![]() |
রাণার পাখি পোষা : মৃদুল শ্রীমানী |
রাণার খুব পাখি পোষার শখ। কিন্তু বাড়িতে কাকে সেটা বলবে ভেবে পায় না। বাবা শক্ত, ভারিক্কি আর ধারালো চোখ মুখের মানুষ। পাখি পোষার কথা বললেই বলবেন, এখন চুপ করে লেখাপড়া করো। হুঁ, সারা দিন বই মুখে থাকতে কারো ভালো লাগে? নতুন ফ্ল্যাট বাড়িটায় বেশির ভাগ ফ্ল্যাটে কোনো লোক আসে নি। বাবা বলেন, মার্কেট খুব খারাপ। কথাটার মানে আন্দাজে বোঝে রাণা। জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে না। কিনবে কে? কাজের মাসির ছেলেটা বারো ক্লাস না পাশ করেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত। মা একদিন ডেকে ধমকাতে কাজের খোঁজে হরিয়ানা চলে গেল। তবু ছেলেটা তার মাকে পয়সা পাঠাত না। তার পর এই ক'দিন হল ফিরেছে। তার নাকি এখন শরীর খারাপ। তার কথা নিয়ে মাসি আর কিছু উচ্চবাচ্য করে না। কিছু বললে মা যদি তার ছেলেকে আবার ডেকে পাঠায়? রাণা বোঝে এখন সবার হাতে কাজ নেই। কাজ করলেও লোকের অভাব মিটছে না।
মাকে বাবাও ভয় পায়। শেয়ার বাজারে খুব নাকি গোলমাল চলছে। বাবার অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে। সেই নিয়ে বাবা মায়ে মন কষাকষি। মা থাকেন লেখাপড়া নিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। এখানে সেখানে সেমিনার হলে প্লেনে চড়ে হুশ করে বক্তৃতা দিয়ে আসেন। তার জন্যে ল্যাপটপে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানান। মায়ের ঘরে সে সময় যাওয়া বন্ধ। গেলেও পা টিপে টিপে যেতে হবে। রাণা কখনো গিয়ে মায়ের গায়ের গন্ধ একটু শুঁকে আসে। মা ল্যাপটপের স্ক্রীন থেকে চোখ না সরিয়ে এক হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চুলটা এলোমেলো করে দেয়। তাতেই সন্তুষ্ট হওয়া নিয়ম এ বাড়ির ছেলের। দিদা সারাদিন পুজো পাঠ নিয়ে আছে। এক মন্ত্র সারা দিনে কতবার যে বিড়বিড় করবে! একটা গল্প বলার নাম নেই। আজকাল স্নানে খুব অনিচ্ছা দিদার। বলে, শরীর ভালো নেই। মা ধমক দেয়। স্নান করা খুব দরকার। দিদা শক্ত হয়ে কান এঁটে থাকে। মা দূরে গেলে ফিসফিসিয়ে বলে, কে কাকে গবভে ধরেছিল কে জানে! গবভ জিনিসটা কি সেটা কেউ রাণা কে বলে দেয় নি। কিন্তু ও আন্দাজ করে, গবভ জিনিসটা পেটের ভেতর কিছু একটা।
বাবাও দিদাকে ধমকায়। বলে, ভাত আর ডাল আর মাছ খাবেন। শেষে দই। দিদা বলে খিদে হয় না। বাবা বলে, বেশি করে জল খাবেন। দিদা করুণ চোখে তাকায়। বাথরুমে গেলে দিদার কাপড় বদলাবার বাতিক। যত বার যাবে, ততবার বদলাবে। মা থাকলে আচ্ছা করে ধমক দেয় দিদাকে। বলে শুচিবায়ু একটা মনের অসুখ। মায়ের দেখাদেখি কাজের মাসিও দিদাকে বকে। সে অবশ্য বলে ছুঁচিবাই। রাণা একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করল, মা কোন কথাটা ঠিক, শুচিবায়ু না ছুঁচিবাই? মা তখুনি কাজের মাসিকে ডেকে কষে ধমক দিল। আমার এখানে এখানকার ভাষা বলবে। ছোটো ছেলে, তোমার মুখের অশিষ্ট শব্দ শিখছে। সেই থেকে মাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবে না ঠিক করেছে রাণা। কেন না, কাজের মাসি বকুনি খেলে তার মোটে ভাল লাগে না। সেই তো তাকে ওটস এর বদলে পাঁপড় ভাজা করে দেয়, কর্ণ ফ্লেক্সের বদলে চিঁড়ের পোলাও, সুজির মোহনভোগ রেঁধে দেয়। বাবা আর এক রকম। রোজ দিদার সামনে অনেকগুলো মুসম্বি, নাশপাতি, আপেল আর বেদানা ঢক করে বসিয়ে দেয়। বলে, কোনো কথা শুনব না। বিকেলে ফিরে যেন দেখি সব ক'টা খেয়েছেন। দিদার চোখ দিয়ে জল পড়ে। বিড়বিড় করে বলে, এতগুলো ফল একটা মানুষ খেতে পারে? কাজের মাসি তার জন্যে আনে আতা, আনে জামরুল আর কামরাঙ্গা। দিদার ঘোলা চোখে একটু আলো ফোটে।
এ বাড়িতে পাখির কথা কাউকে বলা যাবে না। মা কাজের মাসির হাতে বাজার খরচ দেবার সময় বলে, হিসেব দেবে কিন্তু। তবে মায়ের হিসেব বুঝে নেবার সময় হয় না। একটা কৌটোয় জমে থাকে অনেক খুচরো টাকা পয়সা। একদিন রানা বলেছিল, এই পয়সা তো মা কোনোদিন চায় না। তুমি তো নিয়ে যেতে পারো। কাজের মাসি বলে, ছি! তিনি তো বিশ্বাস করে আমায় দেন। বিশ্বাস ভাঙতে নেই। রাণা ভাবে, বিশ্বাস পদবীও হয়, আবার কর্তব্যও হয়। লোকে ভগবানেও বিশ্বাস করে। বিশ্বাস অনেক রকম।
নিরুপায় হয়ে কাজের মাসির কাছেই পাখির কথাটা পাড়ল রাণা। বলল, মাসি, তোমার কৌটোয় তো অনেক টাকা জমেছে, দাও না পাখি কিনে? সে আঁতকে উঠে বলল , পাখি? খবরদার, ও মতলবটি করুনি বাছা। পাখি পোষা দেখলে তোমার মা আমায় বাছা বাছা গাল দেবে। রাণার মনে পড়ল, রেগে গেলে মা বলে স্টুপিড, ননসেন্স, ইডিয়ট। স্কুলে নিজেদের মধ্যে অনেক ছেলে গালি দেয়। রাণা সেগুলো কানে নেয় না। ওগুলো কোনোটা চার অক্ষর, কোনটা ছয় অক্ষর। বাবা একদিন কাকে ফোনে বলছিল লাভ ইজ এ ফোর লেটার ওয়ার্ড। রাণা জানে লাভ মানে ভালোবাসা। মিতু পিসি এসেই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, রাণা, আই লাভ ইউ। পিসি চলে গেলে বাবা বলে, বড় হচ্ছিস। ক্লাস ফাইভে পড়িস, মিতু জড়াতে চাইলে রিফিউজ করবি। আশ্চর্য, ভালোবাসা শব্দও তো চারটে অক্ষর দিয়ে বানানো। এটাও কি ফোর লেটার ওয়ার্ড নয়? চিন্তায় পড়ে যায় রাণা। সে পাখিকে ভালবাসবে। পাখি বড় নরম প্রাণী। তাদের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা নেই। কথাটা ভেবে আবার সংশোধন করতে ইচ্ছে হল। না, যে কোনো পাখি নয়, যারা ইঁদুর ছুঁচো খায় তারা তো নয়ই, টিয়া ময়না চন্দনা বুলবুলি, পোষার জন্যে এই ভাল।
একদিন মায়ের কাছে তার এক ছাত্রী এল। ডক্টরেট হয়েছে, তাই মাকে প্রণাম করতে এসেছে। মা আগে ভাগে ফোনে বলে রেখেছে, আসছ এসো, কিন্তু নো গিফট। তোমার হাসি মুখটাই যথেষ্ট।
ছাত্রী এল। একটা বেলফুলের গোড়ে মালা এনেছে। মা সেটা টপ করে খোঁপায় জড়িয়ে নিল। মাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে। ছাত্রীটি মাকে জিজ্ঞাসা করল, ও ম্যাম, রাণা কে একটু কিছু কিনে দিই না। ছেলে মানুষ। রাণা মায়ের দিকে করুণভাবে তাকালো। দিনের মধ্যে কতবার সে ছোটো ছেলে আর ধাড়ি ছেলে আখ্যা পায়। সে যে ঠিক কি, কচি না পাকা, নিজেই ঠাহর পায় না।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন