![]() |
জীবনানন্দ দাশ |
(1899-1954)
সমাপ্তি চৌধুরী
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, শিক্ষাবিদ, লেখক ও প্রাবন্ধিক জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের গাওপাড়া গ্রামে। পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন, পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক। মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহস্থ, কিন্তু তিনি খুব ভালো কবিতা লিখতেন। তাঁর সুপরিচিত কবিতা 'আদর্শ ছেলে ' আজও শিশুশ্রেণীর পাঠ্য। জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান, তাঁর ডাকনাম ছিল মিলু।
বাড়িতে মায়ের কাছেই জীবনানন্দের বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই পিতার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের গান শুনতেন। একটু বড় বয়সে, ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আট বছরের জীবনানন্দকে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। বিদ্যালয়ে থাকাকালীন তাঁর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচনার সূচনা হয়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দুবছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ পাশ করেন (১৯১৭)। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স সহ বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি আইন বিষয়ে পড়া শুরু করেন। কিন্তু অচিরেই তা পরিত্যাগ করেন।
১৯৩০, ৯ই মে লাবণ্য দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর আর দিল্লিতে ফিরে যাননি তিনি, ফলে সেখানকার চাকরিটি খোয়ান। এরপর প্রায় বছর পাঁচেক কর্মহীন ছিলেন। মাঝে কিছুদিন ইনশিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন, ভাই-এর থেকে অর্থ নিয়ে ব্যবসা করেছেন, কিন্তু কোনোটাই স্থায়ী হয়নি। সামগ্রিক কর্মজীবনে পাঁচটিরও বেশি কলেজে কাজ করেছেন জীবনানন্দ। এ যেন এক বিপন্ন বিস্ময়, যা তাঁকে স্থিত হতে দেয় নি।
জীবনানন্দ দাশের কাব্যচর্চার শুরু অল্পবয়স থেকেই। সম্ভবত মা কুসুমকুমারী দাশের প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন তিনি। ছাত্রাবস্থায় তাঁর প্রথম কবিতা ' বর্ষা আবাহন ' ব্রাহ্মবাদী পত্রিকায় (এপ্রিল ১৯১৯) প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা।
যৌবনের প্রারম্ভেই জীবনানন্দের কবিপ্রতিভা বিকশিত হতে শুরু করে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫-এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তাঁর স্মরণে 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে ' নামক একটি ব্রাহ্মবাদী কবিতা রচনা করেন। যা বঙ্গবানী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পড়ে কবি কালিদাস রায় মন্তব্য করেছিলেন, "এ ব্রাহ্মবাদী কবিতাটি নিশ্চয়ই কোনো প্রতিষ্ঠিত কবির ছদ্মনামে রচনা "। ধীরে ধীরে কলকাতা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হতে থাকে। যেগুলোর মধ্যে ছিল সে সময়কার সুবিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল, কালি ও কলম, প্রগতি প্রভৃতি।
আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রতীক পুরুষ জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরাপালক' প্রকাশিত হয় ১৯২৭-এ। সে সময় থেকেই তিনি তাঁর পারিবারিক উপাধি দাশগুপ্তের বদলে কেবল দাশ লিখতে শুরু করেন। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ ও মোহিতলালের কাব্যধারার প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ তাঁর কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়। তাতে তিনি 'রূপসী বাংলার কবি ' অভিধায় খ্যাত হয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে 'নির্জনতম কবি ' বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে 'শুদ্ধতম কবি' অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। সমালোচকদের অনেকে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি বলে মনে করেন।
জীবদ্দশায় তাঁর একমাত্র পরিচয় ছিল কবি। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো- ঝরাপালক, ধূসর পাণ্ডুলিপি, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, রূপসী বাংলা, বেলা অবেলা কালবেলা। মূলত কবি হলেও অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। তবে নিভৃতে গল্প এবং উপন্যাস লিখেছিলেন প্রচুর, যার একটিও প্রকাশের ব্যবস্থা নেননি। এছাড়া ষাট-পঁয়ষট্টিটিরও বেশি খাতায় 'লিটেরেরী নোটস ' লিখেছিলেন, যার অধিকাংশ এখনও প্রকাশিত হয় নি।
বাংলা সাহিত্যের ভুবনে তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। তাঁর শেষের দিককার কবিতায় অর্থ নির্মলতার অভাব ছিল। 'সাতটি তারার তিমির ' প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ ওঠে। নিজ কবিতার অবমূল্যায়ন নিয়ে জীবনানন্দ খুব ভাবিত ছিলেন। তবে কবি নিজেই নিজ রচনার কড়া সমালোচক ছিলেন। তাই সাড়ে আটশত কবিতার বেশি কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২ টি কবিতা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন।
বুকজোড়া বরিশাল আর পায়ে কলকাতার উন্মুক্ত প্রান্তরের ঘ্রাণ- ওই দুই ভূখণ্ড কখনও একে অপরকে ছাপিয়ে, কখনও পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, জন্ম নিয়েছিল বাংলা কবিতার নির্জনতম, নিভৃত জগতের--জন্ম নিয়েছিল জীবনানন্দ-ভুবন।
জীবনানন্দ দাশের দুই সন্তান। পুত্র সমরানন্দ ও কন্যা মঞ্জুশ্রী। তবে জীবনানন্দের দাম্পত্য জীবন খুব সুখের ছিল না। তাঁর অসুখী দাম্পত্যের ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর বিভিন্ন গল্প উপন্যাসে। জীবনানন্দের গল্প উপন্যাসে অভিব্যক্ত হয়েছে দাম্পত্য জীবনের সঙ্কট, নরনারীর মনস্তত্ত্ব ও যৌন সম্পর্কের জটিলতা। ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে জীবনানন্দের স্বতন্ত্র প্রতিভা ও নিভৃত সাধনার উণ্মোচন ঘটে তাঁর মৃত্যুর পরে প্রাপ্ত অসংখ্য পাণ্ডুলিপিতে। তাঁর উল্খেযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- মাল্যবান, সুতীর্থ, জলপাইহাটি, জীবনপ্রণালী, বাসমতীর উপাখ্যান ইত্যাদি। তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা প্রায় দুশতাধিক। 'কবিতার কথা ' নামক তাঁর এক প্রবন্ধগ্রন্থ আছে।
![]() |
সমাপ্তি চৌধুরী |
জীবদ্দশায় কথাসাহিত্যিক হিসেবে জীবনানন্দের কোনো পরিচিতি ছিল না। তিনি সম্পূর্ণ নিভৃতে উপন্যাস-ছোটোগল্প লিখেছিলেন এবং জীবদ্দশায় একটিও প্রকাশ করে যান নি। তাঁর মৃত্যুর পর উপন্যাস-গল্পের পাণ্ডুলিপির খাতাগুলো আবিষ্কৃত হয়। কবিতায় যেমন, কথাসাহিত্যেও তেমন তিনি তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা, তাঁর সমসাময়িকদের থেকেও তিনি সম্পূর্ণ আলাদা।
জীবনানন্দ দাশের প্রাবন্ধিক পরিচয় অদ্যাবধি বিশেষ কোনো মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় নি। সাহিত্য, শিক্ষা, সমাজ-- এই তিনটি পরিক্ষেত্রে জীবনানন্দ প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো লিখেছেন। তাঁর বিশিষ্ট প্রবন্ধগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো-- 'কবিতার কথা ', 'রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা' , 'কবিতাপাঠ ' , 'দেশকাল ও কবিতা ' , 'শিক্ষার কথা ' প্রভৃতি। বলা যায় যে সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতা নিয়ে জীবনানন্দ বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ উপহার দিয়েছেন। প্রতিটি রচনাই বহুমাত্রিক মৌলিক চিন্তাসূত্রের স্বাক্ষর বহন করে।
জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন ' কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত হয় (১৯৫২)। এছাড়া 'জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা ' গ্রন্থটিও ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে।
জীবনানন্দের বহুচর্চিত কবিতা 'বনলতা সেন '। কে ছিলেন বনলতা সেন? আসলে বোধহয় জীবনানন্দ চাইতেন না তাঁর ভিতরের নির্জন স্থানটি কোনও ভাবে উপদ্রুত হোক।
ব্রাহ্মবাদী পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা জীবনানন্দ প্রথমদিকে ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে কবিতা, প্রবন্ধ লিখলেও পরে আর সেই জগতের কাছে ফেরত যান নি। কারণ, ততদিনে জীবনানন্দের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল ধানসিড়ি নদী, নীল হাওয়ার সমুদ্র,শব্দহীন জ্যোৎস্নারা! আর জন্মেছিলেন বনলতা সেন। কিন্তু কে এই বনলতা সেন?--- শোনা যায় তিনি জীবনানন্দের এক খুড়তুতো বোন ছিলেন। তাঁর প্রতি দুর্বল ছিলেন উনি। কিন্তু সম্পর্ক গড়ার সাহস পান নি। তাঁর ছায়াতেই তিনি বনলতা সেন লিখেছিলেন বলে মনে করা হয়। আবার জীবনানন্দের ডায়রিতে 'ওয়াই'(Y) বর্ণ সংকেতে এক নারীর প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। এই 'Y' জীবনানন্দের খুড়তুতো বোন বুলুর বান্ধবী। বরিশালেই তাঁকে চিনতেন জীবনানন্দ, তিনি অনেকখানি মন জুড়ে ছিলেন জীবনানন্দের। তিনিও 'বনলতা সেন ' হতে পারেন। জীবনানন্দের কাছে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সবসময়ই মুচকি হেসেছেন, কোনো উত্তর দেননি।
জীবনানন্দকে চিরপথিক বলে মনে করা হয়। পথ চলাতেই তাঁর আনন্দ। জীবনানন্দ রোমান্স, অতি রোমান্স, প্রতীকীবাদ, ব্যঞ্জনারসের মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছেন। জীবনানন্দ দাশ,উত্তর রবীন্দ্রনাথের ভাবধারার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। ১৪ ই অক্টোবর, ১৯৫৪------ প্রতিদিনের মতো ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ------ভয়ঙ্কর এক ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন তিনি। গুরুতরভাবে আহত জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে এসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা তাঁকে উদ্ধার করে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করেন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: 1 -A write up on Jibanananda Das-- Anandabazar- Anandabazar patrika.
https :// www. anandabazar. com
2 _ bn.banglapedia.org
দাশ জীবনানন্দ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন