লকডাউন : চন্দন কুমার কুণ্ডু

চন্দন কুমার কুণ্ডু
লকডাউন        

চন্দন কুমার কুণ্ডু


দুটো সাদা টাটাসুমো সাইরেন বাজাতে বাজাতে শহরের রাস্তার ধারে বসা অস্থায়ী বাজারটার গা ঘেঁসে এসে দাঁড়াল। সারা দেশে লকডাউন চলছে। বাজারে জনসমাগম খুবই কম। অন্যান্য সময় যেমন ঠাসাঠাসি ভিড় আর হইচই থাকে  তেমন নেই। আবার লোকজন একেবারেই নেই এমনও নয়, দোকাটপাট একপ্রকার বন্ধ। রাস্তার ধারের চায়ের দোকান গুলোতে এসময় ধোঁয়া ওঠা চা-এর ভাঁড় হাতে আড্ডা জমে যেত। বাজার করতে এসে অনেকেই ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই দাঁড়িয়ে যেত কিছুক্ষন। সেই সব দোকানগুলোও জনশূন্য। বড় রাস্তার ধারে যে ছেলেটি আখের রস বিক্রি করত সেও নেই। একধারে রস বের করা যন্ত্রটি একাকি উপহাসের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার নিচে একটি কুকুর  নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। সারা শহর কারফিউ কবলিত অঞ্চলের মত স্তব্ধ হয়ে আছে যেন।

বীনতা বাজারের থলে হাতে বেরিয়েছে; অনেক সংকোচ আর আশঙ্কা তার মনে। রাস্তাটাও বিশ্রাম নিচ্ছে যেন। একটা টোটো বা রিক্সাও চোখে পড়ছে না। বীনতা সামান্য কিছু সব্জী  সবে মাত্র থলেতে ভরেছে ঠিক সেই সময়েই সাইরেন বাজিয়ে গাড়ি দুটোর আগমন। ওগুলো যে পুলিশের গাড়ি তা বুঝতে অসুবিধা হল না তার। সামনে পিছনে বড় বড় হরফে ইংরেজিতে লেখা POLICE. শান্তিরক্ষকরা সাদা গাড়িই ব্যবহার করেন আজকাল। - কালো রথের চল কী উঠে গেল!  -কি জানি! এ সমস্ত ভাবনার মাঝেই চেঁচামেচি শুনে সামান্য পিছন ফিরতেই দেখল, সব্জী সহ একটি সাইকেল ভ্যান  কয়েকজন পুলিশকর্মী লাথি মেরে  উল্টে দিচ্ছে। ভ্যান থেকে আলু, পেঁয়াজ, টমেটো রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বছর চল্লিশের ক্ষীণদেহী মহিলা হাতজোড় করে কাকুতি মিনতি করে চলেছে। পুলিশকর্মীরা সব্জী ভর্তি ভ্যান উল্টে দিয়েই ক্ষান্ত হল না, কয়েকজন পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে দিল সব। দুজন ভারি চেহারার মহিলা পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে সব্জী বিক্রেতা মহিলার পিছনে বাড়ি মারল কয়েকটা। মহিলা যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠে টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাস্তার একদিকে। ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল বাজারে। কয়েকজন যুবক ও প্রৌঢ়কে পেটাতে পেটাতে আর অশ্রাব্য ভাষায় গালা গালি দিতে দিতে বাজার খালি করে দিল পুলিশ। গাছের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বীনতা। চোখ ফেটে জল এল তার।
            
বীনতার বাবা অনিরুদ্ধ বাবু একটি  বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। বছর দুয়েক আগে অফিসেই হঠাৎ অসুস্থ বোধ করেন। অফিস থেকে হাসপাতালে ভর্তিও করেছিলেন সহকর্মীরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। সেকথা মনে পড়লে এখনো কান্না চেপে রাখতে পারে না বীনতা। শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের জল সংবরণ করে সে। অফিস থেকে সেদিন অনেকেই এসেছিলেন সমবেদনা জানাতে। অফিসের বড়বাবু কথা দিয়েছিলেন যাতে বীনতা বাবার কাজটা অন্তত পেতে পারে  সে ব্যাপারে সাহায্য করবেন। বীনতার স্পষ্ট মনে আছে ধীরেন কাকু মায়ের হাত দুটো ধরে বলেছিলেন,     
-আপনি চিন্তা করবেন না বৌদি,আমরা তো আছি; একটা কিছু ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। বলেছিলেন,  -ভাইঝি তো আমাদের ও মেয়ে, আমরা ওকে ফেলবো না দেখে নেবেন।
 
নির্ঝঞ্ঝাট অনিরুদ্ধ বাবুর সদ্যবিধবা স্ত্রী নিভাননা দেবী বিশ্বাস করেছিলেন, ভরসা করতে পারেন নি বোধ হয়। গ্ৰ্যাজুয়েশনটা আর কমপ্লিট করতে পারেনি বীনতা।  মা-মেয়েতে ছুটোছুটি করে অফিস থেকে বাবার পাওনা গণ্ডাটুকু আদায় করতে পেরেছিল মাত্র। চাকরি আর হয়নি বীনতার। দোতলার ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে চলে আসা কোর্টের মামলায় উকিলের কাছে আর যেতে পারে নি তারা। একতরফা ডিগ্ৰী পেয়ে ভাড়াটিয়া ভাড়া দেওয়া বন্ধ করেছে , তাও বছর খানেক হয়ে গেল।

উপায়ান্তর না পেয়ে, পাড়ার কয়েকজন শুভানুধ্যায়ির কথায় বীনতা একদিন অনেক সাহস সঞ্চয় করে স্থানীয় এম.এল.এ র সঙ্গে দেখাও করেছিল। সব শুনে তিনি দুঃখিত হয়েছিলেন ঠিকই, সাহায্য করতে চাননি তাও নয়; কিন্তু এম.এল.এ সাহেবের প্রস্তাবে রাজী হতে পারে নি বীনতা। এম.এল.এ সেদিন বলেছিলেন,
-সবই শুনলাম। দুঃখজনক তো বটেই কিন্তু কি জানো, এমনি এমনি এখন কেও কাজ দেয় না। তোমার বয়স কম , গ্ৰ‍্যাজুয়েট ও নও , কী কাজ করবে?
-আমি যে কোনো কাজই করতে পারবো স্যার।
‌অনেক কষ্টে ঢোঁক গিলে বলেছিল সে। ননম্যাট্রিক এম.এল.এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন , তাঁর
ফাই ফরমাস থেকে শুরু করে বডি ম্যাসাজ ইত্যাদি কাজ করতে যদি পারে তবে যেন চলে আসে।
- আর একটা কথা,মাঝে মাঝে রাতেও থাকতে হতে পারে,  এটাও বাড়িতে যেন বলে রাখে সে। এসব কথার মানে বুঝতে অসুবিধা হয়নি বীনতার। পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের দিয়েও প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিলেন এম.এল.এ। তার পর পাড়ায় খুব একটা বের হয় না সে। কেমন একটা সঙ্কোচের কালো ছায়া তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে সবসময়।

লকডাউন চলছে। দু একটি সাইকেল , মোটর সাইকেল ছাড়া রাস্তা প্রায় ফাঁকা। বড় রাস্তা পার হয়ে সামনের ফাঁকা চা দোকানটা পাশ কাটিয়ে গলির মধ্যে ঢুকে যায় বীনতা। বাড়ি ঢোকার ঠিক আগেই বাঁদিকের বাড়ির  সদর দরজাটা চোখে পড়ে। হাট করে দরজাটা খোলা , সকাল থেকেই তারস্বরে টিভিতে খবর চলছে; - বিশ্বে করোনা পরিস্থিতি উদ্বেগ জনক। আমেরিকায় মৃতের সংখ্যা ষাট হাজার ছাড়িয়েছে। সংবাদ পাঠিকা গলায় যতদূর সম্ভব আবেগ ঢেলে বলে চলেছেন, - ইতালীতে মৃত্যু হয়েছে ছাব্বিশ হাজার মানুষের।  ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বাইশ হাজার ,কুড়ি হাজার,
পর পর এমন ভাবে বলে চলেছেন যে সব তালগোল পাকিয়ে গেল তার। সংবাদ, পাঠিকা বলে চলেছেন, - ভারতে  করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হুহু করে বেড়ে চলেছে। লকডাউন অমান্য করে মানুষের ভিড়ের ছবি, পুলিশ কত জনকে গ্ৰেপ্তার করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

তৃতীয় দফায় লকডাউন চলছে। সামান্য যেটুকু টাকা পয়সা ছিল অনেক আগেই শেষ হয়েছে সবটুকু। মা- মেয়ের যৎসামান্য অলংকার ও গোপনে পরিচিত স্যাকরার বাড়িতে দিয়ে এই ক' দিনের উদর পূর্তি হয়েছে। এরমধ্যে একদিন বাড়ির সামনে পলিথিনের প্যাকেটে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির  রেখে যাওয়া চাল, ডাল, আলু দিয়ে দিন সাতেক চালিয়েছে তারা, কিন্তু এর পর? এই ভাবনাতেই যেন গতকাল রাতে অসুস্থ বোধ করেছে বীনতা। চিন্তাটাকে আর বাড়াতে পারেনি। সারা রাত ঘুম হয়নি মা,মেয়ে দুজনেরই, কী হবে! সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে পেতে কয়েকটা টাকা বীনতার হাতে দিতে পেরেছে মা নিভাননা দেবী। তাই নিয়েই আজ বাজারে গিয়েছিল সে। ফিরে মনে হল, না গেলেই বুঝি ভালো হত। তাহলে জীবন আর জীবিকা নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি তাকে দেখতে হ'ত না।

বাড়িতে ঢুকেই মনে হ'ল গলাটা যেন আটকে আসছে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। মাথাটা কেমন যেন টলমল করতে লাগল। কোনো রকমে জানলার গরাদ ধরে বসে পড়ল । মা তাড়াতাড়ি জল নিয়ে এলেন, কপালে হাত ঠেকিয়ে চমকে উঠলেন,
- তোর গা যে  জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে বিনি!
- চুপ কর মা, জ্বর হয়েছে একথা এখন উচ্চারণ করাও মানা।
- বেরিয়েছিলি যখন মোড়ের মাথার ওষুধের দোকান থেকে দুটো ওষুধ নিয়ে এলেই পারতিস।
- ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ দেবে না মা।
বিনির ব্যাগেই তো মাস তিনেক আগের কেনা প্যারাসিটামল আছে, সেকথা মনে পড়তেই নিভাননা দেবী ওষুধ এনে খাইয়ে দিলে সাময়িক জ্বর কমে যায়। রাত্রে প্রায় কিছুই খেতে পারে না বীনতা।জ্বরটা থাকলেও খুব বেশি নেই। পরদিন সকাল থেকে আবার জ্বর বাড়ে। বীনতা বলে,
- ও কিছু হবে না মা। কিন্তু তুমি একথা কাউকে বোলো না।
সেদিন পাড়ার ক'জন বলাবলি করছিল, চিন এ করোনা আক্রান্ত এলাকার  সব মানুষদের মেরে ফেলা হয়েছে। এখানেও জ্বর, সর্দি, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে রোগিকে কোন হাসপাতালে রাখা হচ্ছে বাড়ির লোক জানতেও পারছে না। মারা গেলেও লাশ গোপনে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। নিভাননা দেবী  বললেন,
- কিচ্ছু হবে না তোর, আর একটা ওষুধ খেয়ে নে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
বলতে বলতে তার গলাটা যেন কেঁপে গেল। পাড়ার লোক জানতে পারলে বীনতাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে। তাকেও যেতে হবে কোয়ারান্টিনে। ফিরে এসে হয়তো দেখবেন, ভাড়াটিয়া পুরো ঘর দখল করে বসেছে। কেউ তাদের মত গরীবের পক্ষ নিয়ে পাশে দাঁড়াবে না, তা তিনি জানেন।

দিনের বেলা কোনো রকমে কাটলেও রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে এখন প্রহরে প্রহরে পাখি ডেকে উঠছে। তখন জ্বরের ঘোর কমে এলে মাঝে মাঝে চমকে উঠছে বীনতা। এখন সারারাত গাড়ি চলার শব্দ নেই। ট্রেন ও বন্ধ। শ্মশানের শান্তি যেন চারিদিকে। এমনি ভাবে চারটে রাত কাটলেও পঞ্চম রাত্রে জ্বর আরো বেড়ে গেল। তার সঙ্গে অনেক দিনের সময় মত ও পর্যাপ্ত খাবারের অভাব  ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। রাত্রে জ্বরের  সঙ্গে শ্বাসকষ্ট শুরু হল।  মনে হ'ল যেন দম বন্ধ হয়ে যাবে এখনি। নিভাননা দেবী ঈশ্বরকে ডাকলেন। কিন্তু রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জ্বর ও বেড়ে চোলল। জ্বরের ঘোরে বীনতার চোখে ভেসে উঠল, শয়ে শয়ে পরিযায়ী শ্রমিক রেল লাইন ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে হেঁটে চলেছে। বীনতাও তাদের সঙ্গী হয়েছে। সে চলতে পারছে না। বার বার  পিছিয়ে পড়ছে। তবু আবার দৌড়ে গিয়ে সঙ্গ নিচ্ছে তাদের। পাথরে পা কেটে রক্ত ঝরছে তবুও তার হাঁটার বিরাম নেই; হাঁটছে তো হাঁটছেই।

নিভাননা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, -কিছু বলছিস মা? অস্ফুট স্বরে উত্তর এল, -আমি- আসছি -মা, আ-মি - আ-স-ছি
- বিনি-
কারখানার সাইরেনের মত  হর্ণ বাজিয়ে যমদূতের মত ছুটে আসছে একটা মালগাড়ি। প্রাণপণে পা দুটো রেল লাইনের বাইরে বের করে আনতে চাইছে বীনতা কিন্তু কিছুতেই পা দুটো উঠছে না। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে চাইল কিন্তু অস্ফুট একটা গোঙানির  শব্দ হ'ল মাত্র। ভেতরের সবকিছু যেন ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে  চাইল। মাথাটা মায়ের কোলে হেলে পড়ল। মা নিভাননা দেবী মেয়ের মাথা কোলে নিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন। রাত্রির অন্ধকার গাঢ় হয়ে এল।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.