লালন ফকির ইংরেজি ১৭৭২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন, ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর মৃত্যু বরণ করেন। লালনের জন্ম স্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, লালন ১৭৭২-এ নয়, ১৭৭৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ড উপজেলার হরিশপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। কোনও কোনও লালন বিষয়ের গবেষক মনে করেন, লালন ফকির কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার, ছাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা নামক গ্রামে জন্মেছিলেন। এ ছাড়াও আরও অনেক মতামত পাওয়া যায় তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে। লালন একটি এটি সাধারণ পরিবারে জন্মেছিলেন। যেখানে জন্মেছিলেন, সেখান থেকে লালন অন্যত্র চলে যান এবং বিখ্যাত হন। এবং লালন সম্পর্কে চর্চা শুরুও হয় তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে। সে কারণেই মূলত লালনের জীবন বৃত্তান্তের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা পাওয়া যায় না।
অনুমান করা হয় লালন জন্মেছিলেন নিম্ন-বৃত্ত হিন্দুর ঘরে। তিনি ব্রাহ্মন ঘরে জন্মেছিলেন কি না, তা নিশ্চিত প্রমান মেলে না। প্রতিবেশী সম্ভ্রান্ত পরিবারের ঘোড়া লালনের খুব প্রিয় ছিল। কিশোর বয়সে লালন সেই ঘোড়ার সঙ্গে বেশি সময় কাটাতো। জমিদার পরিবার তীর্থ ভ্রমণে বের হলে কিশোর লালন তাঁদের সঙ্গ নেন। লালনের বাবা মায়ের সম্পর্কেও তেমন কিছু জানা যায়নি। ওই ভ্রমণে লালন বসন্ত রোগে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে, জমিদার পরিবার লালনকে কালিগঙ্গার পাড়ে শুইয়ে রেখে বিদায় নেন গন্তব্যের জন্য।
কালিগঙ্গার পাড়ে শুয়ে থাকা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন মলম শাহ নামক এক ব্যক্তি। মলম শাহ ও তাঁর স্ত্রী মতিজান লালনকে বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এভাবেই লালনের জীবনের মোড় ঘুরতে থাকে। মলম শাহ ছেউড়িতে নিয়ে গেলে সেখানে লালন সিরাজ শাহীর সান্নিধ্যে আসেন। এবং গুরু মেনে দীক্ষা নিয়ে লালন অধ্যাত্ম বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। সিরাজ শাহীর মৃত্যুর পর ছেউড়িতে লালন একটি বাউলের আখড়া প্রতিষ্টিত করেন বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেউড়িয়াতে। যেখানে তিনি তার শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন।
লালনের শিষ্যরা তাঁকে “সাঁই’’
বলে সম্বোধন করতেন। চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর
এবং পশ্চিমে অনেক দূর পর্যন্ত বাংলার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক
লালন ফকিরের শিষ্য ছিলেন; শোনা যায় তাঁর শিষ্যের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের
বেশি ছিল। আজও লালনের আখড়ায় নিয়ম করে বছরে দুবার মেলা বসে। প্রায় লক্ষাধিক শিষ্য, অনুসারী, ভক্ত গবেষকরা সেই মেলায় সম্মিলিত হন। যদিও বাংলাদেশের কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী লালনের আখড়াকে ``মাজার'' বলে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে চেষ্টা করে। তথাপি, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ভক্তরা এখনও লালনকে তাঁর স্বমহিমায় জাগ্রত রেখেছেন।
ইংরেজি ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ফকির প্রায় ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির গ্রামের ছেউড়িতে নিজের আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর প্রায় একমাস পূর্ব থেকে
তিনি পেটের সমস্যা ও হাত পায়ের গ্রন্থির সমস্যায় ভুগছিলেন বলে জানা যায়। কথিত আছে, মৃত্যুর দিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি গান-বাজনা করেন। এবং এক সময় তাঁর
শিষ্যদের বলেন : “আমি চলিলাম’’ এবং এর কিছু সময় পরই তাঁর মৃত্যু
হয়। তাঁর পূর্ব-নির্দেশ বা ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান
কোনও ধর্মীয় রীতি নীতিই পালন করা হয়নি। আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তাঁর সমাধি গড়ে তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হয়।
লালন সংসারী মানুষ ছিলেন। তার স্ত্রী ও একটি পালিত কন্যা ছিল। লালনের একমাত্র ফটো বা আঁকা ছবিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন। যদিও ছবির সঙ্গে লালনের মুখের তেমন মিল ছিল না। ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে প্রথমে যুদ্ধ হয়, পরে বন্ধুত্ব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তীতে লালনের প্রায় দুই শতাধিক গান সংগ্রহ করেছিলেন। লালন গান লিখে রাখতেন না। তিনি স্মৃতি থেকে গাইতেন। তার মৃত্যুর কারণে অনেক গান হারিয়ে যায়।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
1 Comments:
অনেক কিছু নতুন জানলাম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন