নাচিকেত অগ্নি : মৃদুল শ্রীমানী


নাচিকেত অগ্নি
 
মৃদুল শ্রীমানী

যমের সুমুখে দাঁড়িয়ে নচিকেতা প্রশ্ন করছেন, মৃত্যুর পর মানুষের কী হয়। সৌম্য সুন্দর বালক। আপাদমস্তক আগুন। যম তুতলে যাচ্ছেন। দেদীপ্যমান বিভাময় বালকের দিকে ভাল করে চাইতে পর্যন্ত পারছেন না। 
 
বাছা নচিকেতা, তোমাকে অনেক বর দেব, অনেক গিফট দেব, তুমি ওই প্রশ্নটা কোরো না সোনা। ও প্রশ্ন করতে নেই। শান্তি আর সুস্থিতি বিঘ্নিত হয়।
 
বালক নাছোড়। তুমি যম। তুমি ছাড়া আর কে জানবে এই গুহ‍্যসূত্র? মৃত্যুর পর কী তা তোমাকে বলতেই হবে।
 
বাবার উপর অভিমান হয়েছিল। যজ্ঞের সময় দানধ‍্যান করার কথা। শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার সঙ্গে যা দেওয়া হয় তাই তো যথার্থ দান। বাবা এই বুড়ো বুড়ো গরুগুলো দান করে কি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন?
 
নচিকেতা বাবাকে বলল, বাবা, আমাকে কার কাছে দান করলে? আরে বদমাইশ ছেলে? নিজের বেটাকে কেউ দান করে? তার উপর এমন সুন্দর ছেলে। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। তেমনই ঝকঝকে বুদ্ধি। জ্ঞান আর বৈরাগ্য ও মুখে খেলা করে। কেন এহেন সন্তানকে দান করব?
 
বার বার প্রশ্ন করে বালক নচিকেতা। ক্ষিপ্ত হয়ে যজ্ঞাসনে বসে মুনি বললেন, যা, তোকে যমকে দান করলাম।
 
সেই বালক ক্ষুধা তৃষ্ণা অগ্রাহ্য করে পদব্রজে পৌঁছেছে যমপুরীতে। যম ছিলেন না। যমের সহকারীবৃন্দ বালককে অন্নগ্রহণে অনুরোধ করেছিল। নচিকেতা বলেছিল আগে যম আসুন। তারপর আতিথ‍্য নেব কি না, ভাবব। তিন দিন পরে যম এলেন। তিন দিন অনাহারী বালক। জলটুকুও মুখে দেয় নি। তারপর ওই বিষম প্রশ্ন। বলো মৃত্যুর পর কী হয়!
 
আমি নচিকেতাদের দেখেছিলাম মানবাজারে। মহকুমা অফিসে সেকেণ্ড অফিসার। বালক বালিকা মিলিয়ে সত্তর আশিটি নচিকেতা পঁচিশ কিলোমিটার দূরের আদিবাসী হোস্টেল থেকে খররৌদ্রে হেঁটে এসেছে। 
 
ওরা মহকুমা শাসকের কাছে বিচার চাইতে এসেছে। হেডমাস্টার আদিবাসী ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন করেছেন। অভিযোগ জানানোর পরেও এখনো কেন তিনি চেয়ারে আসীন? দেশে কি বিচার নেই?
 
মহকুমা শাসক অন‍্যত্র‌ জরুরি কাজে ব‍্যস্ত। তিনি এখনই আসতে পারার অবস্থায় নেই।  নচিকেতাদের বললাম, জল খাও, মিষ্টি দিচ্ছি, মিষ্টি খাও। তারপর দেখছি। ঝলসে উঠল আদিবাসী আগুন। না, তোমার কাছে জানতে এসেছি, চেয়ারে বসে আমাদের অভিযোগের কী সুরাহা করেছ? কেন  যৌননির্যাতনকারী হেডমাস্টার এখনও ক্ষমতাসীন?
 
ওরে নচিকেতা, এ প্রশ্নের উত্তর যে আমি জানি না। ওঁর বিচার হবে। গণতান্ত্রিক দেশে বিচার হতে সময় লাগে। ততদিনে তোর নাতি গরু চরাতে শিখে যাবে। অপেক্ষা করো বাছা। জল খাও, মিষ্টি খাও। দ‍্যাখো, বড়ো বড়ো মিষ্টি আনিয়েছি।
 
নচিকেতা বলল, বয়ে গেছে তোমার মিষ্টি খেতে! তুমি যদি উত্তর দিতে না পারো, আমরা আদিবাসীর ছেন‍্যা, চললাম জেলাশাসকের দরবারে। পুরুলিয়ায়। মোরা হেঁইট‍্যে যাব আদিবাসীর ছেন‍্যারা।
 
আমার বুক কাঁপে। মাথার উপর চড়া রোদ। ছাতা না নিলে হাঁটা যায় না। তপ্ত পিচ থেকে আগুনের হলকা উঠছে। এর মধ‍্যে ওরা পঞ্চাশ কিলোমিটার হেঁটে চলে যাবে?
 
কাকুতি মিনতি করি। ওরে নচিকেতা, আজকের মত সময় সময় দে। মহকুমা শাসক আসুন। সুবিচার পাবি।
 
ঘণ্টা খানেকের লাগাতার অনুরোধে কাজ হয়। ওরা জলগ্রহণ করে আমার হাতে। খাবার নেয়। 
তারপর গাড়ি ভাড়া করে এনে আবার পঁচিশ কিলোমিটার দূরে হোস্টেলে পৌঁছে দেওয়া।
নচিকেতাদের আমি দেখেছি। দেখেছি তার চোখে জ্বলন্ত আগুন। যম‌ও যে আগুনকে ভয় পায়।
 
পুনশ্চ:
শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে পকসো আইন অনুযায়ী চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি বঙ্গে বহু জেলাতেই এখনো নেই। পুরুলিয়া তার অন‍্যতম ছিল।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.