মায়ের দাবী : সমাপ্তি চৌধুরী


মায়ের দাবী

সমাপ্তি চৌধুরী

বারান্দায় বসে স্বামীর ছবিতে হাত বোলাতে বোলাতে চোখটা বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে সর্বাণী দেবীর। মানসপটে ভেসে উঠছে কত রঙিন সুমধুর ছবি। স্মৃতির পাতাও বয়সের ভারে মলীন। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। -----" এই খোকন, এখানে ক্রিকেট খেলে না বাবা,,,, সব গাছ নষ্ট হয়ে যাবে। ---- দৌড়াস না, পড়ে যাবি। --------- যাস না খোকন "।------ না , খোকন কথা শোনে নি।

সব কেমন গুলিয়ে যায় সর্বাণী দেবীর আজকাল। খোকনের ছেলেবেলার কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই বর্তমানে ঢুকে পড়েন। একসময় ভরা সংসার ছিল তাঁর। কিন্তু আজ তিনি অসহায়, একাকিনী। বিপদে-আপদে পাড়ার লোকেরাই ভরসা। এইভাবে পরনির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে মোটেও ভালো লাগে না সর্বাণী দেবীর। সন্তান থেকেও না থাকা। তবে পাড়ার ওই তৃণা বলে মেয়েটিকে বড়ো ভালো লাগে সর্বাণী দেবীর। মেয়েটি মাঝে মাঝে আসে গল্প করতে। আজকাল যেখানে বয়স্ক বাবা- মা-ই সন্তানের কাছে ব্রাত্য, সেখানে অনাত্মীয় এই মেয়েটিকে বড়ো আপনার লাগে সর্বাণী দেবীর।

স্মৃতির ক্যানভাসে পুনরায় চোখ চলে যায়। ছিমছাম ছোট্ট সংসার ছিল তাঁর। স্বামী সরকারি অফিসের কর্মচারী ছিলেন। মফস্বল এলাকায় কম দামে তিন কাঠা জায়গা পেয়েছিলেন। পরে অফিস থেকে লোন নিয়ে সেখানেই তৈরি করেছিলেন 'শান্তিনিকেতন '।হ্যাঁ, সর্বাণী দেবী ও শান্তিলাল বাবু তাঁদের সাধের বাড়িটির নাম রেখেছিলেন 'শান্তিনিকেতন '। সত্যিই সেখানে শান্তির ব্যাঘাত কোনোদিনই ঘটে নি। কিছুদিনের মধ্যেই ঘর আলো করে এসেছিল তাঁদের খোকন। অনেক আশা করে তাঁরা ছেলের নাম রেখেছিলেন 'স্বপ্নদ্যুতি'। ছেলেও তাঁদের নিরাশ করে নি। লেখাপড়া, খেলাধুলা সবেতেই সে তার দ্যুতি ছড়িয়েছিলো।

" কী রে মতির মা, ---- ঘর দুয়োর সব পরিষ্কার হলো? জানিস না আজ কত কাজ?" ----- আজ সকাল থেকেই সর্বাণী দেবীর তাড়া। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, অনেক কথাই আজকাল ঠিকমতো মনে রাখতে পারেন না,,,,,, তবে এই বিশেষ তিথিটি কখনও ভোলেন না। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে এই দিনটিতেই শান্তিলাল বাবু তাঁকে একা করে চলে গেছেন,না ফেরার দেশে। এই দিনটিতে তিনি স্বামীর ছবিতে চন্দন দিয়ে, মালা দিয়ে সাজান। স্বামীর পছন্দমতো রান্না করে খেতে দেন। সারাদিন প্রায় স্বামীর ছবির সামনেই বসে কাটান। আজ তৃণাও জানে যে, সর্বাণী দেবীর মন খারাপ। অফিস থেকে ফেরার পথে কিছু ফুল, মিষ্টি নিয়ে ঢোকে। শান্তিলাল বাবুর ছবির সামনে বসে থাকে দুজনে। আজ ছেলের কথা ভীষণভাবে মনে পড়ছে সর্বাণী
দেবীর।

" বুঝলে সর্বাণী , খোকন আমাদের মানুষের মতো মানুষ হবে "। ----- শান্তিলাল বাবুর বলে যাওয়া কথাগুলো আজও কানের মধ্যে বাজে সর্বাণী দেবীর। হ্যাঁ, খুব বড়ো মানুষ হয়েছে খোকন। এতই বড় যে, বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনেও আসতে পারে নি। " সবে নতুন অফিসে জয়েন করেছি, অনেক বড় পোস্ট, অনেক দায়িত্ব। এখন আমি কিছুতেই ছুটি পাব না। একটু বোঝার চেষ্টা করো। আর তাছাড়া,,, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আমি গেলে কী বাবা ফিরে আসবে?" ------ খোকনের বলা প্রত্যেকটা কথা সেদিন সর্বাণী দেবীর বুকে কাঁটার মতো বিঁধেছিল। পাড়ার লোকেদের সাহায্যেই সেদিন সবকিছু নির্বিঘ্নে মিটেছিল।

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর যখন ওই বিদেশি কোম্পানিতে চাকরির অফারটা আসে, তখনই সর্বাণী দেবী বারবার ছেলের কাছে কাকুতি মিনতি করেছিলেন ওই চাকরিটা না নেওয়ার জন্য। বারবার বলেছিলেন দেশের কোথাও কাজ করতে। কিন্তু তাঁর ছেলে এতবড় সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় নি। শান্তিলাল বাবুও সেদিন বুঝিয়েছিলেন, ছেলের ভবিষ্যতের পথে বাধা না হয়ে দাঁড়াতে। খোকন সেদিন কথা দিয়েছিল যে, ওদেশে কয়েক বছর কাজের অভিজ্ঞতা গেলেই সে দেশে ফিরে আসবে। বাবা মা-ও সেই আশায় দিন গুনছিলেন ।

কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই খোকনের পরিবর্তন বাবা- মা বুঝতে পারছিলেন। ধীরে ধীরে ফোন করা কমতে লাগল। বাড়ি আসার কথা বললেই ছুটি না পাওয়ার অজুহাত। বিদেশের বৈভব, চাকচিক্য তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল যে, নিজের দেশ, নিজের বাবা-মা বড় ব্যাকডেটেড মনে হতে লাগছিল তার চোখে। অর্থের লোভ তাকে ক্রমশ অমানুষ করে তুলছিল। 


তারপর হঠাৎ করেই একদিন খোকন জানিয়েছিল যে, ওরই অফিসের এক বিদেশিনী সহকর্মী এলিনা-কে বিয়ে করতে চায়। প্রথমটা শুনে সর্বাণী দেবী কষ্ট পেয়েছিলেন। " বিদেশিনী বৌমা,,,, সে কি আমাদের আচার অনুষ্ঠান , নিয়মকানুন মানবে? আত্মীয় স্বজনরা কী বলবে? " ------ এসব নিয়ে স্বামীর কাছে অনুযোগ করলে, শান্তিলাল বাবু ঠাণ্ডা মাথায় সবটা বুঝিয়েছিলেন। ছেলে যদি ওর সাথেই খুশি থাকতে পারে তাহলে এতে তাদের কোনো আপত্তি নেই-- একথা তিনি ছেলেকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। সর্বাণী দেবী চেয়েছিলেন নিয়মকানুন মেনে বিয়েটা অন্তত এদেশে হোক।----- " দুজনের একসাথে ছুটি পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাই আপাতত তারা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে নিচ্ছে। পরে দেশে ফিরে অনুষ্ঠান হবে "---------- এমনটাই জানিয়েছিল তাঁদের একমাত্র আশার লতা স্বপ্নদ্যুতি। সে তখন স্বপ্নের রঙিন দুনিয়ায় আবিষ্ট।

সাধ করে বানানো বাড়ির গোল বারান্দায় বসে বসে অসহায় বাবা-মা ভাবতেন কোথায় তাদের খামতি থেকে গেল। তাঁরা কী ছেলেকে ঠিকমতো মানুষ করে তুলতে পারেন নি। ব্যর্থতার গ্লানি যেন তাঁদের কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। একটু একটু করে ক্ষয় হতে থাকলেন অসহায় বাবা-মা। চাপা স্বভাবের শান্তিলাল বাবু গুমরে থাকতে থাকতে একসময় সব আশা ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি দিলেন।

বর্তমানে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়েছে। ধীরে ধীরে অসহায়তা, একাকীত্ব যেন গ্রাস করে ফেলেছে সর্বাণী দেবীকে। এখন তো আর অভিযোগ করার মতো কেউ নেই। কার সঙ্গেই বা দুটো মনের কথা বলবেন। সারাদিন প্রায় বোবা হয়েই থাকেন। স্মার্ট ফোনেও তেমন পারদর্শী নন। বারান্দায় বসেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে। এরকমই এক নির্জন দুপুরে, বোবা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে যখন আনমনে স্মৃতির পাতা হাতড়াচ্ছিলেন,,,,, ঠিক তখনই কাছে এসে আলাপ করেছিল তৃণা। এর আগে প্রায়ই মেয়েটিকে রাস্তা দিয়ে একমনে হেঁটে যেতে দেখতেন। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হলে একটু হাসি বিনিময় হতো। সেদিন প্রথম আলাপে তৃণা জানিয়েছিল অল্পবয়সে বাবা- মা- কে হারিয়ে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে সে। এখন সে একটা এন.জি.ও- র সঙ্গে যুক্ত। একাই থাকে। প্রথম আলাপেই মেয়েটির প্রতি মায়া জন্মে গেছিল সর্বাণী দেবীর। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা। তৃণার সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রায়ই খোকনের কথা ভাবেন সর্বাণী দেবী।

বছর দুয়েক আগে খোকন হঠাৎ করেই মা-কে জানায়,সে বাড়ি ফিরছে। কথায় আছে-----"বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না " ------ তাই সর্বাণী দেবী আবার নতুন আশায় বুক বাঁধেন। ভেবেছিলেন, মায়ের একাকীত্বের কথা ভেবেই খোকন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রথম বৌমার মুখ দেখবেন বলে, ওনাকে দেওয়া ওনার শাশুড়ির সেই মোটা হারগাছাটা পালিশ করিয়ে রাখলেন। নির্দিষ্ট দিনে খোকন এসে পৌঁছলো----- কিন্তু একা। সর্বাণী দেবী খুব হতাশ হলেন। বার বার জিজ্ঞাসা করলেও খোকন এড়িয়ে যায়। ছুটি না পাওয়ার কথা বলে। 


অনেক বছর পর সর্বাণী দেবী নিজের হাতে রান্না করে ছেলেকে খেতে দিয়েছেন। পাশে বসে ছেলেকে খাইয়ে মায়ের অতৃপ্ত মন অনেক বছর পর তৃপ্ত হচ্ছে। কথায় কথায় খোকন জানালো যে, মা-কে সে আর একা রাখতে চায় না। তাই মা-কে সে সাথে করে নিয়ে যেতে চায়। তবে যাবার আগে সে তাদের 'শান্তিনিকেতন ' বাড়িটা বিক্রী করে দিতে চায়। সর্বাণী দেবী সেটা কিছুতেই মানতে পারেন নি। তিনি তাঁর স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত এই শান্তির নীড়টি কিছুতেই নষ্ট করতে চান নি। ধীরে ধীরে ছেলের কথাবার্তায় বুঝলেন বৌমা সন্তানসম্ভবা। তিনি ভালোকরেই বুঝলেন এইসময় কেন ছেলের মায়ের কথা মনে পড়েছে। তিনি পরিষ্কারভাবে ছেলেকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি যতদিন বাঁচবেন তাঁর শান্তিনিকেতন ছেড়ে কোথাও যাবেন না। যদি সম্ভব হয়, তাহলে ছেলে বৌমা এখানে এসে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারেন। এ নিয়ে মা-ছেলের যথেষ্ট মনোমালিন্য হয়েছিল। অবশেষে যাওয়ার দিন সর্বাণী দেবী সেই হারগাছাটা ও আরও কিছু গয়না আশীর্বাদ স্বরূপ ছেলের হাতে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর থেকে ছেলে আর কোনো খোঁজ খবর রাখে নি।

#############

অনেকবার বেল বাজিয়েও সাড়া না মেলায় মতির মা পাশের বাড়িতে গিয়ে খবর দিল। সবাই মিলে ডাকাডাকি করেও যখন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন সবাই মিলে দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক সেইসময় তৃণাও এসে উপস্থিত হলো। দরজা ভেঙে দেখা গেল সর্বাণী দেবী মেঝেতে পড়ে গোঙাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ডেকে, ওনার কথামতো হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। ছেলেকে কোনোভাবেই খবর দেওয়া সম্ভব হয় নি। ততদিনে সে তার ঠিকানা বদলে ফেলেছে। ডাক্তার জানালেন ওনার একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। ডানদিকটা প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। পাড়ার লোকেরাও চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

ক্রমে পাড়ার লোকেদের যাতায়াত কমতে লাগল। বৃদ্ধা, পঙ্গু সর্বাণী দেবী এখন বড় অসহায়। এমতাবস্থায় একটি অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে পাড়ার লোকেদের কাছে আসে তৃণা। সে জানায় যে, সর্বাণী দেবীকে সে দত্তক নিতে চায়। সবাই শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলে তৃণা বুঝিয়ে বলে
------ যেমন ছোট্ট শিশুকে অনেক দম্পতি সন্তান হিসেবে দত্তক নেয়, ঠিক তেমনিভাবে তৃণা সর্বাণী দেবীকে 'মা' হিসেবে দত্তক নিতে চায়। বিদেশে এসবের চল থাকলেও, আমাদের দেশে এ সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুব স্বচ্ছ নয় এবং এ সম্বন্ধীয় আইন কানুনও বিশেষ নেই। তথাপি, লোকাল থানায় একটু জানিয়ে, মানবিকতার খাতিরে সকলেই তৃণার প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। তৃণার যত্নে ও সাহচর্যে ক্রমে সর্বাণী দেবী সুস্থ হয়ে উঠলেন। একদিকে যেমন অল্পবয়সে বাবা মা-কে হারানো তৃণা নতুন করে মা পেলো, অন্যদিকে আবার অসহায়, একাকিনী বৃদ্ধা আবার নতুন করে মাতৃত্বের স্বাদ পেলেন।

আজ 'শান্তিনিকেতন ' বাড়িটি অনেক বছর পর নতুনভাবে সেজে উঠেছে। সকাল থেকেই ব্যস্ততা তুঙ্গে। সর্বাণী দেবী আজ আবার শান্তিলাল বাবুর ছবির সামনে বসে আছেন। মনে তাঁর অনেক প্রশ্ন। ঠিক-ভুলের হিসাব কষতে আজ আর তিনি চান না। তাঁর বিশ্বাস শান্তিলাল বাবু তাঁর পাশেই আছেন। বাবা- মা হিসেবে তাঁরা তাঁদের সমস্ত কর্তব্য পালন করেছেন। এখন থেকে তিনি নিজের ইচ্ছেয় বাঁচবেন। নিজের মতো করে বাঁচবেন এবং তাঁর মতো অসহায়দের নতুনভাবে বাঁচার প্রেরণা যোগাবেন।

বৃদ্ধা সর্বাণী দেবী যখন তাঁর বাড়িটি নব কন্যা তৃণার নামে লিখে দিতে চাইলেন, তখন তৃণা তা নিতে অস্বীকার করে। কোন অধিকারে বা কোন দাবীতে সে এই বাড়ি নেবে--একথা জানালে, সর্বাণী দেবী জানান 'মাতৃত্বের দাবীতে'। তৃণার সাহচর্যেই আজ সর্বাণী দেবী নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন,তাই মা হিসেবে এটুকু করতে পারলে তিনি শান্তি পাবেন। তখন তৃণাই প্রস্তাব দেয় এটিকে বৃদ্ধাবাস হিসেবে গড়ে তুলতে। সর্বাণী দেবীর মতোই বহু অসহায় বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের ঠিকানা আজ "শান্তিনিকেতন বৃদ্ধাবাস "।আজ এই বৃদ্ধাবাসের একবছর পূর্ণ হলো। সেই উপলক্ষ্যে একটি ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে তৃণা। তৃণা নিত্যনতুন কাজের মধ্যে দিয়ে তার এই একগুচ্ছ বাবা-মা কে নতুনভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণা যোগায়। " শান্তিনিকেতন " বাড়িটি এখন প্রকৃত অর্থেই শান্তির নিকেতন হয়ে উঠেছে।

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.