কুড়ানু, দ‍্য স্টার : সন্দীপ কুমার ঝা

সন্দীপ কুমার ঝা

কুড়ানু, দ‍্য স্টার
 
সন্দীপ কুমার ঝা

দূরত্ব তিন কিমিঃ মত ।বুড়ো আমবাগান আর সরষে ক্ষেতের উপর দিয়ে উড়ে আসছে চোঙা ফুকার আওয়াজ-'আনন্দ সংবাদ আনন্দ সংবাদ। আজ রাত্রি সঠিক নয় ঘটিকায়, বিলাইমারি স্কুল ময়দানে, মুর্শিদাবাদের সুবিখ‍্যাত জয়কালি অপেরার,পঞ্চরস আলকাপ যাত্রাগান'!

পুরো ঘোষণা শোনাটা, জরুরি ছিল না। জরুরি ছিল কেবল দুটো শব্দ-পঞ্চরস, আর জয়কালি অপেরা। জয়কালি অপেরা মানেই কুড়ানু। আমার মত গ্ৰাম‍্য দর্শকদের কাছে সে তখন এক নক্ষত্র, স্টার। 'অমিতাচ্চন'!

নাচে গানে ফাইটিঙে নয়,মনমাতানো কমেডিয়ান এর ভূমিকায়। পঞ্চরসের স্টেজে কুড়ানু মানে তখন শুধু উফ! কুড়ানু মানে ফাটাফাটি। কুড়ানু মানে 'কথা হবে না'- টাইপ একটা ধামাকা।

আর তখন আমাদের কত?বারো কিংবা তেরো। শীতের সন্ধ‍্যা। ফুটবল মাঠে দুই বন্ধুর আ্যকশন প্ল‍্যান। ব্লু প্রিন্ট তৈরি হত ফিসফিস শব্দে। বগাদা আমার চেয়ে দুই এক বছরের বড়। সে ইন্দ্র, আমি শ্রীকান্ত।

সন্ধ‍্যার নামার পর থেকেই মাইকের চোঙ ক্রমে উগ্ৰ হয়ে উঠত। থেমে থেমে মহম্মদ আজিজ। পেছনের কলতলায় কলাগাছের ঝোপ। সেখানে ডাক আরো স্পষ্ট। ডাক শুনতে বারবার পেচ্ছাপ পায়। মাইকের চোঙ তো নয়,সে তখন যেন ডাকাতিয়া বাঁশি।

কিছু ডাক আছে,যা শুনলে রক্তচাপ বাড়ে। বুক টনটন করে। সেদিন বুঝেছিলাম। রক্তে টান জাগলে কাজও বাড়ে। মাকে টুপি পড়ানো, বাবাকে তেল দেওয়া। পাশবালিশকে লেপ ঢাকা দেওয়া। বাড়ি থেকে পালানোর আগে, পড়ায় গভীর মনযোগ দেখানো-কত্ত কাজ!

আসলে মন শুধু একটা ছোট্ট ফোঁকর খুঁজত। একটা সুযোগ। ব‍্যাস ছুট-ছুট-ছুট। শীত রাত্রির অন্ধকার চিরে, ধুলোময় গ্ৰামপথ চিরে দৌড়। যেন ভুলোয় ধরা মানুষ। আমরা,  কুড়ানুর দুই প্রেমিক।

পায়ে পায়ে দুদিকে সরে সরে যেত বাতাবির বন, করমচার ঝোপ, বনকুলের ঝাড়। খরগোশের মত লাফিয়ে লাফিয়ে পেছনে চলে যেত আমবাগানের গাঢ় অন্ধকারের কালি। হাঁফাতে হাঁফাতে শেষমেশ যখন দাঁড়াতাম তখন সামনে মহানন্দা।

শীর্ণ নদী। শীতে জুবুথুবু।জল কম।দুপাশের চওড়া বালুচর। জ‍্যোৎস্না মাখা সোনা রঙ। কিন্তু নৌকা তখন ওপারে,মাঝি নেই! মুশকিল আসান ইন্দ্রদা। বলল-প‍্যান্ট খোল।জামা খোল। চাদর দিয়ে সব মাথায় বাঁধ। হেঁটে পার হয়ে যাব। ডুব জল নেই। চল চল। গর্তে পরলেও অসুবিধা তো নেই। সাঁতার জানি!

প্রতিবাদের প্রশ্নই নেই। অবর্থ‍্য প্রেসক্রিপশন। ন‍্যাংটো হলাম। জামাকাপড় মাথায়, চাদরে বাঁধা। শীত বাতাসে,কনকনে মহানন্দার একগলা জলে আমরা দুইজন। কেবল কুড়ানুর কাছে যাব বলে।

ওপারে দুটো বড় আম বাগান।তারপর বিলাইমারির মাঠ। কনসার্ট জমে উঠেছে।কানে আসছে। জলের মধ‍্যেও সে আমাদেরকে টানছে। পৌষের বাতাসে ভাসছে পাঁপড় ভাজার গন্ধ!

একগলা জল ঠেলে যখন ওপারে উঠলাম, তখন হাত পা কাঠের মত অসাড়। ইন্দ্র বলল, চাদরে মুছে নে, আর চল দৌড় দে। শরীর গরম হয়ে যাবে। চরাটা পেরিয়ে ঐ বাগানে উঠে তারপর গায়ে জামা পড়ব। নদী পাড়ের শীত।প্রায় মধ‍্যরাতে নদীর পাড় ধরে দৌড়াচ্ছে উলঙ্গ দুই কিশোর।

'পঞ্চরস' এর শুরুতে মঙ্গলকাব্য ধাঁচের একটা বন্দনা অংশ থাকে। সস্তা‌ পেইন্টে, বদরঙা মুখ নিয়ে মেয়েরা দলবেঁধে স্টেজে উঠে আসে। আসলে কায়দা করে দলের মূল 'আকর্ষণকে' প্রথম লটেই 'শো' করানো। সস্তা শো এর সস্তা উপায়। কনসার্টের পরে, মহিসাসুর মর্দিনী অথবা ভক্ত প্রহ্লাদের ট্রেলার। তারপরেই আসল জিনিস। কুড়ানুর আবির্ভাব। ম‍্যাজিক- কেরামতি!

মূল পালার আগে মোটামুটি ঘন্টা তিনেক। এটাই ছিল আমাদের প্রধান আকর্ষণ।কোনও এক কল্প সামাজিক ঘটনাকে সুতো বানিয়ে, হালকা চটুল মগজহীন বিশুদ্ধ-হি হি হি। পাতলা সেক্স, আর মোটা কমেডির এক সার্থক বোম ব্লাষ্ট। আমাদের প্রিয় নক্ষত্র, আমাদের হিরো তখন মঞ্চের উপর। দাপাচ্ছে,ফাটিয়ে দিচ্ছে। হুল্লোড় উঠছে প‍্যাণ্ডেলের ভিতরে মূহুর্মূহু।

মেজাজে জমিদার, পোশাকে কার্টুন। রাতজাগা ক্লান্তি আর অপুষ্টির জমাট অন্ধকার দিয়েই যেন তার শরীরের নির্মাণ। অন্ধকার যতই হোক,তবুও মঞ্চে সে এক আশ্চর্য আলো।

কখনো ছ‍্যাবলা প্রেমিক,আবার কখনো ভ‍্যাবলা পাবলিক। কখনও চোর-পকেটমার, কখনো আলতা সিঁদুর বিক্রি করা, হদ্দ গ্ৰামের চৌকস ফেরিওয়ালা। রঙবেরঙের চরিত্রে একসাথে। দর্শককূলের সে যেন এক সার্থক, মঞ্চ প্রতিনিধি। চলনে, বলনে, পোশাকে, ধরনে-সে এক অদ্ভুত, আশ্চর্য, বিকট, গড়াগড়ি। হাসির বস্তা। শামিয়ানা থেকেও যেন সে রস বের করতে পারে। টপ্ টপ্!  জমে ক্ষীর!

উত্তেজনা বাড়ে। বেড়ে ওঠে জ্বলন্ত বিড়ির সংখ‍্যা। কুড়ানু একটা করে বোম ফাটায় আর ধোঁয়ার আকাঙ্খায় শত দেশলাই জ্বলে ওঠে প‍্যাণ্ডেলের ভিতর। একের পর এক।পেচ্ছাপের থলিতে রেড সিগন্যাল, কিন্তু হাত, পা অবশ। মাথা সন্মোহনের আওতায়।

এই সব মঞ্চে প্লট ,সিকোয়েন্স অনাথ। অযথা। যখন তখন যে কেউ মঞ্চ উঠতে পারে। ঝমকালো বাজনা, জমকালো পোশাকে, রঙিন আলোয় তখন যুক্তির গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো হয়। হিট নর্তকীকে একই গানে, একই নাচ একাধিক বার নাচতে হয়। বাধ‍্য হয়। দর্শকদের অনুরোধ। যেমন মনোরঞ্জনের গুণমান, তেমন দর্শক। হয়তো পালা শেষ। ভোরের আলো ফুটছে, কিন্তু দর্শক নাচ দেখবেই। একটু আগের নর্তকী, ঘুম চোখে  আবার মঞ্চে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে লাফিয়ে লাফিয়ে আধা পুরুষালি হেঁড়ে গলায় গাইছে-'একি আঁখি মারু তো..

তালিয়া....সিটি..উফ!

মালিকের চাহিদা  টি.আর.পি। নর্তকীর দক্ষতা থার্মোমিটার রিডিং। তারা জানে কোথায়, কখন কোন নাড়ি চাপ দিলে, কত জ্বর ওঠে। নাচতে নাচতে ফ্লুট, ঢোলকি আর হাজারো জগঝম্পের মধ‍্যে, ঠিক তাল বুঝে, পরনের ঘাগড়াটাকে হাঁটুর উপরে তুলে, মঞ্চের একবারে ধারে গিয়ে, হঠাৎ হঠাৎ বাজনদারের মুখের উপর ঝাড়ে। ধুলো ঝাড়ার মত। পাবলিকও তখন নাচে গানে পেঙলি-পাগলু। অর্ধ উন্মাদ। খড়ের আসন ছেড়ে, তারাও হুড়মুড় করে পড়ে বাজনদারের ঘাড়ের উপর। কল্পনায় যেন কিসের স্বাদ নেয়। গন্ধ নেয়!উত্তেজনায় কেউ কেউ, একসঙ্গে দুটো বিড়ি ধরায়!

রস সম্রাট কুড়ানুর ক‍্যারিকেচার, দর্শকের বিকার, উন্মত্ত বাজনা আর জেনারেটর আলোয়, চৌকিপাতা স্টেজ তখন অবাস্তব এক স্বপ্নজগত। বিড়ির ধোঁয়ায় প‍্যাণ্ডেলের মধ্যে মেঘ। মঞ্চের উপর স্বপ্ন পুরুষ। যেন ডুবে যাচ্ছে সব। চারপাশে কোথাও কিছু নেই। মঞ্চে কেবল সম্রাট। নায়িকার হাত ধরে নাচছে -'হয়তো আমাকে কারো মনে নেই, আমি যে ছিলাম এই গ্ৰামেতেই'..

ঠিক ঠিক। কুড়ানু তো এখানেই ছিল। ঠিক এখানেই। এই হাট, এই মাঠের পাশেই। এই নদীর, পাশে, এই অগণিত ধুলোমাখা মানুষ, এই খড়ের উপরেই তো তার ঘর। তার আস্তানা। এখন সে অগণিত হয়ে বসে আছে তার নিজেরই চারপাশে। ওম নিচ্ছে সার্থক জীবনের। এই রাত যেন জীবনের শেষ রাত। যেন, কালকের কথা থাক, আজ রাতটুকু সঙ্গে বেঁচে নিই!
কুড়ানু তখন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা..

সে-ই তো নক্ষত্র ,যে স্বপ্ন দেখায়।
কুড়ানু দ‍্য স্টার!

ফেরার পথে, চাঁদ অনেকটা হেলে পরেছে আকাশের প্রান্ত সীমায়। মাথার উপরে চাদরে বাঁধা জামা প‍্যান্ট।কুড়ানুর ন‍্যাংটো দুই প্রেমিক, এক গলা জলে।পুবের আকাশ লাল। ঝুলছে রূপোর শুকতারা। কুড়ানু দ‍্য স্টার!
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.