আলোয় ফেরা : সোনালী মুখার্জী |
ফরিদা বিবি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখে মেয়ে মেহের ,বিকালে যার টিকিও খুঁজে পাওয়া যায় না অন্যদিন , সে খানিকটা মাটি নিয়ে বসে বসে কি যেনো করছে ..একটু আশ্চর্য হয়ে মেয়ের দিকে এগিয়ে যায় ও ..দেখে মাটি দিয়ে বসে প্রদীপ তৈরী করছে মেয়ে ..
বলে ..এই কি করছিস ??মায়ের প্রশ্নে মুখে চোখে খুশির ঝিলিক ফুটে ওঠে ওর ..বলে ..দেখো আম্মি ??আমি কেমন মাটির পিদিম বানিয়েছি ?রানু বেলা অনিতা ওরা করছিলো ..আমি শিখে নিয়েছি ..ভালো হচ্ছে না? ?
জানো ?ওই যে মাঠে কালীমন্দিরে কালীপুজো হচ্ছে ?ওখানে কাল সন্ধেবেলা পিদিম জ্বালানোর প্রতিযোগিতা হবে ..যার পিদিম ভালো হবে ..বেশি জ্বলবে ?তাকে পুরস্কার দেবে ..তাই আমি পিদিম বানাচ্ছি ..বলো না আম্মি ..ভালো হচ্ছে তো ??
ফরিদা মেয়ের হাত থেকে সব নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ..বলে ..ওরে ..এসব আমাদের করতে নেই .এসব হিন্দুদের পুজো ..আমরা যে মুসলমান ..
হিন্দু কি আম্মি ??মুসলমানই বা কি ??এই কথার উত্তর ওর মা দিতে পারে না ..বোধয় জানাও নেই ..তাই বলে ..ওসব জানি না ..যা বলছি কর ..ওই সব নোংরা পরিষ্কার করে হাত পা ধুয়ে ঘরে আয় ..খাবার দিচ্ছি ..
ফরিদা ঘরে চলে যাবার পর মেহেরের চোখ জলে ভরে আসে ..এত কষ্ট করে বানানো তার পিদিমগুলো তার মা সব নষ্ট করে দিলো ?আর সে জ্বালতে পারবে না রানুদের মতো পিদিমগুলো ??খুব কষ্টে বাইরে বসে কাঁদতে থাকে সে ..
খানিকটা পরেই তার বাবা হাসান ফিরে আসে ..সে বড়রাস্তার মোড়ে রিক্সা চালায় ..সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আসে ..মেয়ে অন্ত প্রাণ তার ..ফিরে দেখে মেয়ে একা বসে আছে বাইরে মুখ ভার করে ..অন্যদিন তো কত হাসিখুশি থাকে ..হাতমুখ ধুয়ে মেয়ের পাশে এসে বসে হাসান ..বলে কি হয়েছে ??আমার মেহেরের মুখে হাসি নেই কেন ??
মেহের বাবার আদরে সব খুলে বলে বাবাকে ..বলে ..আচ্ছা আব্বু ..হিন্দু কি ???মুসলমান কি ???আমরা সবাই তো একসাথে খেলি ..স্কুলে যাই ..পড়াশোনা করি ..স্কুলে ভাত খাই একসাথে বসে ..তাহলে ওই কালীঠাকুরের পিদিম আমি কেন তৈরী করে ওখানে দিতে পারবো না আব্বু ??আম্মি কেন বলছে আমরা মুসলমান ..ওখানে যেতে পারবো না ??বলো না আব্বু ??রানু বেলা অনিতা ওদের বানানো পিদিম যদি ওখানে জ্বলে ..আমি কেন জ্বালাতে পারবো না ...বলো না ??
মেয়ের কষ্টে চোখে জল এসে যায় হাসানের ..বলে ..আচ্ছা মা ..চল এখন খেয়ে শুয়ে পড়ি ?কাল ভোরে উঠে আমরা দুজন আবার পিদিম বানাবো .তুই নিয়ে যাবি ..বাবার কথায় মেহের খুব খুশি হলো ..তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লো ..
সত্যি সত্যি খুব ভোরে উঠে বাপ্ মেয়ে তে অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর মাটির প্রদীপ বানিয়ে ফেললো ..সেগুলো রোদে দিয়ে হাসান রিক্সা নিয়ে বেড়িয়ে গেলো ..মেয়েকে বলে গেলো ..ফিরে এসে আমিও তোর সাথে যাবো .তুই পিদিম জ্বালাবি ..আমি দুচোখ ভরে দেখবো ..মেয়ে খুব খুশি হয় ..ফরিদা কিন্তু খুশি হয় না ..ওর মনের ভিতর আশংকা হয় ..ওরা যে মুসলমান ...যদি কিছু হয় ???
সন্ধেবেলা মেয়ে মেহের কে নিয়ে হাসান যায় মন্দিরের সামনে ..ওখানে সবাই নাম দিচ্ছে ..সবার প্রদীপ জ্বালানো হবে ..প্রচুর ভিড় ..লোকে লোকারণ্য ..ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যায় হাসান মেয়ের হাত ধরে ..
সকলে মোটামুটি চেনাশোনা হলেও কেমন যেন অবাক দৃষ্টি তে ওদের দেখতে থাকে সবাই ..হাসান এগিয়ে এসে পরিচালক মন্ডলীর যে ছেলেটি নাম লিখছিলো ..তাকে বলে আমার মেয়ে মেহেরুন্নেসা খাতুনের নামটাও একটু লিখে নেন না দাদা ??ও পিদিম জ্বালাবে ..ছেলেটি একবার অবাক হয়ে তাকায় ..তারপর কি মনে করে মেহেরুন্নেসা খাতুন নামটাও লিখে নেয় ..
দেখতে দেখতে প্রদীপ জ্বালানো শুরু হয় ..একে একে রমা ,উমা ,সাথী ,অনিতা ,বেলা সবাই যে যার প্রদীপ জ্বালাতে থাকে ,সকলে হাততালি দিয়ে ওদের উৎসাহিত করে ..তারপর নাম ঘোষণা হয় এবার প্রদীপ জ্বালাতে আসছে ..মেহেরুন্নেসা খাতুন ..না ..কেউ হাততালি দেয় না ..সারা মহল চুপচাপ হয়ে যায় ..একটা চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে সবদিকে ..এটা কি করে হয় ??একটা মুসলিম মেয়ে ঠাকুরের কাছে প্রদীপ জ্বালাবে ?না ..কিছুতেই নয় ..সকলে হঠাৎ সোচ্চার হয়ে ওঠে ..ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ..এতবড়ো পাপ কিছুতেই করতে পারবে না ..হাত ধরে মেহের কে বার করে দিতে চায় কিছু মানুষ ..
হঠাৎ উঠে দাঁড়ান গ্রামের হেডমাস্টারমশাই অবনীবাবু ..তিনি আজ এসেছেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে ..সকলে ওনাকে খুব সন্মান ও শ্রদ্ধা করে ..তিনি বলেন .. দাঁড়াও সবাই ..সকলে একবারে চুপ করে যায় ..তিনি বলেন ..তোমরা বলো তো ??হিন্দু কি ??মুসলিম কি ??আমরা সকলে এক ই দেশের এক ই মায়ের সন্তান ..এটা আমাদের ভারতবর্ষ ..এখানে আমাদের নানা ভাষা ..নানা মত ..আমরা বিবিধের মাঝেই মিলন খুঁজে পাই ..কোনো উৎসবের কোনো জাত কোনো ধর্ম হয় না ..মানবতাই হলো পরম ধর্ম ..এসো আমরা সকলে আজ থেকে এসব মন থেকে সরিয়ে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠি ..চলো মনের আলোতে আমরা দীপাবলি সাজাই ..নিজেদের বাড়িগুলিও আলোকিত করে তুলি ..
হাসান দেখে উমা সাথী রানু ওদের সাথে তার মেয়ে মেহেরও মন্দির চত্বর আলোয় আলোকিত করে তুলছে ..আর পিদিমের আলোয় ওর মুখ থেকে যে দ্যুতি বেরোচ্ছে ..তা ওই মন্দিরে থাকা দেবীর থেকে কম কিছু না ...
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন