স্কুলের পরিবেশ নিয়ে পাগলা দাশুর গল্প অতীব চমৎকার যিনি পড়েন নি, কি যে মিস করেছেন ! সুকুমার রায় আমাদের পাঠশালা সম্পর্কে সেরা গল্পটি লিখে গিয়েছেন।
"খোঁড়া মুচির পাঠশালা" নামে একটা লেখা পেয়েছিলাম সুকুমার রায়ের কলমে। শিক্ষক ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন রবিদাস। যাঁরা মুচির কাজ করেন, তাঁদের রবিদাস বলা যায়। এই মুচি শিক্ষক জীবনে অনেক কৃতী ছাত্র তৈরী করেছিলেন। রাস্তায় দেখা হলেই ছাত্ররা তাঁকে প্রণাম করত। তাঁর অন্নসংস্থানের দায়িত্ব নিতে চাইত। মুচি ভদ্রলোক রাজি হতেন না। নিজের পেশায় থেকেই তিনি শিক্ষকতা করে যেতেন। এই রকম শিক্ষকের কথা লিখেছেন বলে সুকুমার রায়ের উপর আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা।
"কাক পণ্ডিত" নামে একটা গল্প আমাদের পাঠ্য ছিল। গল্পের লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ।
সুশিক্ষিত জমিদার গিয়েছেন পাঠশালা সন্দর্শনে । তার সামনে হাত কচলাচ্ছেন শিক্ষক । আদ্যন্ত গ্রাম্য আচরণে ভরপুর একজন শিক্ষক ।
পাঠশালার কথায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা মনে পড়বে না, তাও কি হয়?
"বিন্দুর ছেলে" উপন্যাসে বিন্দুর ননদ ভাজে গল্পগাছায় ননদ দাবী করে বসল মাস্টাররা সব ঘুষ চায়। ঘুষ না দিলে পাশ করায় না।
ওই "বিন্দুর ছেলে" উপন্যাসেই বিন্দু তার জায়ের ছেলে, যাকে নিজের ছেলের অধিক করে মানুষ করত, তাকে পাঠশালায় পাঠাবার জন্যে কত রকম উদ্যোগ নিয়েছে। তার পর গোটা পাঠশালাটাকেই নিজেদের চণ্ডীমণ্ডপে তুলে আনার ব্যবস্থা করেছে। বড় জা , যে বাচ্চাটার প্রকৃত মা, সে কারণ জানতে চাইলে বলেছে পোড়োরা যদি ওর বাচ্চার চোখে খুঁচিয়ে দেয় !
সত্যি নয়, যদি।
পাঠশালা নিয়ে ভাবতে গেলে শরৎচন্দ্রের "পল্লী সমাজ" উপন্যাসের কথাও ভুলতে পারছি কই! সেই যে রমেশ ছিল, সে-ই পল্লীর বিধ্বস্ত পাঠশালাটিকে সারিয়ে দেবার উদ্যোগ নিয়েছে শুনে রমা মনে মনে খুব খুশি হয়েছিল।
সেই যে পাঠশালা নিয়ে বলছিলাম, পাঠশালাগুলির হালচাল , সেই নিয়ে "প্রশান্তি" পত্রিকার তরফে সম্পাদক দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য , যিনি একটি বিদ্যালয়ের সংস্কৃত শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁর বাড়িতে সভা ডেকেছেন শুনে যেতে খুব ইচ্ছে করেছিল। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পালকির গান কবিতাটা মনের মধ্যে বাজছিল। "গুরুমশাই দোকান করে, পাঠশালাটি দোকান ঘরে।" হরিহর রায়ের ছেলে অপুর অভিজ্ঞতার সাথে কি আশ্চর্য মিল! দোকান ঘর ও পাঠশালার অভিন্নতা আমাকে আশ্চর্য করে।
কয়েক দিন আগে জুন ২০১৮ এর প্রথম রবিবারে আমাদের বরানগরে একটি সাহিত্য সভা হবার কথা শুনেছিলাম। বিষয় ছিল "সাহিত্যে পাঠশালা" ।
"প্রশান্তি" পত্রিকার তরফে সম্পাদক দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য , যিনি একটি বিদ্যালয়ের সংস্কৃত শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁর কাছে সংবাদটি শোনা মাত্র আমার পথের পাঁচালির হরিহর রায়ের ছেলে অপুর প্রথম পাঠশালা অভিজ্ঞতাটি মনে পড়ল। গুরুমশায় নিজের মুদি দোকানের ভিতরেই পাঠশালা বসাতেন। নুন তেল চিনি বিক্রিও চলছে , আবার পাঠশালাও চলছে। ছাত্ররা একঘেঁয়ে ভাবে মুখস্থ করে চলেছিল ... এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি...। শিক্ষকের পাঠ দেবার পদ্ধতি প্রকরণ দেখে বালক অপু হেসে ফেলেছিল। গুরুমশাই বলেছিলেন, "হাসচো কেন খোকা, এটা কি নাট্যশালা?"
বাংলার পাঠশালাগুলি যে বাস্তবে কি, তা সেই গুরুমশায় বলে গিয়েছেন।
পাঠশালার কথায় বাংলা ভূখণ্ডের সেরা গুরুমশায়ের ছবিটি যিনি এঁকেছেন, তাঁর কথা তো বলতেই হবে। ছোটোবেলায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আর পাঁচটা শিশুর মতো রবিরও নিজস্ব চাকর ছিল। জীবনস্মৃতি লিখতে গিয়ে "ভৃত্যরাজক তন্ত্র" অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, "তাহার নাম ঈশ্বর।" লিখেছেন, 'সে পূর্বে গ্রামে গুরুমশায়গিরি করিত।' এইখানে আমার বুকে ধ্বক করে ওঠে। গ্রামে যে ব্যক্তি পাঠশালার গুরুমশায়ের বৃত্তি অবলম্বন করেছেন, তিনি কি না কলকাতার জমিদার বাড়ির স্রেফ বাচ্চা দেখাশুনার চাকর?
রবীন্দ্রনাথ তাঁর "জীবনস্মৃতি"তে এহেন ভূতপূর্ব গুরুমশায়ের নাম লিখেছেন ঈশ্বর। আবার "ছেলেবেলা" তে এই এককালে গুরুমশায়গিরি করা চাকরটির নাম রেখেছেন ব্রজেশ্বর। তো ঈশ্বর বা ব্রজেশ্বর নামে চাকরটির পুরোনো পেশা গুরুগিরি নিয়ে ঠাকুর বাড়িতে বেশ কৌতুক চালু ছিল। এই ঈশ্বরের সম্বন্ধে "ছেলেবেলা" তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, গুরুমশায়ি ভাষা আর চাল ছিল তার শেষ পর্যন্ত। বলেছেন, ঈশ্বরের ওই সাধুভাষায় বাগবিন্যাসের স্বভাব নিয়ে মনিবেরা হাসাহাসি করতেন। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ঈশ্বরের সাধুভাষার প্রতি লক্ষ করিয়া গুরুজনেরা আড়ালে প্রায়ই হাসিতেন। ঈশ্বরের শুদ্ধিপ্রবণতারও উল্লেখ করেন রবীন্দ্রনাথ। লেখেন, "তাহার সম্বন্ধে আমাদের বাড়িতে একটা প্রবাদ রটিয়া গিয়াছিল যে, সে 'বরানগর'কে বরাহনগর বলে। বলেছেন, ঈশ্বরের মুখের এই সাধুপ্রয়োগ আমাদের পারিবারিক কৌতুকালাপের ভাণ্ডারে অনেক দিন পর্যন্ত সঞ্চিত ছিল।"
যে রবীন্দ্রনাথ পরে শিক্ষার আদর্শ গড়ে তুলতে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তিনি বাল্যকালে নর্মাল স্কুলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হরনাথ পণ্ডিত মশায়ের নামোল্লেখ না করে বলেন, "শিক্ষকদের মধ্যে একজনের কথা আমার মনে আছে, তিনি এমন কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করিতেন যে তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধাবশত তাঁহার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর করিতাম না। সংবৎসর তাঁহার ক্লাসে আমি সকল ছাত্রের শেষে নীরবে বসিয়া থাকিতাম।"
সভ্য সমাজেও কেউ মাঝে মাঝে বেফাঁস কথা বলে বসে। যেমন মাধ্যমিকে প্রথম দশে স্থান পাওয়া একটি ছাত্র বলে বসল , বাঁকুড়া জেলার স্কুলগুলিতে না কি পড়াশুনাই হয় না।
তার্কিক লোকে তখন হইচই করে প্রশ্ন তুলবেন, পড়াশুনাই যদি না হয়, তা হলে বাঁকুড়ারই স্কুলে যুক্ত থেকে তুমি এত ভাল পাশ করলে কি করে?
কেউ তার উত্তর হিসাবে বলে ফেলবে, এক আধজন চমৎকার রেজাল্ট না করে সব ছাত্র যদি ভদ্রস্থ রেজাল্ট করত, তাহলে সেটা মোটের উপর শিক্ষার সুস্থ পরিকাঠামোর জানান দিত। কিন্তু বিপরীতটা হলে তা আর বলা যায় কেমন করে।
সামগ্রিক পড়াশোনার মান জানতে চাইলে লজ্জায় মুখ লুকোতে হয় যে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন