![]() |
রসগোল্লার জন্ম খুনসুটি : চাষী সিরাজুল ইসলাম |
রসগোল্লা সাধারণত:চিনি, গুড় এবং ছানা পাকিয়ে সুজি মিশিয়ে গরম রসে ডুবিয়ে প্রস্তুত করা হয়। বাঙালির কাছেতো বটেই। এখন অনেক জাতির কাছেই এটি জনপ্রিয় ও সমাদৃত।
সাম্প্রতিককালে এই জনপ্রিয় রসগোল্লা নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ বলছে তারা এর আবিস্কারক। ওড়িষা বলছে তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে রসগোল্লার আদি উৎপত্তিস্থল বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলে। বিশেষ করে, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় পর্তুগীজদের সময় সেখানকার ময়রাগণ ছানা, চিনি, দুধ ও সুজি দিয়ে গোলাকার একধরণের মিষ্টান্ন তৈরি করেন যা ক্ষীরমোহন বা রসগোল্লা নামে পরিচিত। পরবর্তীতে বরিশাল এলাকার হিন্দু ময়রাগণের বংশধর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা কিংবা ওড়িষায় বিস্তার লাভ করে।
রসগোল্লার আবিস্কারক কে যুদ্ধের এই দামামা প্রথম বাজিয়েছে উড়িষ্যাই। দাবি করেছে, গোটা দুনিয়া যে মিষ্টিকে কলকাতার সঙ্গে এক এবং অভিন্ন হিসেবে দেখা হচ্ছে সেই রসগোল্লার উৎপত্তি নাকি ভুবনেশ্বর ও কটকের মধ্যবর্তী 'পহলা' অঞ্চলে এবং অন্তত ৩০০ বছর আগে।
ওড়িষা রাজ্যের দাবি তারাই প্রথম রসগোল্লা বানায়। এটি প্রথমবারের মত সেখানেই বানানো হয় এবং রাজা জগন্নাথের টেবিলে তা পরিবেশন করা হতো। এটি নাকি রথযাত্রা উৎসবে প্রচলিত হয়েছিল। তখন থেকেই কয়েক শত বছর ধরে এটি টিকে রয়েছে।
ওড়িষার নামকরা ইতিহাসবিদ-জে পাঢ়ী তাঁর পুরোষত্তমতত্ব ও নব কলেবর ( ১৯৯৬ ) বইতে বলছেন,ওড়িষার পুরীতে এই রসগোল্লা,আদিতে ক্ষীরমোহন নাম নিয়ে জগন্নাথ দেবকে রথ যাত্রায় শীতল ভোগ দেওয়া হতো । অনেক পরে,কটক জেলার শালেপুরের 'বিকলানন্দ কর' এই মিষ্টির নাম দেন 'রসগুল্লা'। রসগুল্লা মানে হলো রসের গোলা । মূলত লক্ষ্মীদেবীকে এই মিষ্টি শীতল ভোগ দেওয়া হতো ।
"The rasgulla is more than 600 years old. It is as old as the Rath Yatra in Puri". পাঢ়ী তাঁর বইতে এই কথাই লিখেছেন ।
আরও একজন ইতিহাসবিদ এসসি মহাপাত্র বলছেন,This practice of offering rasgullas to Lakshmi dates back at least 300 years. "The Rath Yatra, which started more than six centuries ago, has not changed with times. And until today, rasgulla is the only sweet offered to Mahalaxmi, Jagannath's consort, to appease her when the deities return home,"
বলা হয় , নদে জেলার নবদ্বীপের চৈতন্য দেবপুরীতে এই রসগুল্লা খেয়ে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল মহাপ্রভুর এই মিষ্টির প্রতি দুর্বলতার কথা । শান্তিপুর ফুলিয়ার 'হারাধন' ময়রা চলে গেলেন পুরীতে । মোটামুটি, সেটা ১৮৬৪ সাল। হারাধন ময়রার রথ দেখা আর কলা বেচা এক সঙ্গে শুরু হলো । সেখানে শিখে এলেন রসগুল্লা বানানোর প্রণালী। কিন্তু, সেই পুরীর ক্ষীর মোহনের স্বাদ নাকি এলো না তার মিষ্টিতে।
পরবর্তীতে নবীন চন্দ্র দাস, কলকাতার বাগবাজারে দোকান খোলেন ১৮৬৬ সালে । তিনি জেনেছিলেন হারাধন ময়রার এই চেষ্টার কথা । লেগে গেলেন তাঁর মতো তৈরি করতে । কলম্বাস হয়ে গেলেন নবীন ময়রা।
বাঙালির প্রিয় রসনা রসগোল্লা। এই রসগোল্লার অাতুর ঘর কলকাতায়। আর এর জনক কলকাতার আদি চিনি ব্যাবসায়ী নবীন চন্দ্র দাস। নবীন চন্দ্র ১৮৬৪ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে একটি মিষ্টির দোকান খোলেন। কিন্তু বেশী দিন ওই মিষ্টির দোকানটি তিনি টিকিয়ে রাখতে পারেননি। এরপর ১৮৬৬ সালে কলকাতার বাগবাজারে ফের অারেকটি মিষ্টির দোকান খোলেন। তখন মূলত মিষ্ট বলতে ছিল সন্দেশ।
ওই সময়ে কলকাতা শহরের খানদানি বণিকেরা সন্দেশের বিকল্প কোনো মিষ্ট খুঁজছিলেন। তখনই নবীন চন্দ্র দাস নতুন ধরনের মিষ্টি আবিস্কারের জন্য মনোনিবেশ করেন। সেই সময়ে অর্থাৎ আজ থেকে ১৫১ বছর অাগে ১৮৬৮ সালে নবীন চন্দ্র দাস অাবিস্কার করেন রসনা তৃপ্ত মজাদার 'রসগোল্লা'। তখন মাটির হাঁড়িতে রসগোল্লা যেতো বাড়ি বাড়ি। পরবর্তীতে নবীন চন্দ্র দাসের ছেলে কৃষ্ণ চন্দ্র দাস প্রথম রসগোল্লাকে কৌটাজাত করেন। কৃষ্ণ চন্দ্র দাস 'কে,সি,দাস' নামে বিখ্যাত। কেসি দাসের ছেলে রসগোল্লাকে আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে অাসেন। তৈরী করেন স্পঞ্জ রসগোল্লা।
বিশিষ্ট উড়িয়া সাংবাদিক যযাতি করণ বললেন, যদিও উড়িষা গোড়ায় দাবির ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে ছিল, এখন কিন্তু অ্যাডভান্টেজ পশ্চিমবঙ্গের। কারণ, 'পহলা রসগোল্লার' ইতিহাস যে সত্তর-আশি বছরের পুরনো নয়, সেটা খুব সহজেই প্রমাণ হয়ে যাবে। এই লড়াইয়ে জিততে হলে বরং জগন্নাথ মন্দিরে রসগোল্লার প্রচলনের প্রসঙ্গটাকেই গুরুত্ব দিতে হবে।
উড়িষার বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের এক মুখপাত্র বললেন, মন্দিরে রসগোল্লার প্রচলন বিষয়ক প্রামাণ্য নথি আমাদের কাছে নেই। ফলে,সে পথে হাঁটা মুশকিল। ইতিহাসবিদ হরিপদ ভৌমিক অবশ্য প্রসঙ্গটাই উড়িয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, তিনশো বছর আগে জগন্নাথ মন্দিরে ছানার তৈরি কোনও মিষ্টান্ন ভোগ হিসেবে দেওয়াই যেত না।
রসগোল্লা এখন অার হাতে নয়,তৈরী হয় সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে। যা বাংলাদেশেও ছড়িয়ে গেছে যুগ যুগ ধরে। অাগেই বলেছি এই মজাদার রসগোল্লার জন্ম নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ অার ওড়িষার মধ্যে চলছে বাদানুবাদ। কে জিতবে সে সময়-ই বলবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কলকাতা এ কৃতিত্ব পাওয়ার দাবি করতে পারে। কারণ বাঙালিরা বাড়িতে দুধ থেকে ছানা বা পনির তৈরি করতে শেখে পর্তুগিজদের কাছ থেকে। কাজেই ছানার মিষ্টি বানানোর কলা-কৌশল তাদের হাতেই এগিয়ে গেছে। অাসলে রসগোল্লা বাঙালির,বাঙলার রসনাতৃপ্ত মিষ্টি।
মিষ্টি নিয়ে এই তুমুল যুদ্ধে খানিক হতবাক সৌমিক দাশগুপ্ত। পেশায় ইঞ্জিনিয়র সৌমিক জন্মসূত্রে বাঙালি, কিন্তু দীর্ঘ দিন কটকের বাসিন্দা। নিজেকে উড়িয়া বলেই দাবি করেন এই খাদ্যরসিক। বললেন, এটা অবান্তর তর্ক। আমি পহলা রসগোল্লাও খেয়েছি, আর কলকাতার রসগোল্লাও খেয়েছি। দুটো দুই গোত্রের মিষ্টি। এবার, কোনটাকে আসল রসগোল্লা বলবেন ? আমার মত হল, আসল-নকল নিয়ে মাথা ঘামানোরই দরকার নেই। বরং দুটো গরম-গরম রসগোল্লা খান। এখন মধুরেণ সমাপয়েৎ প্রয়োজন।
সর্বশেষ খবর দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ওড়িষাকে হারিয়ে রসগোল্লার জিআই রেজিস্ট্রেশন আদায় করে নিল পশ্চিমবঙ্গ। জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জিআই জানিয়ে দিল রসগোল্লা পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব সৃষ্টি, তা কোনও ভাবেই ওড়িষার নয়। রসগোল্লার উপকরণ বিবেচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে জিআই।
বাংলা যখন রসগোল্লা জিতে নিল, ঠিক সেই সময়েই জিআই রেজিস্ট্রেশনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে ওড়িষা। রাজ্য সরকারের তরফে এক প্রেস বিবৃতি জারি করে বলা হয়, ৮০০ বছরের পুরনো ওড়িষ্যার রসগোল্লার জন্য জিআই রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে তারা।
রসগোল্লা তুমি কার? এ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে লড়াই চলছিল পশ্চিমবঙ্গ আর ওড়িষার মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব পাঁচ উত্পাদনের 'জিআই' ট্যাগ পেতে আবেদন জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। প্রথম চারটি অর্থাত্ সীতাভোগ-মিহিদানা, তুলাইপাঞ্জি ও গোবিন্দভোগ চাল নিয়ে সমস্যা খুব একটা কখনওই ছিল না। গোল বেধেছিল পাঁচ নম্বর অর্থাত্ রসগোল্লাকে নিয়ে।
রসগোল্লা তাদের নিজস্ব বলে দাবি করে ওড়িষা। তাদের মতে, রথযাত্রা শেষে সাত দিন মাসির বাড়ি কাটিয়ে মন্দিরে ফেরার সময়ে রসগোল্লাই জগন্নাথদেবের 'পাসওয়ার্ড'। স্ত্রী লক্ষ্মীর মান-ভঞ্জন করে মন্দিরে ঢুকতে হয় তাঁকে। হাঁড়ি-ভরা রসগোল্লা দিয়েই বৌয়ের মন গলান তিনি। রীতি মেনে এখনও মন্দিরের সেবায়েতদের একাংশ লক্ষ্মীর হয়ে ঝগড়া করেন। কেন স্ত্রীকে ফেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন জগন্নাথ! রীতিমাফিক এই তর্কে হার হয় জগন্নাথের প্রতিনিধিরই।
মন্দিরে ঢুকতে না-পেরে জগন্নাথ বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন বলে একটা সময়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না মুখ্য দয়িতাপতি। পরের বার এমন ভুল আর করবেন না, বলে স্বামীর তরফে আশ্বাস পেয়ে তবে মন গলে লক্ষ্মী ঠাকরুণের। মন্দিরের রত্নভাণ্ডারের কাছে লক্ষ্মী-নারায়ণের পুষ্পাঞ্জলি পুজোর পরেই রসগোল্লা-ভোগ স্ত্রীকে অর্পণ করেন জগন্নাথ। পুরী মন্দিরের এই ট্র্যাডিশনকে হাতিয়ার করেই ওড়িষার দাবি, রসগোল্লা আসলে উত্কলজাত। আর তাই জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে খাজা-গজার শ্রীক্ষেত্র এখনও এক দিনের জন্য রসগোল্লা-নগরী হয়ে ওঠে। দোকানে দোকানে রসগোল্লা-উত্সবের ধুম পড়ে।
স্বাভাবিক ভাবেই ওড়িষার এই দাবিতে আঁতে ঘা লাগে আমবাঙালির মনে রসগোল্লার 'কলম্বাস' বলে খ্যাত নবীন দাশের বংশধর তথা 'কে সি দাশ'-এর কর্তাদের। দরবার করা হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তাঁদের হিসেব মতো, ১৮৬৮ সালে বাগবাজারের দোকানেই ধবধবে স্পঞ্জ রসগোল্লার উদ্ভাবন ঘটান 'নবীন ময়রা'। তাঁদের অভিযোগ ছিল, জগন্নাথদেবকে সামনে রেখে রসগোল্লা-গৌরব ছিনিয়ে নিতে চাইছে ওড়িষা।
অবশেষে জয় পশ্চিমবঙ্গের। জিতলেন নবীন ময়রারাই। কয়েক দিন অাগে জিআইয়ের স্বীকৃতির ফলে আর কোনও রাজ্য রসগোল্লা তাদের বলে দাবি করতে পারবে না। এ দিনের স্বীকৃতির পরই টুইট করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লন্ডন থেকে মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, ''আমরা আনন্দিত, গর্বিত।'' Sweet news for us all. We are very happy and proud that #Bengal has been granted GI ( Geographical Indication) status for Rosogolla.
সত্যিই আশ্চর্য সমাপতন! মিলল জিআই স্বীকৃতি, ওড়িষা নয়, রসগোল্লার জনক পশ্চিমবঙ্গ।
তথ্যঋণঃ
১.রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল,প্রবন্ধিক।
২. অমর সাহা, সংবাদিক।
৩. ইন্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন