![]() |
রীনা মন্ডল |
শহরে, বাবুর বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতো মনোয়ারা,ওরফে মনু। আজ মাস খানেক হলো,তার পরিচয় হয়েছে রাজমিস্ত্রী লাল্টুর সঙ্গে। বাবুর বাড়ির দোতলার নির্মাণকাজে যোগ দিয়েছে সে। মনু যখন চা নিয়ে যায় মিস্ত্রীদের জন্য, নানারকম বাহানায় কিছুক্ষন আঁটকে রেখে, তাকে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করতে থাকে লাল্টু । তার বাড়ির কথা, বাবা মা'র কথা,তার গাঁয়ের কথা। মনুর প্রথম প্রথম একটু সংকোচ হতো। তবে, এখন বেশ ভালোই লাগে তার, লাল্টুর সঙ্গে গল্পগুজব করে কিছুটা সময় কাটাতে। যতই হোক, উঠতি বয়স এখন। লাল্টুও বছর কুড়ির প্রাণবন্ত যুবক। তাই, তাদের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ হওয়াটা স্বাভাবিক।
মনু খুব গরিব ঘরের মেয়ে। বাবা কাঠের মিস্ত্রী। বাজারে, স্টীল আর ফাইবারের আসবাবপত্র আমদানী হওয়ায়, কাঠমিস্ত্রীর রোজগারে ক্রমাগত মন্দা দেখা দিচ্ছে । তাই কোনমতে টেনেটুনে সংসার চালায় তার বাবা। মনুর ছোট দুই ভাই আছে, আনোয়ার আর সানোয়ার । তারা দুজনেই স্কুলে পড়ে। কিন্তু অর্থাভাবে ক্লাস থ্রি'র পরে আর পড়া হয়নি মনুর। পরিবারকে সাহায্য করার জন্য দশ বছর বয়সেই তাকে শহরে এসে, নাসিম সাহেবের বাড়িতে পরিচারিকার কাজে যোগ দিতে হয়। লাগাতার চারবছর ধরে কাজ করছে , এ বাড়িতে। ক্রমে যেন ঘরের আরেক সদস্য হয়ে গেছে সে । গৃহিণীও খুব স্নেহ করেন তাকে।
কিন্তু ছেলেকে আর ফিরে পেলো না সে ।
এদিকে নানা নানীর কাছেই মানুষ হতে থাকে মনোয়ারার ছেলে রণি। দেখতে দেখতে চোদ্দটা বছর কেটে গেলো। রণি এখন পনেরো বছরের তরতাজা যুবক। বেশ মেধাবী এবং সুদর্শন । কিন্তু খুব খোলা মেলা স্বভাবের ছেলে রণি। ভালো খারাপ সব ধরণের ছেলেদের সঙ্গেই সদ্ভাব তার। সবার সঙ্গেই মেলামেশা। কোন বাছবিচার নেই। গ্রামেরই এক ছেলে, কিছুটা ধূর্ত স্বভাবের এবং জুয়াড়ে নইমের সঙ্গে ক'দিন ধরে তাকে ঘোরাফেরা করতে দেখে, তার মামা আনোয়ার, সাবধান করে দেয়,রণিকে। কিন্তু মামার কথায় বিশেষ আমল দেয়নি রণি।
একদিন মুম্বাইয়ে রাজমিস্ত্রীর কাজে কর্মরত লাল্টু একটা ফোন পেয়ে বেশ অবাক হলো। ছেলে রণি,দীর্ঘ একযুগ পর,নিজের পরিচয় দিয়ে, ফোন করেছে তাকে। কোনভাবে লোক মারফত আব্বার ফোন নম্বর জোগাড় করেছে সে। ফোন করে জানিয়েছে তার সব দুঃখকষ্টের কথা। তার পড়াশোনার খরচ চালানো নাকি ইদানীং খুব দুরূহ হয়ে উঠেছে। সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা।ভালো রেজাল্টের জন্য তার কয়েকটা বিষয়ে টিউশনের দরকার। কিন্তু হতদরিদ্র কাঠমিস্ত্রী নানা সে খরচা দিতে পারছে না। তাই আব্বার কাছে অর্থ সাহায্য চায় সে।
বিগত চোদ্দ বছর যাবৎ ছেলের সঙ্গে কোনই যোগাযোগ নেই লাল্টুর। মনোয়ারার মৃত্যুর পর তার বাপের বাড়ির লোকজন আর দেখতে দেয়নি তাকে,তার ছেলের মুখ। কোনরকম সম্পর্কও রাখতে চায়নি তারা আর ,তার সঙ্গে। মনুর আত্মঘাতী হওয়ার পিছনে তার কোন হাত না থাকলেও মনুর বাপের বাড়ির লোক মনেমনে তাকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিলো। কারণ সে-ই যেঁচে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিলো তাকে, অথচ তার ভালোমন্দ দেখার বা নিরাপত্তা বিধানের কোন ব্যবস্থাপনা করেনি সে।
এতদিন পর ছেলের খোঁজ পেয়ে ও তার কণ্ঠস্বর শুনে বিগলিত হয়ে গেলো দুর্বল পিতার অন্তর। তাই সঙ্গে সঙ্গে তাকে অর্থসাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেললো লাল্টু। বেশ কয়েকবার টাকাও পাঠালো তাকে। কিন্তু দিনদিন রণির চাহিদা যেন বেড়েই চললো। শেষ পর্যন্ত একদিন একটা বাইক কেনার আব্দার করে বসলো সে। লাল্টুর মনে কেমন যেন সন্দেহ হলো। ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলো সে। লাল্টু বললো,সে তাকে সঙ্গে নিয়ে, নিজে গিয়ে বাইক কিনে দেবে । সেইমতো দিনক্ষণও ঠিক করে ফেললো।
কিছুদিন পর-----
রণির বাড়িতে আচমকা একদিন সর্বনাশের করাল ছায়া নেমে এলো। কে বা কারা তাকে খুন করে গ্রামের বাইরে, জলার ধারে ফেলে রেখে গেছে। শোকে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে গেলো রণির গোটা পরিবার। পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করলো। পুলিশকে প্রাথমিক ভাবে রহস্য সমাধান করতে বেশ বেগ পেতে হলো। কারণ রণির সঙ্গে কারও কোনরকম শত্রুতাই ছিলো না। গ্রামের সব রকম মানুষের সঙ্গেই ছিলো তার সুসম্পর্ক।
ইতিমধ্যে লাল্টু একদিন তার শ্বশুরবাড়ি এসে হাজির হলো। তার কাছে সব শুনে তো পুলিশ আরো ধন্ধে পড়ে গেলো। কারণ, তার পরিবারের কাছে জানা গিয়েছিলো, রণি ছিলো খুব আলাভোলা, সাদাসিধে ধরণের ছেলে । পড়াশোনার ব্যাপারে তার কোন সমস্যাও ছিলো না। সে যে বাবার কাছে টাকা নিয়ে,ফুর্তি করবে বা মোটরবাইক কিনতে চাইবে, এ ধরনের কোন মানসিকতাও ছিলো না তার। ফলে রহস্য আরো দানা বাঁধলো।
লাল্টুর ফোনের কললিস্ট থেকে জানা গেলো যে তার সঙ্গে, ছেলের পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করেছিলো যে, সে আদপেই রণি ছিলো না। পুলিশ তখন, কাদের সঙ্গে রণি বেশি মেলামেশা করতো,তাদের ধরে,ধরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো।অবশেষে আসল কালপ্রিট ধরা পড়লো।পুলিশ জানতে পারলো,রণির বন্ধু নইম-ই, লাল্টুর ফোন নম্বর জোগাড় করে, তার কাছ থেকে রণির নাম করে এতদিন যত টাকাপয়সা আত্মস্যাৎ করেছে। ক্রমে তার লোভ আরো বাড়তে থাকে। কিন্তু লাল্টু নিজে তার সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ায়, ঘটে যায় যত বিপত্তি!
তার সব ফন্দিফিকির ফাঁস হয়ে যাবার আশঙ্কায়, সে শেষে রণিকে মাথায় পাথরের আঘাত মেরে খুন করে, ফেলে যায় । ভেবেছিলো, রণি মারা যাওয়ার খবর পেলে, লাল্টু আর কোন খোঁজখবরই নেবে না । আর, সেও ধরা পড়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু অবশেষে, অপরাধীকে একদিন ধরা পড়তেই হয়, সে যতই চালাকচতুর হোক না কেন। ধরাও পড়লো। মাঝ থেকে নিরপরাধ রণিকে অকালে প্রাণ দিতে হলো। শান্ত, শিষ্ট , মিশুকে ছেলেটার এভাবে অপমৃত্যু ঘটাতে, শুধু তার পরিবারেই নয়, সারা গ্রামে ঘনিয়ে এলো এক অভূতপূর্ব শোকের বাতাবরণ । সঙ্গদোষ যে কিভাবে মানুষের সর্বনাশ ডেকে আনে, এটা তারই একটা জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন