![]() |
মৃদুল শ্রীমানীর গল্পগুচ্ছ |
মৃদুল শ্রীমানীর গল্পগুচ্ছ
দেশকে যে ভালবাসে
শমিতাকে দেখলে মন কেমন করে। বোকা মেয়েটা একটা ফালতু ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছিল। প্রেম করে ভেগে যাওয়া বিয়ে নয়। দেখেশুনে রেজিস্ট্রেশন করেই বিয়ে। তবু হয়রানির মুখে পড়ে বিয়ে নাকচের মামলা আনল মেয়ে। নালিটি অফ ম্যারেজ। সেই মামলা দিনের পর দিন চলত। উকিল নিত মুঠো মুঠো টাকা। রশিদ দিত না। রশিদ চাইতে শমিতা ভয়ও পেত। মামলা ফয়সালা হলে রায়ের কপি পেতে কলকাতার কোর্টে দিনের পর দিন ঘুরেছে মেয়ে। শেষে কোর্টের মহিলা কর্মচারী বেশ একগাদা টাকা ঘুষ নিয়ে তবে তাকে রায়ের সার্টিফায়েড কপি দিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রাক্তন বরের মা শমিতার বিরুদ্ধে ডাকাতির কেস দিয়েছে। তার জামিন পেতে একগাদা টাকা গাঁটগচ্ছা দিয়েছে শমিতা। উকিল টাকা নিয়েছে পুলিশের নাম করে। রশিদ চাইলে আরো দশহাজার বেশি লাগবে বলে শাসিয়েছে।
হঠাৎ শমিতা খবরের কাগজের পাতায় দেখল সীমান্তে আধা সেনা মরেছে কাদের গাফিলতির দায়ে। শমিতার ভিতর দেশপ্রেমের বাই চাগাড় দিয়ে উঠল। কবিতা লিখল মেয়ে। দেশপ্রেমের।
সেই শমিতা দেশপ্রেমিক দেখতে দেখতে হাঁফিয়ে ওঠেনি।
স্বপ্নলেখা মৈত্র আমার অনেকদিনের পরিচিত। ব্যাংককর্মী মেয়েটি সময় সুযোগ পেলেই সেতার বাজান। ওতেই তাঁর প্রাণের আরাম, মনের তৃপ্তি। পঁচিশ বছর বয়সে, চাকরি পাবার ঠিক দু বছরের মাথায়, সুরঞ্জনের সাথে বিয়ে হয়েছিল স্বপ্নলেখার। পঁচিশ বছর জোড়াতালি দিয়ে সংসার করতে করতে স্বপ্নলেখার একদিন মনে হল সুরঞ্জনের সাথে আর এক ছাতের নিচে থাকা যায় না। ওঁদের শয্যা আলাদা হয়ে গিয়েছিল অনেকদিন আগেই। একমাত্র মেয়ে তখনো মাধ্যমিকটুকু পাশ করেনি। সুরঞ্জন সিঁড়ি টপকে টপকে উপরে উঠে যাচ্ছেন। তাঁর ব্যস্ততা অনেক। দুজনের মধ্যে সংসারের কথাও আর বিশেষ হত না। বড়ো হাত পা মেলে থাকার মতো ফ্ল্যাটে তিন তিনটি বেডরুমে তিন জন যে যাঁর মতো। ঘরে কখনো থাকলেও সুরঞ্জন মোবাইলে ব্যস্ত থাকতেন। তাই একদিন স্বপ্নলেখার মনে হল এই মেকি দাম্পত্য থেকে মুক্তি চাই। তাঁরও মনে ধরেছিল প্রবীণকে। প্রবীণ এর বউ ক্যানসারে মারা গিয়েছেন। সে সময়টা স্বপ্নলেখার চোখে পড়েছে বৌয়ের জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন প্রবীণ। নিজের সবটুকু সঞ্চয় প্রায় নিঃশেষ করে দিয়েছেন স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যে।
সে সময়টা প্রবীণের পাশে ছিলেন স্বপ্নলেখা। তাঁর স্ত্রীর জন্য ফল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন তিনি। প্রবীণ অতি যত্নে মরণোন্মুখ স্ত্রীকে ফলের রস খাইয়ে দিতেন। প্রবীণের স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েকদিন পর স্বপ্নলেখা তাঁকে ধরে পড়লেন - "তোমাকে আমি একলা থাকতে দেব না।" প্রবীণ বলেছিলেন "স্বপ্ন, কি করতে বলো?"
স্বপ্নলেখা বলেছিলেন সুরঞ্জনের সাথে তাঁর ধারাবাহিক সম্পর্কহীনতার কথা। প্রবীণ বলেছিলেন, "তোমাদের মেয়েটির কি হবে?"
স্বপ্নলেখা বলেছিলেন, "সে আঠারো পেরোলো এই শ্রাবণে। সে জানে বাবার সাথে থাকলেই তার সুবিধে। সুরঞ্জনেরও আপত্তি নেই।"
প্রথাগত ডিভোর্সের কাজ পুরো মেটার আগেই সুরঞ্জনের ঘর ছাড়লেন স্বপ্নলেখা। স্ত্রীর ব্যয়সাধ্য চিকিৎসার জন্য নিজের ঝলমলে ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছিলেন প্রবীণ। সে খবরটুকুও দেন নি হতভাগিনী স্ত্রীকে। উঠে এসেছিলেন একটা এক কামরা ভাড়া ঘরে। সেখানেই একদিন স্বপ্নলেখার সাথে শুভদৃষ্টি হল তাঁর। স্ত্রীর মৃত্যুর তখনো তিনমাস পূৰ্ণ হয় নি। স্বপ্নলেখা আমাকে হঠাৎ একদিন ফোন করে জানতে চাইলেন "আমি কি আমার প্রাক্তন স্বামীর পদবী ব্যবহার করতে পারি?"
বলা গেল "নিশ্চয় করতে পারেন। একজন ভদ্রমহিলা নিজের নামের সাথে পদবী হিসেবে কোন শব্দ ব্যবহার করবেন, বা না করবেন, তা সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ নিয়ে সরকারের বা রাষ্ট্রের মাথা গলাবার এক্তিয়ারটাই নেই।"
স্বপ্নলেখা বললেন "আমার যে সবকিছু আমার পঁচিশ বছরের আমির নামে। ব্যাঙ্ক একাউন্ট, জীবনবীমা পলিসি, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, সবকিছু।"
বলা গেল "কোনো চিন্তা নেই। ওগুলি আবার সংশোধন করতে আপনি আইনত বাধ্য নন।"
ফোনের ওপার থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ভেসে এল।
সেই যে মেয়েটি। বাড়ি তার ঈশানী পাড়ায়। পরনে তার ধানি রঙের শাড়ি। যৌবন তার শুধু দেহে নয়, মনখোলা হাসিতে, কথায় আর গানে তার জীবন জয় করার মন্ত্র। নন্দিনী মেয়েটাকে কে না চেনে? গ্রামের পাঁচ জনে তাকে আপন জেনে ভালবেসে ডাকে নন্দিন। তার সুমধুর চলার ছন্দ তার শাড়িতেও সুর তোলে। সে যখন পাড়ার তড়াগে গাগরি ভরণে আসে, ছল করে কত ছেলে তমাল তরুর তলে দাঁড়িয়ে থাকে। সে মেয়ে চোখের কোণে হাসির ঝিলিক তুলে চলে যায়। শুধু কি জোয়ান ছেলেদের বুকে দোলা দেয় নন্দিন ? প্রবীণেরাও সে মেয়েকে দেখলে একটু রসের গল্প না করে ছাড়ে না। সে মেয়ে কাউকে ফেরায় না, সকলের সাথেই তার সহজ সম্পর্ক, সকলের সাথেই তার প্রাণের টান। তবু সবাই জানে নন্দিনী বিশেষ করে রঞ্জনের। কেননা উপচে ওঠা নদীর জলকে তোলপাড় করে সে নন্দিনীকে জিতে নিয়েছে।
সর্দারদের ওইখানে ভয়। তারা নন্দিনী আর রঞ্জনের জোটকে মারাত্মক ভয় পায়। তাই রঞ্জনের কাছ থেকে নন্দিনীকে আলাদা করতে তারা মরিয়া। রঞ্জনকে হাতে পায়ে শিকল বেঁধে কাজ করতে পাঠালে খনি গর্ভে। আর নন্দিনীকে টেনে আনলে যক্ষপুরীর কেন্দ্রে, যেখানে জালের আড়ালে অজগর সাপের মতো ওঁত পেতে আছে রাজা। এই রাজাকে দেখা যায় না। তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠকায়। এক সাংঘাতিক ভাঙ্গন বিশারদ। তাঁর নজরের সামনে নন্দিনীকে ধরে দিলে সর্দারেরা। মনোগত ইচ্ছেটা এই যে রাজার সাথে কোনোভাবে জড়িয়ে গিয়ে নন্দিনীর অন্তরের শুভ্র সারল্য ঘুচে গেলে রঞ্জনের বুকে তা মারণশেল হয়ে উঠবে। তখন রঞ্জনকে আর বেঁধে রাখতে হবে না। ঝিমিয়ে পড়বে সে চিরকালের জন্য।
নন্দিনীকে দেখে যক্ষপুরে কেমন একটা আলোড়ন পড়ে গেল। কেউ তাকে সন্দেহ করে। এ মেয়ে কি রূপের পসরা নিয়ে ছেলেদের মন ভুলিয়ে বেড়ায় ? তাকে ডাইনী ভাবতেও বাধল না কারো কারো।
আর কেউ কেউ তাকে দেখে নতুন করে বাঁচতে চাইল। এমন কি যক্ষপুরীর ক্ষমতার অলিন্দে যারা, সেই সর্দারেরা ও কেউ কেউ নন্দিনীর গুণমুগ্ধ। সর্দারি বৃত্তের ধারে পাশে যাদের চলন সেই অধ্যাপক, পুরাণবাগীশ, থিঙ্ক ট্যাংকরাও নন্দিনীর উপস্থিতিতে কি রকম একটা বিহ্বলতায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। সে মেয়ে যেন সাক্ষাৎ যৌবনদেবী।
কিন্তু নন্দিনীর সবচেয়ে বড় বাজি যক্ষপুরীর রাজা। নন্দিনী তাঁর মতো নিষ্ঠুরের প্রাণের গভীরে দোলা তুলে দিতে তিনি ভয় পেয়েছিলেন। নন্দিনীকে শেষ করে ফেলার কথাও ভেবেছিলেন। নন্দিনীর খোলা গলার গান শুনলে তাঁর নিজের কাছে নিজের অন্তঃসারশূন্যতা তাঁকে হাঁ করে গিলতে আসত।
নন্দিনী দিন বদলের লড়াই ঘনিয়ে দিল যক্ষপুরীর সমাজে। তার জন্যে তাকে মূল্য দিতে হয়েছিল, যেমন মূল্য চিরকাল মুক্তিপথের অগ্রদূতেরা দিয়ে এসেছেন। আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে নন্দিনীর ম্যাজিক দেখতে থাকি।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন