![]() |
তিনটি কবিতার বই -- এক চিরায়ত জার্নি : নীলাদ্রি দেব |
কবিতা? সে পরে হবে. এসো, আপাতত 'লোকসংগীত শুনি'
কবি সুবীর সরকার বাংলা কবিতার গুরুত্বপূর্ণ নাম. নয়ের দশকে লিখতে আসা এ কবি উত্তরের লোকজীবনের সাথে জড়িয়ে আছেন তীব্র ভাবে. ত্রিশ বছরের বেশী সময় ধরে কবিতা গদ্য সহ বিভিন্ন ধারায় অনায়াস যাতায়াত করেছেন. 1996সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় কবিতা পাক্ষিক থেকে, 2019এ সাম্প্রতিক কবিতা বইটি আলোপৃথিবী প্রকাশনীর লোকসংগীত শুনি. কবিতার নিজস্বতা চিনিয়ে দেয় কবিকে. তবু প্রায় প্রতিটি বইতেই নিজেকে ভাঙছেন, আবার নতুন করে গড়ে তুলছেন কবি. মেদহীন, বহুমাত্রিক কবিতাগুলোকে শুধু কবিতা বলে ভেবে নেওয়া ঠিক হবে না. কারণ কবিতাগুলির ভেতর লুকিয়ে আছে আরও অজস্র কবিতা. কবি সচেতন ভাবে কবিতার জন্য নিজেই করে দিচ্ছেন একটি পরিমিত আড়াল. পাঠকের সাথে কবিতার অক্ষর থেকে অক্ষর ছুঁয়ে যেতে যেতে কবি দেখিয়ে দিচ্ছেন অদ্ভুত এক সুতোর বুনোট. যে বুনোটে কৃত্রিমতা নেই, মেকিপনা নেই, ইচ্ছে মত গুঁজে দেওয়া আধুনিকতার ফ্লেভার নেই. কিন্তু ভীষণরকম সতেজ এবং আপডেটেড. কবিতা বইটিতে আছে আঠারোটি কবিতা. যে কবিতাগুলো এক নিঃশ্বাসে পড়ে নেবার পরও মনে হবে, আরও একবার... এইভাবে 18 টি কবিতা 18 বার করে পড়লেও পুরনো হবে না. শুধু পুরনো হবে না, তাই-ই নয়, নতুন নতুন দিক উঠে আসবে প্রত্যেকবারের পাঠে. বাকি অভিজ্ঞতা আপনার, আপনাদের পাঠপ্রতিক্রিয়া থেকে জেনে মিলিয়ে নেবো আমি. আপাতত কিছু পংক্তি রাখছি. পড়ে নিন.
"ইশারায় ইশারায় কথা বলি / ফন্দি থেকে সরে যাচ্ছে ফিকির"
"চোখ মানে তো আস্ত এক সাদা / কাগজ / মায়ার ভেতরেই থাকিI আর ঝিঁঝিরা গান / হয়ে বাজে"
"সুপারির ছায়ায় আমাদের আত্মগোপন / 'কবিতা এক ধরনের গেরিলাযুদ্ধ' ..."
"প্রতিটি সেমিনার আদতে অসুখ ও আরোগ্য / বিষয়ক"
একটি সম্পূর্ণ কবিতা.
" 'আমাদের দেখা হবার কথা একটা বাঁশবনের / ভেতর' / এরপর জখম বাঘের গল্প / ছুটে আসে রাইফেলের গুলি " (বাঘ 2)
এরপর? কবিতাগুলোকে জড়িয়ে নেবার জন্য কবিতা বইটি সংগ্রহ করা প্রয়োজন. আর হ্যাঁ, আমাদের প্রাণের সাথে মিশে যাওয়া লোকসঙ্গীতের, লোকজীবনের ছাপ বইয়ের প্রচ্ছদেও রয়েছে. প্রচ্ছদশিল্পী শ্রীহরি দত্ত তাঁর তুলির ছোঁয়ায় এমন এক লোকবাদ্য ফুটিয়ে তুলেছেন যার প্রতিটি স্পন্দন বলে উঠছে,
এসো, 'লোকসংগীত শুনি'.
লোকসংগীত শুনি
আলোপৃথিবী
প্রচ্ছদ- শ্রীহরি দত্ত
40 টাকা
জীবনের সাথে জুড়ে থাকা দীর্ঘ এক কবিতায় চতুর্থ পর্ব সংযোজন করলেন কবি
"এত চলে যাওয়া তবু খিদে পায় / দাঁত নখ মাংসের হাড় চিবোতে চায় /... " উৎসর্গ পৃষ্ঠায় কথাগুলি লিখছেন কবি পাপড়ি গুহ নিয়োগী, তাঁর সাম্প্রতিকতম কবিতা বই 'ফিরতে চাই ডাকনামে'তে. বাংলা কবিতার পাঠক পরিচিত এই কবির সাথে, কবির কবিতার সাথে. বাঘছাল গন্ধের মেয়ে, শূন্য আঁকি মৃত্যু আঁকি, নাভিজল- এর পর পাপড়ি পাঠকের কাছে তুলে দিলেন এমন একটি বই যেখানে পরিবার সমাজ রাজনীতি সবটা মিলেমিশে নিজস্ব প্রতিবিম্বের সামনে দাঁড়াতে বাধ্য করল আমাদের. আমরা দাঁড়িয়ে দেখলাম আমাদের চারপাশের যাবতীয় সুখ এবং অসুখের খণ্ডচিত্র, পাপড়ির বয়ানে. অর্ধেক আকাশের কবিতা কিন্তু পাপড়ির এতদিনের কবিতাযাপনে সেভাবে দেখা যায় না. বরং দেখা যায় সমস্ত ক্যানভাস জুড়ে একটা বিরাট আকাশ. আর যে আকাশে পাপড়ি স্বাধীনতা চাইছেন না, স্বাধীনতা উদযাপন করছেন. এই স্বাধীনতায় যন্ত্রণার ছবি স্পষ্ট হচ্ছে, কখনো তা অতিক্রমের. মেদহীনতায় এ কবিকে চেনা যায়, চেনা যায় নিজস্ব ভাষা ব্যবহারে. দুটো বইয়ের মাঝে খুব কম সময়ের ব্যবধান, নিজস্ব স্বর ও ভাষার প্রয়োগ, চিত্রকল্প ভাবনা বিষয়বস্তুর স্বতন্ত্রতা, এত সব কিছু মাথায় নিয়ে দু মলাটের মাঝে নিয়ে আসা কবিতার নির্বাচন নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ. পাপড়ি সেদিকে গভীর ভাবে নজর দিয়েছেন. মাত্র পাঁচটি কবিতা দিয়ে সাজিয়েছেন তার চতুর্থ বই. কবিতা নয়, আপনি বুলেটও বলতে পারেন. এ সংখ্যক বুলেট দিয়ে কিভাবে ঝাঁঝরা করে দিতে হয় পাঠকের চিন্তাশীল মগজ, কবি জানেন. তা ছাপ রাখে তাঁর কবিতায়. অপেক্ষা, স্তব্ধতা, ফিরতে চাই ডাকনামে, পদবিহীন, ক্লোরোফিল যুবক. ঘন হয়ে দাঁড়ায় ক্রমশ. গোল হয়ে দাঁড়ায় ক্রমশ. জাপ্টে ধরে. পাঠক হিসেবে নতজানু হই কবি পাপড়ি গুহ নিয়োগীর কবিতার কাছে. প্রথম দশকের ব্যতিক্রমী স্বরের কবি আগামীর জন্য তৈরি করে রাখেন এক তুমুল আগ্রহ. তাঁর লেখায়, কবিতায়. তিনি লেখেন,
"শহর ছেড়ে চলে গেলে তুমি
অথচ ঠিকানা বদল হল না আমার
এখন পদবিহীন অন্ধকার হেঁটে বেড়াই
এ বয়সে দুঃখ! ধুর, সে তো নিজেরই পোষা বেড়াল"
সংগ্রহযোগ্য এই বইটির প্রকাশক আলোপৃথিবী. প্রচ্ছদ শিল্পী শ্রীহরি দত্ত. যিনি কভারের লাল, কালোর দ্যোতনার মধ্যে দিয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছেন পাঠকের মগ্নতা. সাধারণ একজন পাঠকের এই আলোচনা দিয়ে পুরো বইটি বুঝতে পারবেন না. বুঝতে চাইলে আজই সংগ্রহ করুন.
ফিরতে চাই ডাকনামে
আলোপৃথিবী
প্রচ্ছদ- শ্রীহরি দত্ত
30 টাকা
কবি দীপায়ন পাঠকের প্রথম কবিতা বই মরফিন প্রকাশ পেয়েছে খুব সম্প্রতি. দু মলাটের মাঝে দীপায়ন যে বারোটি কবিতা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন, তা শুধু পাঠককে ছুঁয়েই যাবে না, একটা ঘোরের মধ্যে রেখে দেবে. হয়তো লেখাগুলোও কবিতা হয়ে উঠেছিল কোনো এক ঘোরেই. এক ফর্মার কবিতা বই. তাতে বারোটি কবিতা. মানে দুই ওভারের ম্যাচ এবং সেই ম্যাচে টানা ব্যাট করে গেছেন কবি. কোনো ডট বল আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায় না. কবিতাগুলো পড়তে পড়তে বোঝা যায় খুব সহজ এবং সরল ভাষায় যান্ত্রিকতাকে দূরে সরিয়ে এক নিজস্ব ভাষার বাঁধন দিয়ে পাঠককে জড়িয়ে ধরতে চাইছেন তিনি. শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছুঁৎমার্গ নেই, তবে ব্যবহারের কারণ সম্পর্কে সচেতন. এমন কিছু শব্দ, পংক্তি উঠে এসেছে, যা পাঠককে সুন্দর কবিতা বলেই কবিতা থেকে অন্য কবিতায় চলে যেতে দেবে না. দুটো কবিতার মাঝে থেকে যাবে নীরবতা. যা হয়তো নিজেই একটি কবিতা. দীপায়নের কবিতায় এই নীরবতার অংশতে অনেক অনেক প্রশ্ন উঠে আসে, সমাজচিত্র স্পষ্ট হয়ে আসে. হ্যামার করে রীতিমত. চিত্রকল্পগুলোতে এক নির্লিপ্ততার ছাপ আছে, যা হয়তো দীপায়ন ক্যারি করেছে প্রায় বারোটি কবিতাতেই. এর মধ্যে দিয়েই আগ্রহ ধরে রেখেছে বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত. স্বতন্ত্রতা, বোধ, পাঠককে আটকে রাখার মত সহজাত গুন নিয়ে কবি প্রথম বইয়েই পাঠক মনে গভীর ছাপ রাখবেন বলে আমার বিশ্বাস. বাংলা কবিতা পরিবারে প্রায় নতুন সংযোজন দীপায়ন পাঠক. পাঠক কবিকে, কবির কবিতাকে ছুঁয়ে দেখুন. অন্য এক ফ্লেভার শুধু পাবেন, তাই নয়. হয়তো পাবেন সময়ের কথা সময়েই বলতে চাওয়ার মত আরও একজন কবিকে. তাই আলোপৃথিবী প্রকাশনীর মরফিন আপনাকে সংগ্রহ করতেই হবে. কিনুন. বইটি কিনুন. আপনার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখে দেবার মত একটি বই. যার প্রচ্ছদ করেছেন শ্রীহরি দত্ত. যে প্রচ্ছদ রং শৈলী চিন্তা চেতনা টাইটেল ও কবিতাগুলোর অদ্ভূত সমন্বয়ে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে.
এত কিছু বললাম. আর একটু কবিতার স্বাদ দিলাম না? দেবো. কিন্তু খুব কম. বাকিটা বইয়ে. শুধু বইয়ে.
আপাতত...
"বেশ্যাবাড়ী ঢোকার সাহস হয়নি
মনের ভেতরই গড়ে উঠেছে বেশ্যালয়
...
সে ঘরে আলো ঢোকে না পুণ্যের ভয়ে
..."
মরফিন
প্রকাশক- আলোপৃথিবী
প্রচ্ছদ- শ্রীহরি দত্ত
30 টাকা
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন