কেঁপে ওঠার দিন রাত্রি : মৃদুল শ্রীমানী

কেঁপে ওঠার দিন রাত্রি : মৃদুল শ্রীমানী
কেঁপে ওঠার দিন রাত্রি : মৃদুল শ্রীমানী

নীপা ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠলো । অন্যদিন শতদল এ সময় তাকে স্পর্শ করে থাকে । কেমন একটা হারিয়ে যাবার উদ্বেগ কাজ করে নীপার মধ্যে । সেই অনেকদিন আগে বাবা মা তাদের সব ক’টা ভাই বোনকে নিয়ে ট্যুরে গিয়েছিলেন। সেবার দিল্লি শহরের একটা বিশাল মল এ ঘুরতে গিয়েছিল সে। তখন ক্লাস টুয়ে পড়ে। বাথরুম পেতে সকলে মিলে সেখানে ঢুকেছিল । সে জায়গাটাও কি চমৎকার । তার পর বেরিয়ে আর কেউ খেয়াল করে নি যে ছোট্ট নীপা সকলের সাথে আছে কি না। ছোট্ট মানুষটা দরজার লক খুলতে পারছিল না আর বাথরুমের ভেতরে আটকা পড়েছিল। তারপর অন্য একজন বাইরে থেকে খুলে ঢুকলে নীপা বাইরে এসে অবাক। মা কই? পিসিমণি কই? কেউ তো কোথাও নেই । ভয়ে বুক উড়ে গিয়েছিল তার। 

এদিকে বাবা মা আর সকলে হই হই করে এগিয়ে গিয়েছেন। সবার ছোটো মেয়েটা যে কোথায় পড়ে রইলো কেউ খেয়াল করেন নি। আর একটা বড়ো দোকানে সবাই আহ্লাদ করে নীপার জন্যে একটা চমৎকার শাদা জামা পছন্দ করছিল । এটা পরলে নীপাকে নিশ্চয় স্নো হোয়াইটের মতো লাগবে। জামাটা নীপার গায়ে খাপ খায় কি না লক্ষ্য করতে গিয়ে সবার চক্ষু চড়কগাছ । নীপা কোথায়?
ওদিকে নীপা বাইরে বেরিয়ে যাদের দেখতে পেল তারা কেউ বাংলা জানে না। নীপা তাদের ভাষা বুঝছে না। তারাও নীপার কথা কিছু বুঝছে না। ক্লাস টু’র মেয়েটা ওরই মধ্যে বুদ্ধি করে "ক্যালকাটা" শব্দটা দু বার বলেছিল। ওরা ধরে নিল মেয়েটি বাঙালি । তখন বিশাল সেই মল এ বাঙালি দোকানির খোঁজ পড়লো । ততক্ষণে মা আর পিসিমণিকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে গিয়েছে নীপা। বাবা কোলে তুলে নিয়েছেন। দু জনের চোখেই জল। 

সেই ছবিটা মাথা থেকে মুছতে পারে না নীপা। যদি হারিয়ে যেত ? যদি খুঁজে না পেত আপনজনদের? কি না হতে পারতো? পারতপক্ষে শিশু ভিখারীদের ভিক্ষা দেয় না নীপা। সে জানে ওদের প্রায়শঃ চুরি করে আনা হয়। ওদের দিয়ে ভিক্ষা করিয়ে সেই ভিক্ষার পয়সায় মাংস ভাত খায় অন্যেরা। এদের ভিক্ষা দেওয়া মানে ওই ব্যবসাটাকে উৎসাহ দেওয়া । শিশুচুরিকে উৎসাহ দেওয়া । নীপা তা কিছুতেই পারবে না।
ভারতে শিশু চুরির বিরাট নেট ওয়ার্ক । বহু টাকার ধান্ধা। তাই হর দিন বহু ছেলে মেয়ে হারিয়ে যায়। অনেক বাপ মা স্রেফ বাচ্চাকে বেচে দেয়। দুটি খাওয়াতে পরাতে পারার মুরোদ নেই বাপ মা হবার শখ ! নীপার চোখ দুটো জ্বলতে থাকে । 

ছোটদের জন্যে বই লেখে নীপা। নিজের কল্পনায় নিজের ছোটবেলাকে নানা রকম করে দেখে । মনে পড়ে ভোম্বল সর্দারের গল্প , ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা বাড়ি থেকে পালিয়ে । আসলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হারিয়ে যাওয়া কন্যাশিশুর ঠাঁ  হয় যৌন পল্লীতে । এই ধার্মিকের দেশে যৌনপল্লীতে কাস্টমারের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। হারিয়ে যাওয়া মেয়ে শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নানা হাত ঘুরে ওখানেই পৌঁছে যায়। শিশুর শরীর ভোগ করতে দ্বিধা বোধ করে না এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ । আগেও করে নি, বাল্য বিবাহ করিয়েছে, কচি বিধবাকে জ্বলন্ত চিতায় ঠেসে মেরেছে , এখনো ভেতরের কাঠামোর বদল হয় নি। শিশু পাচারে এদেশ শীর্ষে । ধন্য দেশপ্রেম!

বছর দশেক আগে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সংবর্ধনা নিতে নীপা দিল্লি গিয়েছিল। এবারেও একটি বিশ্ব বিদ্যালয়ের সেমিনারে কেন, কি করে আজো ভারতের গরিব ঘরের মেয়েরা পাচার হয়ে যায়, সেই নিয়ে তার গবেষণা পত্র পাঠ করতে এসেছিল নীপা। আর কাজের ফাঁকে সেই মলটা খুঁজেছিল সে।  চেষ্টা করেও খুঁজে পায় নি।ঘুমের মধ্যে শুধু শিরশিরিয়ে উঠেছিল -- কী না হতে পারতো!
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.