বঙ্কিমচন্দ্রের "বিড়াল" প্রবন্ধে এক বিশেষ উক্তি ছিল। বেশ জোরালে ক্ষোভের উদ্রেক এবং নৈতিক মনে হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, সমাজের ধনবৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধনবৃদ্ধি। মিথ্যা কী! খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব কথা। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে, এইযে পৃথিবীর ৭৮০ কোটি জনগোষ্ঠীর এতবড় একটা মূল, এতবড় একটা হোমোস্যাপিয়েন্স কমিউনিটি, সেখানে কতিপয় দালাল, পুঁজিবাদী, লুটেরা সাম্রাজ্যের ভিত্তি এতদিন ধরে আঁকড়ে আছে! কীভাবে সর্বহারার (proletariat) রক্ত চুষে সৃষ্টি করছে বিত্তবৈভব? আবার হঠাৎই উত্তরও চলে আসে! কি করবে সর্বহারা? তারা যে রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে, অর্থাৎ পুঁজিবাদী বুর্জোয়াদের হিংস্রতার জিম্মি! তারা জিম্মি রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে এবং অনেকটা সামাজিকভাবে।
অনেকেই ক্যাপিটালিজম নিয়ে আমাকে নানাবিধ প্রশ্ন করেন। কমিউনিজম কেনো আসে না আলোয়? সমাজতন্ত্রের সারভাইভালের সমস্যাটা কোথায়? লুটের তত্ত্ব কেনো মানুষ গ্রহণ করছে সাদরে? ফারাকটা কোথায় থেকে যায়? ডেমোক্রেটিক ক্যাপিটালিজম কী জনগণের সাথে প্রতারণা নয়,ধোয়াশার অর্থনীতি নয়? এসব নানা জাতের নানাবিধ প্রশ্ন। সবার সদুত্তর দেওয়া অনেকটা মুশকিল। তবুও, আমার ধারণা থেকে অল্প কিছু বর্ণনা করা যাক। প্রথমত, ক্যাপিটালিজম তথা পুঁজিবাদকে বুঝতে হবে। পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক পদ্ধতি, বাজার-ব্যবস্থা না জানলে এসব প্রশ্ন আলোচনা অবান্তর। সুতরাং সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা সচেতন মহলের দায়িত্বও বটে। আসল কথায় আসা যাক।
সহজভাবে বললে,পুঁজিবাদ হচ্ছে এমন একধরণের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে বাজার অর্থনীতিতে মুনাফা সৃষ্টির লক্ষ্যে ইন্ডাস্ট্রি এবং বাজার উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার নিয়ন্ত্রণ থাকে। পুঁজির সঞ্চয়ন, শ্রমিক মজুরি,প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার- ইত্যাদি কেন্দীয় পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ, এখানে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেই। ফ্রিডম মার্কেট বলা যেতে পারে। সহজ কথা, এখানে জবরদস্তির হাতিয়ারগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত হয় না। গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, এটা সমাজতন্ত্রের বিপরীতে এক ধরণের অর্থনৈতিক পদ্ধতি। অনেকেই আছেন,যারা সবসময় ফতোয়া খুঁজেন,এভিডেন্স চান,তাদের জন্য দুজন তাত্ত্বিকের মতামত দিচ্ছি।
অধ্যাপক L.B Thomas এবং J.F Ragan এর মতে,বিশুদ্ধ ধনতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে সম্পদের মালিক ব্যক্তি মালিকানা এবং বাজারের উপর আস্থা সেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা সমবেতভাবে দাম নির্ধারণ করে এবং কী দামে কী পরিমাণ সম্পদ ও পণ্য বিক্রয় হবে।এটিই হচ্ছে সাধারণ পুঁজিবাদের রূপরেখা।
পুঁজিবাদ সৃষ্টির পটভূমি মোটামুটি সবাই ওয়াকিবহাল। ইংল্যান্ডের ১৭৫০ সালের শিল্প বিপ্লবই মূলত এই ক্যাপিটালিজমের সৃষ্টি করে। পণ্যের বাজার সম্প্রসারণই এর প্রধান কারণ। তারপর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করলো সাদা চামড়ার বদমাথাগুলো! সৃষ্টি করলো উপনিবেশিক বাজার তথা কলোনি। দখল করতে থাকলো একের পর এক রাষ্ট্র। শুরু হলো রিপ্রেসিভ ইকোনমি। বলা রাখা ভালো এই ক্যাপিটালিজম এর পূর্বে মূলত সামন্তবাদ (Feudalism) ছিল। এই সিস্টেম ছিল আরো কঠোর। সামন্ত প্রভুরা নিপীড়ন আর নিগ্রহের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। সৃষ্টি হলো কলোনি,শুরু হলো পুঁজি সৃষ্টির ধান্ধাবাজি। অর্থনৈতিক বাজারে সর্বহারাদের নামমাত্র স্বাধীনতা দিয়ে লুটে নিতে থাকলো ঘামের দাম,রক্তের বুদবুদ! লোক দেখানে দু,চাট্রে উন্নয়নের পুঁথিসাহিত্য তৈরী করে ছিনিয়ে নিতে থাকলো উপমহাদেশ,সভ্যতা, ঐতিহ্য! নিজেদের মালামাল পরিবহনের ক্রিয়াকর্ম সহজ এবং দ্রুত করার জন্যই তৈরি করলো কলোনিতে ট্রামলাইন, রেলগাড়ি, নৌবন্দর। তৈরী হতে থাকলো বিধ্বংসী শহর,ম্যাগাসিটি।আর,সামান্য কেরানিগিরির জন্যে বাঙ্গালীকে যোগ্য করে তোলার জন্যে সৃষ্টি করলো ইস্কুল! ব্লাডি হিস্ট্রি! চলতে থাকলো নিপিড়নের কঠোর স্ট্রিম রোলার। সে যাইহোক,তিক্ত স্মৃতি আওড়ে রক্ত গরম করে লাভ কী!
চলুন ধনতন্ত্রে ফিরে যাওয়া যাক। পুঁজিবাদের ভিত্তি মার্কিনীদের অনুসরনেই চলছে। তারাই পৃথিবীর পুঁজিবাদের ধারক-বাহক। ৯০'র সোভিয়েত পতনের পর একাধিপত্য কায়েম করে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে বিত্তবৈভবের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মূলত, পৃথিবীর অর্থনৈতিক অঞ্চল,রাজনৈতিক অবস্থান প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে এই সুপার স্টেটই নিয়ন্ত্রণ করছে৷ এশিয়ার অঞ্চলকে 'থার্ড ওয়ার্ল্ড' বলে গালি দেওয়ার রীতি তাদেরই অদ্ভুত সৃষ্টি। একদিকে সোসিয়ালিজম,অন্যদিকে ক্যাপিটালিজম, আর ক্যাপিটালিজম দ্বারা প্রভাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলই সাধারণত তৃতীয় বিশ্ব বলে বিবেচিত। শিল্প বিপ্লব এবং পুঁজিবাদ পৃথিবীতে যা দিয়েছে তার হিসাবনিকাশ করলে বেনিফিটের জায়গায় মাইনাস আসবে সেটা নিশ্চিত!
গত ৫০ বছরে পুঁজিবাদের প্রভাব যা হয়েছে তা পুঁজিবাদ বিকাশের প্রথম শতাব্দীতে ছিল না৷ কার্ল মার্কস,লেলিন,মাও সেতুং পুঁজিবাদ সম্পর্কে যে ধারণা বা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি হয়েছে পৃথিবীর। এবং আগের সেই ধ্বংসাত্মক পুঁজিবাদের চেয়ে বরং ভয়ংকর। শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। ব্যাপক জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়ানোর ফলে কার্বনডাইঅক্সাইডের নিঃসরণ মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুণ। গত বছর (২০১৯) সালে পৃথিবীর তাপমাত্রার গড় বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলাফল কী? আমরা জানি,খরা,অযাচিত বন্যা,সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি,জলোচ্ছ্বাস, মহামারী, দুর্ভিক্ষ লেগেই আছে। ফলশ্রুতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জানমাল। বিপদগ্রস্ত হচ্ছে হাজারো জনপদ,লোকালয়। শহর তৈরী হচ্ছে, তৈরী হচ্ছে বিলাসবহুল আলিসান অট্টালিকা! পৃথিবী ভেঙে সৃষ্টি হচ্ছে ডেসট্রোয়েড ইকোনমি, বোটমলেস বাস্কেট!
পুঁজিবাদী থিওরি টিকিয়ে রাখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো বাজার এবং ভোক্তার সক্ষমতা। শিল্প বিপ্লবের পর জনগোষ্ঠী ছিল ১০০ কোটি,এখন ৭৮০ কোটি। এই বিরাট জনগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে তৈরি হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় রসদ- শিল্প উৎপাদন,ভেক্সিন,টিকা,ঔষধ, উন্নত শল্যচিকিৎসা৷ যক্ষ্মা, টিবি,টাইফয়েড, ক্যান্সার,প্লেগ,করোনার কাছেই হার মেনেছে পুঁজিবাদ! শিল্প বিপ্লব দেখিয়েছে নতুন পথ। বিপ্লব বিকাশের প্রারম্ভে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪০ বছর। শিশু মৃত্যুহার ছিল ৪০ শতাংশ ,যা পুঁজি বিকাশের ফলে নানা দেশে নানা পরিবর্তন হয়েছে। জাপানে প্রায় ৯০ বছর গড় আয়ু, আমাদের ৭০ বছর। পুঁজিবাদী দেশগুলো দিয়েছে নারীর পূর্ণাঙ্গ অধিকার। তাঁরা খুঁজে পেয়েছে জীবনের নতুন অর্থ। সন্তান উৎপাদন এবং চার দেয়ালে নারী আবদ্ধ নয়। এজন্য উন্নত পুঁজিবাদী দেশে জনসংখ্যা কমছে। পরিবর্তন হচ্ছে নারী-পুরুষের সম্পর্ক। সৃষ্টি হচ্ছে সম্পর্কের অমলিন, দূরত্ব।
ক্যাপিটালিজম দুরভিসন্ধিঃ কৃত্রিম সংকট
তেল গ্যাসের মালিকানা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরু হয় ফিলিস্তিন,ইজরায়েল সংকট। সৃষ্টি হয় বিশ্ব কোলাহল। পুঁজিবাদের জনক বৃটিশরা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের নগ্ন হস্তক্ষেপকে আরও তীব্র এবং একক করার স্বার্থে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর পুরো বিশ্বের ইহুদিদের একত্র করে লেলিয়ে দেয় ফিলিস্তিনি মুসলিমের মধ্যে। সৃষ্টি করে আগুনের ধোঁয়া-লেলিহান দাবা খেলা। এরই পথ ধরে সৃষ্টি হয় কাশ্মীর সমস্যা। এসবই পুঁজিবাদের হিংস্রতা,ব্রুটালিটি। দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওসে যুদ্ধ চালায় হিংস্র উলঙ্গ পুঁজিবাদ। অবশেষে চীন,রাশিয়ার সমর্থনে হটতে বাধ্য হয় মার্কিন মুলুক। ভিয়েতনামে হার মানে পুঁজিবাদ। আরেকটা সুদূরপ্রসারী মতলব বলতেই হচ্ছেঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালেই,অর্থাৎ ১৯৪৪ সালে পুরো বিশ্ব বাণিজ্যে প্রবেশ নিশ্চিত করতে ডলারকে মুদ্রায় পরিণত করে মতলববাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় ৩০/৪০ বছর পর ইউরোপীয়নরা এই বাজার সৃষ্টির কৌশল এবং কূটকৌশল বুঝতে পেরে সৃষ্টি করে ইউরো মুদ্রা। এটা তাদের পুঁজিবাদী ব্যবসায়ীক মানসিকতা। অপরাধও বলতে পারি না। এই হচ্ছে পুঁজিবাদ। এই হচ্ছে রক্তচোষা ইকোনমি। সম্পদের বৈষম্যের পাহাড়সম পার্থক্যের প্রতি দৃষ্টি দিলে হতবাক হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
বিবিসির এক রিপোর্টে বলেছে,ক্রেডিট সুসির তথ্যানুযায়ী ১ শতাংশ লোকের হাতে পুঞ্জীভূত আছে ৯৯ শতাংশ মানুষের সম্পদ। এই হচ্ছে ফ্রড ইকোনমি! বিল গেটস,ওয়ারেন বাফেট,জেফ বেজোস,ব্লুমবার্গের মত ধনকুবের প্রতিষ্ঠানগুলো পুরো পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ কুক্ষিগত করে! এভাবে চলতে থাকলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা কোথায় গিয়ে পৌঁছোবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করে 'ইনসেইন ইকোনমি' গবেষণা করতে চাই না। আমরা সমাজতান্ত্র, কমিউনিজমের উন্নয়নের মুখ দেখতে চাই। দেখতে পাচ্ছি সাম্যবাদের জয়ের মুখ! সম্ভাব্য বিজয়। আবারো ফিরে আসবে সমাজতন্ত্র নতুনভাবে, নতুন রূপে। ক্লাস ডাইভারসিটি আবারো মিশে যাবে পৃথিবীর ভূখণ্ড থেকে। এটাই প্রত্যাশা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরী বিষয় নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়,২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উন্নত বিশ্বের মধ্যে শিশু মৃতুহারের তুলনায় খারাপ অবস্থায় আছে এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। ২০১৭ সালের জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ার মানবাধিকার বিষয়ক পরিসংখ্যানে বিশদ তথ্য উপস্থাপন করে। সেখানে আমেরিকার সমাজব্যবস্থাকে 'অসম সমাজ বলে উল্লেখ করেন। তাছাড়া, গ্যালাপের করা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়,১৮-২৯ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে সমাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতি বেড়েছে। এই প্রতিবেদনের ৫১ শতাংশ মানুষ মনে করেন,সমাজতন্ত্র একটি ইতিবাচক সোস্যাল সিস্টেম। ফক্স নিউজের প্রতিবেদন বলে,প্রাপ্তবয়স্ক ৩৬ শতাংশ আমেরিকান বলে,আমেরিকার এখন সমাজতন্ত্রের পথে চলা উচিত।
সুতরাং, আমরা সমাজগঠনমূলক সমাজতান্ত্রের আবারো বিজয় দেখতে পাচ্ছি। সোভিয়েত ভাঙ্গনের পরেও উত্তর কোরিয়া,বা চীনের উন্নতিতে আমরা স্বস্তি খুঁজি। চীনের ৮০০ মিলিয়ন মানুষকে বৈষম্যের শেকড় থেকে জনগনকে মুক্তি দিয়ে সমাজতন্ত্র তার ইতিবাচকতা দেখিয়েছে। সে অনেক কথা। কথা হবে তৎকালীন সোভিয়েতের ইতিহাস ও অর্থনীতি নিয়ে। অন্য আরেকদিন কথা হবে কমিউনিজম নিয়ে-জয়ের পতাকা নিয়ে। ততক্ষণে পুঁজিবাদী বুর্জোয়াদের পুঁজি-রাজনীতি থেকে নিজেদের রক্ষা করি। পৃথিবীর জয় হোক।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন