আত্মপ্রত্যয় : ঈদারুল ইসলাম

আত্মপ্রত্যয় : ঈদারুল ইসলাম
আত্মপ্রত্যয় : ঈদারুল ইসলাম

ছেলেটির বয়স বছর ৩৫ শে'র  হবে।
সে ছিল বেশ মজাদার,প্রফুল্ল,সর্বদাই মুখে হাসি লেগেই থাকত ।
শত অভাব অনটনেও সে সর্বদাই হাসতো আর হাসাতো।
তাঁর এই অদ্ভুত স্বভাবের জন্য অল্পবিস্তর সময়েই সে সকলেরই প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠে।
এমন কোনও কাজ ছিল না যেটা সে করতে পারত না।
ইলেক্ট্রিসিয়ান থেকে শুরু করে পাইপলাইন বসানোর কাজ সব ই তাঁর নখদর্পণে ।
দিনে দিনে তাঁর কর্ম নৈপুণ্য বেড়েই চলছে।
হঠাৎই তাঁর তল পেটে ব্যথা শুরু হয় ।
চিকিৎসকেরা লক্ষণ দেখে প্রাথমিকভাবে অনুমান করে যে ইন্টেস্টাইন এর টিউমার।
বিভিন্নভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানানো হয় যে 'কর্কটরোগ (ক্যান্সার)-এর শিকার ।
হাতে সময় খুব একটা নেই।
যৎসামান্য সঞ্চয় নিয়েই সে ব্যাংগালরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ।
কেমোথেরাপির শুরুতেই অর্থের অভাবে একটি মাত্র ডোজ নিয়েই ফিরে আসে।
বাড়িতে ফিরে অনেক কষ্টেসৃষ্টে আরও দুটো কেমোথেরাপির ডোজ নিয়েই আর আর্থিক জোগান হয় নি।
সে বুঝে গেছে যে হাতে গোনা কয়েকটি দিনই বাকি।
তবুও কী অদম্য মনোবল,বিয়ে বাড়ির একটা বড় প্যান্ডেলের কাজ নেওয়া ছিল।
আমি বল্লেম - বাবা দ্যাখ তোর তো শরীর'টা খুব একটা ভাল নেই ,তুই না হয় ক'দিন রেস্ট নে।
সে মৃদু হেসে বলে উঠল -"মামা চিন্তা করনা,আমি এত সহজেই মরব না। কাজটি শেষ হওয়ার আগেই আমি মরব না।"
আমি ওর চোখের দিকে তাকাতেই পারলাম না।
মনে মনে কেবলই  ভাবলাম তুই কে রে বাবা,এত আত্ম-শক্তি আসে কোত্থেকে ..!
ক'দিন বাদে জানতে চাইলাম - "কী রে বাবা তুই তো আর দুটো কেমোথেরাপি  নিতে পারতিস ?"
কিছুক্ষণের জন্য মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলে ওঠে -"এত টাকা আর পাব কোথায় ?
সম্বল বলতে ওই তো তিনটি রুমের টিনের ছাউনি দেওয়া একটি  ঘর বাড়ি ,আর একটি বাইক ,সেটাও যদি বেচে দি তো বাচ্চা দুটোই বা যাবে কোথায় ?"
আমি বল্লেম - "এই রোদ মাথায় নিয়ে ধান নারছিস কেন ? একটু রেস্ট নে।"
সে একটু ভাবুক হয়েই বলে উঠল - "সময় খুবই কম মামা । এক বছরের জন্য ওঁদের আর খাবারের অভাব হবে না।"
আমি আবার মনে মনে বলে উঠলাম -"তুই কে রে বাবা ? এতটা মনোবল কি ভাবে আসে তোর,  কিভাবে ?"
কিন্তু ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবার সাহস আমার হয় নি।
আবার বলে উঠলাম - "দ্যাখ না বাবা আর দুটো কেমোথেরাপির ব্যবস্থা হয় কী না ?
আমার সেই সামর্থ্যও নেই যে একটা কিছু করব।"
ক্যানসারের চিকিৎসা বলে কথা,তাও শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে ।
আমি বল্লেম- "আমি কী একবার চেষ্টা করে দেখব যদি সবাই মিলে একটু সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে ?"
সে কিছুক্ষণের জন্য চুপ থেকে বলে উঠল- "না মামা ছেড়ে দাও।"
আমি বুঝতে পারলাম যে সে কারও করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে চায় না।
আমি আবার বল্লেম - "দ্যাখ না যদি অন্য কোনও ভাবেই ....!"
এবার সে মৃদু হেসেই বলে উঠল - "আরে মামা মেয়েটার বিয়ের জন্য...!"
কথা শেষ করতে পারল না। হঠাৎই ওর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে গিয়েছে ।
আমি আবার ভাবতে লাগলাম- "তুই কী রে বাবা..!"
শেষ রক্ষে আর হল না !
ক'দিন পরেই সে চিরতরে চলে গেল ।
শেষ বারের জন্য একটু দেখতে গেলাম।
ওঁর প্রাণহীন নিথর দেহটি বারান্দায় পড়ে রয়েছে।
ওঁর স্ত্রীর কান্না আমায় দেখে আরও বেড়ে গেল ।
নিজেকে সংযত করতে না পেরে দ্রুত বেরিয়ে এলাম।
ছোট্ট ছেলেটি বাবার মোবাইলের  ছবি গুলো সবাইকে দেখাচ্ছিল ।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবলাম - "তুই জানিস না ,যে তুই আজ কী হারিয়েছিস !"
ক'দিন পরেই জানতে পারলাম যে পরিত্যক্ত কিছু কাগজের টুকরো থেকেই একটি ব্যাংকের পাস বই পাওয়া যায়,আর লাস্ট আপডেটে উল্লেখ রয়েছে যে     ₹ ৬৮,০০০ জমা আছে।
হয়তো এটাই তাঁর মেয়ের বিয়ের জন্য গচ্ছিত অর্থ ! যেটা এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার তাঁর সন্তানের প্রতি ভালোবাসা  আর দায়বদ্ধতার প্রতীক।
আর সেটাই সে কাউকেই বলতে চায় নি ।
ইচ্ছে করলে ওই টাকায় আরও দুটো কেমোথেরাপি নিতেই পারত।
কিন্তু সে বুঝেই গিয়েছে যে তাতে খুব একটা লাভজনক কিছুই হত না....!
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.