করোনার দিনে রামায়ণ : মৃদুল শ্রীমানী

করোনার দিনে রামায়ণ : মৃদুল শ্রীমানী
করোনার দিনে রামায়ণ : মৃদুল শ্রীমানী


অযোধ‍্যায় হাহাকার। শুধু রাজধানী শহর অযোধ‍্যা বলি কেন, গোটা কোশল রাজ‍্য জুড়ে তোলপাড়। কেননা যুবরাজ রামচন্দ্র বনবাসে যাবেন। দুচার দিন জঙ্গলে বা অভয়ারণ্যে ফাইভস্টার রিসর্টে সিক্রেট হানিমুন নয়। একেবারে একটানা চৌদ্দ বছর বনবাস। মহারাজ দশরথ মেজোরাণি কৈকেয়ীর কায়দায় কুপোকাত। বড়রাণি কৌশল‍্যার দৌলতে যদিও গোটা কোশল রাজ‍্য পণ হিসেবে পেয়েছেন, আর তার অনেক দিন পরে নন্দীগ্রামের আন্দোলন দমাতে গিয়ে কৈকেয়ীর উপর চোখ পড়ে তাঁর। বড়রাণি কৌশল‍্যা রাজাকে যত্ন করেন যথেষ্ট। কিন্তু তিনি ভারি নরম সরম ব‍্যক্তিত্বের মানুষ। দশরথের যৌবন কেটেছে প্লেবয়, ডেবোনেয়র ম‍্যাগাজিনের পাত উলটে‌। ইংরেজি তো ছাই জানেন তিনি, কিন্তু নারীদেহের রহস্য আবিষ্কার করতে হাতে প্রচুর কাঁচা পয়সা আর অঢেল সময় থাকলেই চলে। 

জম্বুদ্বীপের প্রায় সব রাজা রাজড়ার তাই নারী সম্ভোগের চ‌ওড়া ব‍্যবস্থা। তো কৈকেয়ীর যৌবন দেখে মজে গিয়েছিলেন দশরথ। তখন অনেক সিনিয়র। যদিও ছেলে হয় নি। মেয়ে একটা ছিল। তো সে অফিসিয়াল বিয়ের নয়। কাঁচা বয়সের রোমান্স মাত্র। তাই সে মেয়েকে লোমপাদের হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বাপের রক্ত যাবে কোথায়। মেয়েটা প্রেমে পড়ল এক ঋষি কুমারের। নাম ঋষ‍্যশৃঙ্গ। ছেলেটা ভাল। ঋষি মানে গরিব বনবাসী বামুন। তো কোনো পণ টন ছাড়াই বিয়ে হল সে মেয়ের। দশরথ শুনে ছিলেন ঋষ‍্যশৃঙ্গ না কি দারুণ সেক্সি। হরিণের শিংয়ের একটা ভায়াগ্রা টাইপ ভাইটালাইজার বানাতে জানে সে।  বাচ্চা হ‌ওয়ার ব‍্যাপারে ফরেন ডিগ্রি আছে তার। তো বাচ্চা কিছুতেই হচ্ছিল না বলে অনেকেই বলেছিলেন অ্যাডপশন করতে। দশরথের মন সরে নি। তাছাড়া নিজের হাতে তিনি পুরো কোশল রাজ‍্যে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটিগুলি ভেঙে দিয়েছেন। আর ওই কমিটির রেকমেন্ডেশন ছাড়া ডিসট্রিকট জজ বাচ্চা হাতে তুলে দেবেন না। 

যাই হোক, ফেলে দেওয়া মেয়ের বর ঋষ‍্যশৃঙ্গের দৌলতে দশরথ আজ চার চারটি ছেলের বাবা। ছেলেরা বড় হয়েছে। বিয়েও হয়েছে সব কটার। তবুও দশরথ এখানে ওখানে ভাইটালাইজার আর অ্যাফরোডিসিয়াক খুঁজে বেড়ান। লোকজন কানাকানি করে রাজার গায়ে জোর বা তাকত থাকতে পারে। কিন্তু ভায়াগ্রা নিয়েও রাজার ইরেকশন হয় না। নিউরো প্রবলেম। ওইজন‍্যে রাজার যৌনখিদে লিবিডো হয়ে প্রকাশ পায়। তো এসব থার্ড ক্লাস কাগজে থার্ড পেজে মাঝে মধ্যে প্রকাশ পায়। কৈকেয়ী রাজা দশরথের এই দুর্বলতা আগাপাস্তলা জানতেন। ছেলে বড় হয়ে গেলেও কৈকেয়ীর যৌবন এখনো মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো। রাজার সাথে বিছানায় যাওয়া নিয়ে বিস্তর ফস্টিনস্টি করেন তিনি। কৈকেয়ীর দৌলতে অযোধ্যায় পোশাক শিল্পের দারুণ বিকাশ‌ও হয়েছে। মাঝে মাঝেই ফ‍্যাশন টিভির প্রোগ্রাম হয় সেখানে।

বাজারে যে খবরটা চাউর হয়েছে তা হল দশরথের উপর চাপ সৃষ্টি করতে মেরিলিন মনরোর একটা ছেঁড়া নাইটি পরে মেঝেতে শুয়ে ছিলেন কৈকেয়ী। না, হাটের মাঝে নয়। ফ‍্যাশনিস্তা কৈকেয়ী কখনো নিজেকে হেটো করেন নি। পাপারাৎজিরা বিস্তর চেষ্টা করেও তাঁর খোলামেলা পোশাকের ছবি তুলতে পায় নি। আর যত পায় নি, ড্রিম গার্ল হিসেবে কৈকেয়ীর গ্রাফ আকাশ ছুঁয়েছে। তো কৈকেয়ীকে মেরিলিন মনরোর ছেঁড়া নাইটি পরে শুয়ে থাকতে দেখে রাজা দশরথের প্লেবয় আর ডেবোনেয়র নাড়াচাড়ার অভ‍্যাস মনে পড়ে গেল। ফটোগ্রাফি নিয়ে যে কটা সিল করা ম‍্যাগাজিন বের হয়, সব কটা এখনো রাখেন দশরথ। কিন্তু, ছেঁড়া পোশাকের সঙ্গে কৈকেয়ী যে বিভ্রমজাল রচনা করলেন, হলিউডের কোনো ফিল্মে কোনো দুর্ধর্ষ ক‍্যামেরাম‍্যান অমন এফেক্ট দিতে পারেন নি।

 বুড়ো অথর্ব রাজা দশরথ নালেঝোলে হয়ে কৈকেয়ীকে জাপটে ধরতে গেলেন। কৈকেয়ী ইঞ্চিখানেক দূর থেকে এড়িয়ে যান। সালসা, ট‍্যাঙ্গো, আর আরো নানা কেতার নাচের ডিপ্লোমাওলা মেয়ে কৈকেয়ী। এককালের অঘটনঘটনপটীয়সী হার্টথ্রব বার ডান্সার কৈকেয়ী ভ‍্যাম্পের রোল প্লে শুরু করলেন। দশরথের একেবারে প্রাণ চায়, চক্ষু না চায় অবস্থা। প্রেশার তুঙ্গে উঠল। মাথা ঘুরে পড়লেন রাজা। আড়ালে ছিল মন্থরা। কৈকেয়ীর  হেয়ার স্টাইলিস্ট। সেইই নিলাম থেকে মেরিলিন মনরোর লাল নাইটি আনানো, আর গোটা প্ল‍্যানের ড্রাফট করেছিল। প্ল‍্যান খাপে খাপে মিলেও যাচ্ছিল। এমন সময় রাজা পড়ে যেতেই তাঁর জিভের নিচে সরবিট্রেট রাখল মন্থরা। কৈকেয়ী একটু নার্ভাস। ছেলে ভরত এখন বৌ নিয়ে লণ্ডনে। দশরথ পটল তুললে সবাই মিলে যদি রামকে রাজা বানিয়ে দেয় তাহলে মুশকিল। এমন সময় চিঁ চিঁ করে বুড়ো রাজা চোখ মেললেন। মোর প্রিয়া হবে এসো রাণি। মন্থরা কৈকেয়ীকে চোখ টিপল। যা চাইবার, এই সময় চেয়ে নাও। বুড়ো আর বেশিদিন টিঁকবে বলে মনে হচ্ছে না।

কৈকেয়ী আধো আধো দুষ্টু গলায় বললেন, ভরতকে রাজা করো, আর রামকে দাও বনবাস। শুনে রাজার আরেকবার মাথা ঘুরে গেল। এবার কৈকেয়ী আর রিস্ক নিলেন না পলিটিক‍্যালি কারেক্ট থাকবেন বলে, রাজপুরোহিত বশিষ্ঠকে ডেকে অযোধ‍্যার টপ কোয়ালিটি নার্সিং হোমে পাঠানোর বন্দোবস্ত করলেন। নার্সিং হোমে মন্থরা ফোন করে বলে দিল বুড়ো যদি টেঁসেও যায়, তাহলেও যেন আইসিসি ইউতে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রেখে দেওয়া হয় ভরত ফেরা অবধি। এই সার্ভিসের জন‍্য মোটা ইনামের ইঙ্গিত‌ও দেওয়া র‌ইল। বশিষ্ঠের সামনেই দশরথের ডিলিরিয়াম শুরু হয়েছিল। তিনি মিডিয়ায় সামনে বলে দিলেন, দশরথ বলেছেন, ভরত রাজা হবে আর রাম চৌদ্দ বৎসরের জন‍্য বনবাসে। ব‍্যাস, সাথে সাথে অযোধ‍্যা জুড়ে প্রবল গণবিক্ষোভ। নাগরিকের পছন্দের লিডার রাম। দশরথ অসুস্থ অবস্থায় কী বলেছেন না বলেছেন, জানার দরকার নেই। অনেকদিনকার ঘোষিত যুবরাজ রাম। তাকেই রাজা করতে হবে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বললেন, দশরথ যতক্ষণ জীবিত আছেন, ততক্ষণ তাঁর উইল কার্যকর করা যায় না। মৃত‍্যু ঘটলে ডেলিগেট জজের আদালতে প্রোবেট নিতে হবে।

 রাজা দশরথ ঠিক কি অবস্থায় নার্সিং হোমে গিয়েছেন, তা টপ সিক্রেট। তথ‍্য জানার অধিকার আইন এ ব‍্যাপারে খাটবে না , কেননা বিষয়টি বৈদেশিক রাষ্ট্রের সাথেও সম্পর্কিত। এই অবসরে সুপ্রিম কোর্ট বলে দিল কোনো মিডিয়ায় এ নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না।

এই অবস্থায় কানাকানি তুঙ্গে উঠল। তাঁকে নিয়ে জনগণ ও সুশীল সমাজের একাংশের তীব্র আবেগকে আকাশচুম্বী করে তুলতে রাম মিডিয়ার সামনে বাইট দিলেন, তিনি সম্পূর্ণভাবে আইনের শাসন ও সাংবিধানিক নিয়ম মান‍্য করতে প্রস্তুত। দেশ ও জাতির প্রতি আনুগত‍্যে রাম ও তাঁর পরিবার সমস্ত রকম আত্মত্যাগের জন‍্য তৈরি। ঘরে ফিরে রঘুরাজ রাম তাঁর স্ত্রী সীতা জানকীকে বললেন, নাও গুছিয়ে নাও, কাল মর্ণিঙে ফ্লাইট। সীতা রামের গলা জড়িয়ে ধরে বললেন, কবে বুক করেছিলে গো, ক‌ই আমায় তো কিচ্ছু বলো নি। ইউ নটি বয়!

রাম বললেন, বিশেষ কিছু লাগেজ নেবে না।

সীতা বললেন, জায়গাটা কোথায় তা তো বলবে। মরিশাস হলে একরকম লাগেজ। গোয়া হলে আরেক রকম। রাম অন‍্য দিকে মুখ করে থাকেন। সীতা বলেন বিজেপির আমলে গোয়া গিয়ে কিন্তু মোটেও সুখ নেই।

রাম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, লাগেজ গোছাও।

সীতা ধরে নিলেন দেওয়ালেরও কান আছে। এখন লুকোনো ক‍্যামেরার যুগ। পাপারাৎজিরা ঘুরে বেড়ায় আনাচে কানাচে। মন দিয়ে সীতা তিনখানা ঢাউসমার্কা ভিআইপি স‍্যুটকেস গুছিয়ে ফেললেন।

রাম খানিকটা সময় পার করে লাগেজের অবস্থা দেখতে এসে হতবাক। হে জানকী, তুমি কি করেছ জানো কি?

সীতা রামের দিকে একটা চুমু ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, আমি তোমাকে ভালবেসেছি হনি।

 তুমি না বড্ড বোকা বৈদেহী। কোথায় যাচ্ছি না জেনেই লাগেজ প‍্যাক করছ।

সীতা বললেন দ‍্যাখো নরচন্দ্রমা, তুমি এই যে ডেসটিনেশন বলো নি, এতে সেই রবিবাউলের সোনার তরী কাব‍্যগ্রন্থের নিরুদ্দেশ যাত্রা কবিতাটা মনে করিয়ে দিলে।... আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী...।

চুপ করো, চুপ করো। মেয়ে হয়ে তুমি যদি "সুন্দরী সুন্দরী" বলে চেল্লাও, লোকজন তোমাকে লেসবিয়ান বলে ভাববে।

ঠোঁট পাউট করে মৈথিলী বললেন, যাও আড়ি। তুমি আমায় লেসবিয়ান বললে কেন?

দুর মুখপুড়ি, আমি তোমাকে লেসবিয়ান বলব কেন, লোকজন যদি ভুল বোঝে!

লোক না পোক। যাও তো তোমাদের বাড়িতে বড্ড পলিটিক্স। সব সময় এ ওকে, ও তাকে কাঠি করছে।

বড়ো বড়ো রাজাদের অমন হয়।

দুর, কি ছাই রাজা তোমরা বুঝি না। আমার বাপের বাড়িতে আমরা বোনে বোনে কি সুন্দর থাকতাম। এই ফুল কুড়োচ্ছি, তো ওই কোকিলকে ডেকে ডেকে অস্থির করছি। এই দোলনায় দুলছি তো ওই ঝরণার জলে স্নান করছি।

হ‍্যাঁ, তোমার বাবা ছোট্ট একটা জায়গার রাজা। মিথিলা এই এতটুকু। আর আমাদের কত্তো বড়ো রাজত্ব। কত্তো বড় বংশ। আর কি বোলবোলাও।

এই দূর্বাদলশ‍্যাম, বলো না লেসবিয়ান মানে কী?

লেসবিয়ান মানে গে , না না, গে কেন বলছি, হোমোসেক্সুয়াল, না না, সে তো ছেলেতে ছেলেতে।

বস্, তার মানে তুমিও ভালো জানো না।

দুর পাগলি, জানবো না কেন। খুব জানি। কিন্তু পেটে আসছে, মুখে আসছে না।

অ্যাই, আমায় মৈথিলী বলো বলো, পাগলি একদম বলবে না।

 দুর, তুমি জয় গোস্বামী পড়ো নি! পাগলি, তোমার সঙ্গে হুলুস্থুলু কাটাবো জীবন।

ছাড়ো তো গোস্বামী বাবাজিদের কথা । সেই রবিবাউলের চতুরঙ্গে পড়েছি লীলানন্দস্বামীর কথা। এই যুগে আশারাম বাপু আর রামরহিম এক‌ই জিনিস। ওপরে ধম্ম ধম্ম, তলায় তলায় লীলেখেলা।

রাম মুখ গোঁজ করে আছেন দেখে সীতা তাঁর চিবুক ছুঁয়ে বললেন, ডার্লিং, রাগ করলে?

তুমি আমার নামে গাল দিলে কেন?

কি বলছ রঘুনাথ, তোমাকে গাল দিলাম ক‌ই!

ওই যে আশারাম আর রামরহিম বললে। ওতে যে আমার নাম!

তা কি করব বলো। ওই মহান ধর্ষণগুরুদের তো অমন নাম।

দ‍্যাখো সীতা, সতীনারী কখনো স্বামীর নাম উচ্চারণ করে না। একটু ঘুরিয়ে নিয়ে বলে। ধরো বরের নাম জগন্নাথ। তো সতীলক্ষ্মী মেয়ে হলে বলবে "ফগন্নাথ"।

জানকী হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ, শুনেছি। আমাদের বাপের বাড়ির পাড়ায় রথযাত্রার সময় একটা খুনখুনে বুড়ি বলত, ফয় ফগন্নাথ ফতে ফুটেছে, ফরিবোল, ফরিবোল।

রাম বললেন, বৈদেহী, তোমার যত্তোসব বাজে কথা। স্বামীর নাম মুখে উচ্চারণ করলে পাপ হয়।

হুঃ তোমাদের বাড়ির ওই কালচার। পাপ হয়! ডান পা আগে ফেলো না, পাপ হয়। বাঁ হাত ওভাবে নেড়ো না, পাপ হয়। ডিসগাস্টিং।

দ‍্যাখো মৈথিলী, বিয়ে হয়ে এসেছ, এখন শ্বশুরবাড়ি ই তোমার নিজের ঘর। এখানকার কালচার‌ই তোমার কালচার। এই হল সনাতন ধর্মের শিক্ষা।

নিকুচি করেছে তোমার ধর্মের। কেন যে তোমাকে বিয়ে করলাম। আমার জীবনের সবচাইতে বড় ব্লাণ্ডার।

কেন, তোমার কোনো গোপন প্রেমিক ছিল না কি?

 দ‍্যাখো রাম, একদম বাজে কথা বলবে না। আমরা বোনে বোনে বাপের বাড়িতে দারুণ ছিলাম। শকুন্তলা অনসূয়া প্রিয়ংবদার মতো।

তাই না কি।

হ‍্যাঁ গো। তোমাদের মতো ফ‍্যামিলি পলিটিক্স আমাদের ছিল না। ভায়েদের মধ‍্যে গ্রুপিজম! শুনলেই মনে হয় একটা রামথাপ্পড় কষিয়ে দি‌ই।

শোনো বড় বড় কোটিপতি ফ‍্যামিলিতে ওটা খুব স্বাভাবিক। দ‍্যাখো না অনিল আম্বানি, মুকেশ আম্বানি। সনিয়া গাঁধি আর মানেকা গাঁধি। সিপিএম আর সিপিআই। ঠুকঠাক লেগেই আছে। কোটিপতিদের ব‍্যাপার তুমি ছোটলোকের বাড়ি থেকে এসে বুঝবে কি করে?


কি আমার বাবাকে ছোটলোক বললে? জানো আমার বাবা কতো মহান? আমার বাবা তাঁর ভাই কুশধ্বজের মেয়েদের এমনভাবে মানুষ করতেন, লোকজন ভাবতেই পারত না যে ঊর্মিলা আর শ্রুতকীর্তি তাঁর নিজের মেয়ে নয়। ভায়ে ভায়ে এত আঁতের টান এযুগে কেউ দেখেছে? এখন এক ভাই এক পার্টি করে তো অন‍্য ভাই আলাদা পার্টি করে।

রাম অবাক হয়ে বললেন, তোমরা একবাপের বেটি ন‌ও?

শোনো রাঘবেন্দ্র, শুনে রাখো, আমি আমার বাবাকে দেবতার চাইতে বড় মনে করি। কেন জান?

কেন, কি এমন কাণ্ড করেছেন তিনি তাঁকে আকাশে ঠেলে তুলতে হবে?

চোখ পাকিয়ে সীতা ধমক দিলেন, খামোশ্ । তিনি এত মহান, যে আমি একটা অরফ‍্যান বাচ্চা, অ্যাডপশন করেছেন তিনি,  তবুও তিনি আমায় সবচাইতে বেশি ভালবাসতেন। বোনেরাও আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসত। শুধু তোমাদের মতো কূটকচালের বাড়িতে চারজনকে বিয়ে দিয়ে বাবা চরম বোকামো করেছেন। ছিলাম বোন, হয়ে গেলাম জা। রাতে গলা জড়াজড়ি করে না শুলে ঘুম হোতো না, বাড়ির কাজের মেয়েরা বলত, আমরা নাকি স্বপ্ন‌ও একসাথে দেখি। তোমাদের পাল্লায় পড়ে একবাড়িতে থেকেও বোনে বোনে দেখা হয় না।

সীতা, তুমি... তুমি অরফানেজ থেকে অ্যাডপশন নেওয়া বাচ্চা। তার মানে জাত জন্মের ঠিক নেই?

চুপ করো, রঘুপতি, জাত জন্ম নিয়ে তুমি অন্ততঃ একটাও কথা বলবে না।

কেন বলবো না রে ছোট লোকের বেটি, কেন বলব না শুনি?

হা রে মরদ, গায়ের জোরে মেয়েদের চুলের মুঠি ধরিস, উচ্ছন্নে যা। জীবনে তোর সুখ হবে না। যাতে হাত দিবি জ্বলে পুড়ে ছারখার যাবে। ওই যে লক্ষ্মণকে অতো ভালবাসিস বলে বলিস, দেখবি তোর কারণেই ওর জীবনটা নষ্ট হবে।

রাম রেগে গিয়ে গালি দিয়ে বললেন, কি বললি, আমি যাতে হাত দেব, তাই ছারেখারে যাবে? নচ্ছার মাগী, কাল সকাল হোক, তোকে এক কাপড়ে দূর করে দেব।

হা হা রে পেয়ারের ভাতার আমার! তোকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি নিজেই বেরিয়ে যাব। আমার খুসি!

রামচন্দ্র তেড়ে মেড়ে উঠে বললেন, আমি জানি তোর নাং কোথায় থাকে। তোর মতো একটা গেলে, দশটা আসবে। শালী অরফানেজ থেকে আনা মেয়ে। এমন জানলে কে বিয়ে করত?

হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জানকী বলেন, আমি ঠিক চলে যাবো। বাবা গো, এ কোন্ জানোয়ারের হাতে আমায় দিয়েছিলে বাবা। এর চেয়ে গলায় পাথর বেঁধে জলে ডুবিয়ে দিলে না কেন?

রাম বললেন, এই চোপ্ । একদম গলা থেকে আওয়াজ বের করবে না।

ততোধিক চিৎকার করে বৈদেহী বললেন, আওয়াজ বের করব না কেন শুনি? আমাদের দেশে মানবাধিকার কমিশন নেই? মহিলা কমিশন নেই? লিগাল এইড নেই? সংবিধান নেই। বেশ করব চিৎকার করব। সবার সামনে সব ফাঁস করে দিয়ে বেরিয়ে যাব।

রাম বললেন, কিন্তু যাবার আগে গয়নাগুলো দিয়ে যাবি। তোর নয় ওগুলো। সব আমার মায়েদের দেওয়ার। তোর বাপ একটা জ‍ঙ ধরা লোহার ধনুক ছাড়া কিছুই দেয় নি।

কেন, পণ দেবে কেন? জানো না, আমাদের দেশে পণ চাওয়া অন‍্যায়। পণ দেওয়াও অন‍্যায়। পণের কথাবার্তায় থাকাটাও অন‍্যায়। একেবারে ক্রিমিনাল অফেন্স। এত লেখাপড়া শিখে এত ডিগ্রি ঝুলিয়ে এটা শেখো নি।

রাম রাগে কি বলবেন ভেবে পান না।

 সীতা মাটিতে পা ঠুকে বলেন, শোনো রাম, যাকে তুমি জঙধরা লোহার ধনুক বলছ, সেটা খোদ শিবের গিফট করা ধনুক। তোমাকে বাবা ওটা ছুঁতে দিয়েছেন, সে তোমার সাত পু্রুষের ভাগ‍্য । ওটা একটা অ্যান্টিক জিনিস। ওটা থাকলে ওর ওপর গুনে গুনে একশোটা পিএইচডি হতে পারত।

হু! টান দিতেই  পলকা ধনুক ভেঙে গেল, কি আমার অ্যান্টিক রে?

হ‍্যাঁ। বটেই তো। অ্যান্টিক জিনিস খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হয়। হাত পর্যন্ত দিতে নেই। সব কিছুই ক্ষয় হয়। জানো না, পিরামিডের ভিতর মমিকে কত যত্নে কাপড় মুড়ে তারপর বাক্সের ভেতর রাখত?

তোমার মুখ দেখে গলে গিয়েছিলাম।

হ‍্যাঁ। সীতার গলায় ব‍্যঙ্গ ঝরে পড়ে। হ‍্যাঁ মুখ দেখে না আরো কিছু। সংস্কৃত কবিরা আমার দেহসৌন্দর্যের কথা বলেছেন। আমার ভাইটাল স্ট‍্যাটিসটিকস।

তাই হবে। খুব ভুল করেছিলাম। যদি জানতাম জাত জন্মের ঠিক নেই, একবার যদি খবর পেতাম...

দ‍্যাখো রাম, জাত জন্ম নিয়ে বারবার খোঁটা দেবে না বলছি। আমি কিছুই লুকোই নি। আমাদের সংবিধান জাত জন্মের কারণে মানুষে মানুষে ফারাক করে না। আর্টিকেল পনেরোর দুই ঘেঁটে দ‍্যাখো। আমাদের কবি বলেছেন, জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো। আমার কর্মের জোরে সবাই আমায় লক্ষ্মী ঠাকরুণ বলে। আমি কাউকে ঘুষ খাইয়ে সম্মান আদায় করি না।

তোর বাপ কেন বলে নি, এ অরফানেজ থেকে আনা মেয়ে। বললে আমি বিয়ে করতাম না।

বাবা বুঝতে পারেন নি তোমার মন কত কদর্য। তোমাদের বাবার ক‍্যারেকটার সম্বন্ধে আমার বাবার কোনো ধারণাই ছিল না। একটা ইমপোটেন্ট লোক জামাইকে ডেকে এনে আমার শাশুড়ি মায়েদের গর্ভবতী করেছেন। তার পর গপ্পো সাজিয়ে পরিবেশন করেছেন, চরু পায়েস খেয়ে বাচ্চা হয়েছে। নিতান্তই গরু গাধা ছাড়া পায়েস খেয়ে মানুষের বাচ্চা হয়, কেউ বিশ্বাস করবে?

রাম এবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন সীতার উপর।  বললেন, হতভাগী, আবাগীর বেটি, তুই আমার জন্ম নিয়ে বলিস্ । জানিস্, আমাদের রঘুবংশ, ইক্ষ্বাকু বংশ, সূর্য বংশ? আমার জন্ম বিষ্ণুর অংশে। আমি দশাবতারের অন্যতম।

হ‍্যাঁ, জানি তো, তুমি একটি বংশদণ্ড। তোমাকে নিয়ে ভারতে দাঙ্গা বাধায় পিশাচের দল।

ব‌উটাকে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করেন রাম। বলেন, দূর হয়ে যা এ বাড়ি থেকে!

সীতা আছাড়ি পিছাড়ি খেতে খেতে বলেন, চলেই যাব। আমি চলেই যাব। সত্যিকারের কোনো পুরুষের সঙ্গ পেলাম না। আমি চলেই যাব। আর গয়নাগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যাব। তুমি কুড়িয়ে নিও।

আর যাবার আগে গায়ে আগুন দেব। ডাইং ডিকলারেশন দিয়ে যাব যে, তুমি আমাকে সন্দেহ করতে। পরিষ্কার বধূ নির্যাতন। আইপিসির তিনশো চার বি আর ফোর নাইনটি এইটে কেস দেব। নন বেলেবল কগনিজেবল ওয়ারেন্ট কেস হবে। ছাড়া পাবে না।

সীতার কান্নাকাটি শুনে ঝি আর চাকর বাকরেরা উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। কৌশল‍্যা ছুটি এসে সীতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রামকে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন। ছিঃ বাবা, সীতা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী ঠাকরুণ। তার অযত্ন কোরো না। কৌশল‍্যার বুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন সীতা। কৌশল‍্যা বৌমা কে সান্ত্বনা দিতে দিতে যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দেন। বলেন, কী বলব মা, এদের বংশের বড়ছেলেরা খুব খারাপ হয়। দ‍্যাখো না এই গোটা কোশল রাজ‍্যটাই আমার বাপের বাড়ি থেকে দিয়েছে। তবুও রাজার ছোঁকছোঁকানি যায় না। হারেমে কত দাসী বাঁদি রয়েছে। তবু রাজার ভীমরতি। নয়া আওরৎ লে আও। আর কৈকেয়ীর সাথে এখনো কি রকম করেন। ঝি চাকরের কানাকানির জ্বালায় আমি টিঁকতে পারি না।  মনে হয় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ি। শুধু শুনেছি আপ্তঘাতী হলে আত্মা্য মুক্তি হয় না, ওই ভয়ে পারি না। ন‌ইলে সত‍্যি বলছি বড়ো বৌ, এদের সংসার ঠেলতে আমার ভাল লাগে না। এসব মনভোলানো কথা সীতার কানে ঢোকে না। হাপুস নয়নে কেঁদে চলেন।

রাম দূর থেকে তর্জন করে বললেন, মা, ও যদি সতীনারী হয়, তাহলে যেন সাতটা বছর পার করে তবে গায়ে আগুন দিয়ে বিদায় হয়। বিয়ের সাত বছর পেরিয়ে গেলে তার পর যা মনে আসে করুক।

অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে সীতা বলেন, জেলে যেতে তোমার এত ভয়! ঠিক আছে, তুমি একটা মায়ের বাছা। তোমার কোনো ক্ষতি আমি করব না। সাত নয়, চোদ্দ বচ্ছর আমি তোমার অত‍্যাচারকে সহ‍্য করে, আইনের হাত থেকে তোমাকে সুরক্ষিত রেখে আমি আগুনে আত্মাহুতি দেব।

কৌশল‍্যা সীতার শান্ত শক্ত উচ্চারণ শুনে কেঁপে উঠলেন। রামকে ধমক দিয়ে বললেন, আর একটা কথাও নয়। মাঝরাতে আর লোক হাসাস নি বাপু। কত্তা হাসপাতালে শুষছেন। আর তুই ঘরে বৌ পেটাচ্ছিস। আমার আর সহ‍্য হয় না বাপু।

সকাল বেলা মেঘ কেটে যায়। রামকে বেড টি এনে দেন সীতা। ওঠো ডার্লিং ওঠো ওঠো। মর্ণিঙ ফ্লাইট বলেছিলে।
হুঁ সোনা, এই উঠি। শোনো লক্ষ্মণ আমাদের সাথে যাবে।

এ ম‍্যা, সে কি গো। লক্ষ্মণটাকে নেবার কী দরকার? তাছাড়া ঊর্মিলা আছে। সে তো আমার একটা বোন। সে ভারি কষ্ট পাবে।

রাম অবজ্ঞার হাসি হেসে বলল,
ছাড়ো তো। বাড়িতে এত লোক। অঢেল খাওয়া দাওয়া। কষ্ট কিসের?

বাঃ রে। পেটে খেতে পেলেই হয়ে গেল? সব মেয়ের ইচ্ছে করে বরের আদর পেতে। সে রাজরানিই হোক, আর মেথরানিই হোক। বরের আদরের কাছে রাজভোগ তুচ্ছ।

রাম বলেন, ও তাই, এসো বলে বুকে জড়িয়ে ধরেন সীতাকে। কানে কানে বলেন লক্ষ্মণটাকে কেন রাখছি জানো?

ফিসফিসিয়ে সীতা বলেন কেন, কেন?

ধূর। তুমি কিচ্ছু বোঝো না ছাই। লক্ষ্মণটাকে রাখছি এইজন‍্যে যে ও ফাই ফরমাশ খাটবে।

সীতা বললেন, ঊর্মিলার চোখে জল পড়বে। মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তিও ব‍্যাপারটা ভাল চোখে নেবে না। এ তুমি কোরো না কিন্তু।

রাম বলল, ছাড়ো তো। লক্ষ্মণটার কোনো পার্সোনালিটি নেই। ওকে যা বলবো বিনা ওজরে খাটবে। আজকাল চাকর বাকর পর্যন্ত ইউনিয়ন করে। পার্টির ঝাণ্ডা ধরে মিছিলে যায়। লক্ষ্মণের মতো স্পাইনলেস ক্রিয়েচার পাব কোথায়?

সীতা বললেন, লাগেজ কি কি নিয়েছি শোনো। আমার জন্য সাতখানা নাইটি। আর তোমার জন‍্য সাতটা বারমুডা।

তাই? ও সব কিছুই নিতে হবে না। আমরা পোশাক আশাক কিছু পরব না।

সীতা ব‍্যাজার হয়ে বললেন, এম্ম‍্যা , সে কি? লক্ষ্মণ থাকবে বলছ। ওর সামনে আমি উদোম হব কি করে?

ছি ছি, উদোম হবে কেন? গাছের পাতা দিয়ে চমৎকার টু পিস বিকিনি বানিয়ে দেব। তোমাকে ডায়ানা বলে মনে হবে। আর আমি হব অরণ্যদেব। লক্ষ্মণ হবে..

সীতা হাততালি দিয়ে বললেন, গুরাণ।

রাম বললেন, দারুণ বলেছ।

সীতা বললেন, তুফান আর ডেভিলকে পাবে কেমন করে?

ডেবিট কার্ড তো থাকবে। এখন সব জায়গায় এটিএম আছে‌। তেমন বুঝলে পেটিএম এও কাজ চলবে। এখন সব জায়গাতেই মোবাইল টাওয়ার আছে।

মোবাইল ফোন থাকবে?

আহহা, ন‌ইলে ফেসবুকে স্ট‍্যাটাস আপডেট করবো কি করে?

সীতা বলল, কিন্তু খবরদার, আমার টু পিস বিকিনি পরা ছবি আপলোড কোরো না। আমি পছন্দ করব না।

রাম বলল, মাথা খারাপ? সোশ্যাল সাইটে আপলোড করব কেন? ক্লাউড আর ড্রাইভ আছে কী করতে?

সীতা বলল, আচ্ছা বস্ , তোমার যা হিম‍্যান মেট্রো সেক্সুয়াল চেহারা,  তোমাকে সিনেমার টারজানের পোশাকে দেখে কোনো আদিবাসী মেয়ে তোমার প্রেমে পড়ে গেলে কী হবে?

রাম চোখ টিপে বললেন, উরে, পারি না। ছোট লোকের মেয়ের এত সাহস হলে মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারব।

সীতা শঙ্কিত হয়ে বললেন, আর কোনো বুনো লোক যদি তোমার ব‌উয়ের হাত ধরে টানে, তাহলে?

রামের দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল। সেই আওয়াজ শুনে করোনার ছুটিতে আমার দিবানিদ্রা ভেঙে গেল।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.