![]() |
'তিন এক্কে তিন' ও কিছু কথা : মাধবী দাস |
Illusion of reality গড়ে তোলাই নাটকের মূল লক্ষ্য ।'তিন এক্কে তিন ' নামের তিনটি একাঙ্ক নাটকের এই বই যথার্থই সংলাপ কথোপকথন মঞ্চ নির্দেশের সমাহারে রচিত একটি নাটকের বই। এটাই নাট্যকার প্রশান্ত সেন এর প্রথম নাটকের বই। এর আগে তাঁর 'চোদ্দো ভূতের পদ্ম', 'ছড়া আসুক ছড়ছড়িয়ে', 'প্যালা পুঁটি জমাট জুটি', 'ছন্দ ছড়ার রিংটোন' প্রভৃতি ছড়ার বই। অণু কবিতার বই -'খণ্ডিত শিশমহল',গল্পের বই- 'পৌনঃপুনিক' প্রকাশিত হয়েছে।আলোচ্য বইয়ের 'লেখক পরিচিতি' থেকে জানা যায়- বহুমুখী প্রতিভাধর প্রশান্ত সেন এইসব রচনার পাশাপাশি মঞ্চে অভিনয় করতে এসে নিজেই লিখে ফেলেন নাটক তিনটি। একজন পাঠক হিসেবে বারবার মনে হচ্ছিল নাটক যেহেতু ফলিত সাহিত্যকর্ম তাই নাটকগুলোর সাফল্য ও সার্থকতা ,অভিনয়শৈলী, মঞ্চনির্মাণ শিল্প, আলো, রূপসজ্জা সবমিলিয়ে উপভোগ করতে পারলেই যেন বেশি ভালো লাগতো।
সার্থক নাটকের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য: সূচনা -জটিলতা -শীর্ষবিন্দু- গ্রন্থিমোচন- সমাপ্তি। প্রশান্ত সেনকে দেখি একাঙ্ক নাটক গুলিতেও এইসব বৈশিষ্ট্য অনেকটাই রাখার চেষ্টা করেছেন। ক্লাইম্যাক্সে ওঠার পর সুন্দর Falling action এর মধ্য দিয়ে ইতিবাচক সমাপ্তিতে পৌঁছে জার্মান সমালোচক Gautav freytag এর পিরামিড কাঠামো কে অনুসরণ করেছেন।
বইটির প্রথম নাটক 'হিয়ার মাঝে'। বলা যায় অন্য দুটি নাটকের প্লটের তুলনায় এর প্লট অভিনব চিন্তার ফসল। মূলত দুইটি চরিত্রের সংলাপ থাকলেও সোমেশ্বর এবং মালবিকার যৌবনকালের সংলাপগুলো আলাদা করে বোঝাতে মঞ্চে চারজনকে অভিনয় করতে হয়। হার্ট রিপ্লেসমেন্ট এর মতো অত্যাধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাহিনিকে সামনে রেখে নাট্যকার যেভাবে নাটকের সংলাপে শেক্সপিয়ারের 'ওথেলো' নাটকের সংলাপকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন তা প্রশংসনীয় হলেও একথা বলতেই হয় এমন আরও দু-একটি ইংরেজি সংলাপ নাটকটিকে অভিজাত্যের অন্তঃপুর থেকে বের হতে দিল না।
পাশ্চাত্যের আধুনিক নাট্যচর্চার অন্যতম ফসল অ্যাবসার্ড নাটকের অভিব্যক্তিবাদ ও পরাবাস্তববাদ এর মতো ব্যক্তি চিন্তার উৎকেন্দ্রিকতায় পাঠক তথা দর্শক কে দাঁড় করিয়ে নাট্যকার প্রশান্ত সেন দেখাতে চেয়েছেন একজন মানুষ নির্বান্ধব হয়ে গেলে জীবনের অর্থহীনতা থেকে একাকিত্বে ভুগেভুগে কেমন করে শূন্য থেকে অস্তিত্ব পীড়িত হয়ে আবার শুন্যে ফিরে আসে। এখানে জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা, অবসাদ, হতাশা, মৃত্যু কামনার সঙ্গে সঙ্গে অতীতের মধুময় ঘটনা -বিক্ষেপ একজন মানুষকে কেমন করে পীড়িত করে সেটাই ফুটিয়ে তুলেছেন।
দ্বিতীয় নাটক 'জড় আয়ু' । কন্যাভ্রূণ হত্যার মতো পুরুষ শাসিত সমাজের চির পরিচিত নগ্নসত্যকে এঁকেছেন একটি চরিত্রের (স্বপ্নলতা) সংলাপের মধ্য দিয়ে। স্বপ্নলতা আসলে একটি মৃত কন্যাভ্রুণ। এই নাটকটিতে উচ্চতর কিছু ডায়লগ আছে যা প্রবাদের মতো প্রেক্ষাগৃহ থেকে আসার পর বা পাঠের পর কানে বাজতে থাকে। নাটকের নিজের লেখা গানগুলো এতটাই নিপুণ ছন্দে লেখা যা প্রমাণ করে নাট্যকার কবিও বটে।
শেষ নাটকটি 'র্যাটরেস'। বাবা-মায়ের উচ্চাশা কেমন করে সন্তানদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে, জীবনের মূল স্রোত থেকে দূরে ঠেলে দেয় তাই এই নাটকটির মূল বিষয় ।এখানে প্রযুক্তির ব্যবহার ,ফ্ল্যাট কালচার, ইংরেজি মাধ্যম ছেলেমেয়েদের বাচনভঙ্গি সবকিছু ফুটে উঠেছে। 'কেদার' চরিত্র হাস্যরস আস্বাদনের জন্য পরিকল্পিত হলেও পুলিশের মুখে 'জয়ের' আপাত মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আঁতকে উঠতে দেখা যায় -"কন কী বড়বাবু ?জয়রে তো আমি পার্কে শেষ দ্যাহছিলাম- শ্যাষে কিনা পোলাডা--" এই সংলাপের মধ্য দিয়ে চিরাচরিত পরনিন্দা-পরচর্চা মশগুল বাঙালির অপরপিঠে যে আন্তরিকতা বিরাজ করে সেটাই ফুটে উঠেছে। সামাজিক সচেতনতার প্রয়োজনে 'র্যাটরেস', 'জড় আয়ু' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ভাষাও সহজ-সরল।
অস্থির সময়ের প্রাসঙ্গিক তিনটি বিষয় নিয়ে নাটকগুলি রচিত। এর মধ্যেই 'হিয়ার মাঝে' নাটকের প্লট ভাবনা উচ্চভাবনার প্রতিফলন হলেও বাকি দুটো নাটকের প্লট খুবই চেনা, খুবই সিম্পল কিন্তু উপস্থাপনের প্রসাদ গুনে, পরিচালনা ও নির্দেশনার নিপুণতায় সেগুলো হয়ে উঠেছে প্রচুর নাটকের ভিড়ে একরাশ ব্যতিক্রমী স্নিগ্ধ ফুলের পরশ। বইটির উপরিপাওনা মঞ্চস্থ নাটকের কিছু দৃশ্যের ছবি। প্রকাশক 'ঈশপ',মূল্য ১৭০ টাকা। উৎসর্গ করা হয়েছে শ্রী রবীন চক্রবর্তীকে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন