল পাথাল নারীজীবন ধরা পড়েছে ১৯৬৮ সালে লেখা ব্ল্যাক রোজ এবং ২০০৪ সালে অক্ষরোঁ কে সায়ে রচনায়। এগারো বৎসর বয়সে অমৃতা মাতৃহারা হয়ে নিঃসঙ্গতায় ভুগতেন। এটাই তাঁকে কবিতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিশোরীবেলায় লেখালেখি করতে করতেই সাহিত্য সম্পাদক প্রীতম সিংয়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। ১৯৩৬ সালে বিবাহের বৎসরে অমৃতার প্রথম কাব্য সংকলন 'অমৃত লহরেঁ' প্রকাশিত হয়। এরপরে ১৯৩৯ সালে জিউন দা জীবন , ১৯৪২ সালে ত্রেল ধতে ফুল, ও গীতাঁ ভালিয়া, ১৯৪৩ সালে বদলাম দে লালি ও সাঁঝ দে লালি, ইত্যাদি মোট ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
১৯৪৭এ উপমহাদেশে এল খণ্ডিত স্বাধীনতা। আঠাশ বছরের তরুণী অমৃতা উদ্বাস্তু হলেন। তখন তিনি গর্ভবতী। তিনি ভারতে আশ্রয় চেয়েছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে দেশভাগ ও উদ্বাস্তুদের উপর অত্যাচার একধরণের প্রতিবাদী সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে। দেশবিভাগ ও উদ্বাস্তু যন্ত্রণা অমৃতার কলমে কবিতা জন্ম দিয়েছে। "আজ আখন ওয়ারিশ শাহ নু", আজ আমি ওয়ারিশ শাহের কাছে প্রশ্ন তুলছি। ওয়ারিশ শাহ ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর এক সুফি কবি ও সাধক। তিনি অমৃতার জন্মস্থান এলাকায় জন্মেছিলেন। মঈনুদ্দিন চিস্তি ঘরাণার এই সুফি কবি হীর ও রঞ্ঝাকে নিয়ে বিয়োগবিধুর কাব্য লিখেছিলেন।
অমৃতা ১৯৬১ সাল অবধি দিল্লির অল ইণ্ডিয়া রেডিওতে কাজ করেছিলেন। ১৯৬০ সালে চল্লিশ বছর বয়সে প্রীতম সিংয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদের পর অমৃতা নারী জীবনের প্রতি বঞ্চনা ও আক্রমণের বিরুদ্ধে বিশেষ ভাবে সরব হন।নিজের দাম্পত্য জীবনের তিক্ত গরল অভিজ্ঞতা তাঁর কলমকে নারীবাদের সপক্ষে মুখরিত করেছিল। তাঁর জীবিতকালেই তাঁর লেখা ইংরেজি, ফরাসি, ডেনিশ, জাপানি, মান্দারিন ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অমৃতার কলমে জন্ম নেওয়া সাহিত্য চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। ১৯৬৫ সালে ধরতি সাগর তে সিপ্পিয়াঁ থেকে কাদম্বরী ফিল্ম তৈরি হয়। এরপর ১৯৭৬ সালে উনা দি কাহিনী থেকে পরিচালক বাসু ভট্টাচার্য ডাকু নামে ফিল্ম তৈরি করেন। ২০০৩ সালে তাঁর 'পিঞ্জর' উপন্যাস অবলম্বনে চন্দ্রপ্রকাশ দ্বিবেদী দেশভাগের সূত্রে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নিয়ে ওই একই নামে ফিল্ম তৈরি করেন। এই ফিল্মটি বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়।
অমৃতা প্রীতম 'নাগমণি' নামে পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। পত্রিকাটি তেত্রিশ বছর ধরে সহযোগী লেখক শিল্পী ইমরোজের সাথে পরিচালনা করেছেন। অমৃতা প্রীতম বলেছিলেন, শুধুমাত্র হিংসা থামানোই শান্তি নয়, শান্তি হল ফুল ফুটিয়ে তোলার পরিবেশ গড়ে তোলা। বলেছিলেন, ওয়ারিশ শাহ, তুমি কবর থেকে উঠে এসে আরো একটা প্রেমের বই লেখো। লক্ষ লক্ষ মেয়ে প্রেম পেতে চেয়ে কাঁদছে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন