![]() |
স্বপ্নলেখার সংসার : মৃদুল শ্রীমানী |
স্বপ্নলেখা মৈত্র আমার অনেকদিনের পরিচিত। ব্যাংককর্মী মেয়েটি সময় সুযোগ পেলেই সেতার বাজান। ওতেই তাঁর প্রাণের আরাম, মনের তৃপ্তি। পঁচিশ বছর বয়সে, চাকরি পাবার ঠিক দু বছরের মাথায়, সুরঞ্জনের সাথে বিয়ে হয়েছিল স্বপ্নলেখার। পঁচিশ বছর জোড়াতালি দিয়ে সংসার করতে করতে স্বপ্নলেখার একদিন মনে হল সুরঞ্জনের সাথে আর এক ছাতের নিচে থাকা যায় না। ওঁদের শয্যা আলাদা হয়ে গিয়েছিল অনেকদিন আগেই। একমাত্র মেয়ে তখনো মাধ্যমিকটুকু পাশ করেনি। সুরঞ্জন সিঁড়ি টপকে টপকে উপরে উঠে যাচ্ছেন। তাঁর ব্যস্ততা অনেক। দুজনের মধ্যে সংসারের কথাও আর বিশেষ হত না। বড়ো হাত পা মেলে থাকার মতো ফ্ল্যাটে তিন তিনটি বেডরুমে তিন জন যে যাঁর মতো। ঘরে কখনো থাকলেও সুরঞ্জন মোবাইলে ব্যস্ত থাকতেন। তাই একদিন স্বপ্নলেখার মনে হল এই মেকি দাম্পত্য থেকে মুক্তি চাই। তাঁরও মনে ধরেছিল প্রবীণকে। প্রবীণ এর বউ ক্যানসারে মারা গিয়েছেন। সে সময়টা স্বপ্নলেখার চোখে পড়েছে বৌয়ের জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন প্রবীণ। নিজের সবটুকু সঞ্চয় প্রায় নিঃশেষ করে দিয়েছেন স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যে।
সে সময়টা প্রবীণের পাশে ছিলেন স্বপ্নলেখা। তাঁর স্ত্রীর জন্য ফল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন তিনি। প্রবীণ অতি যত্নে মরণোন্মুখ স্ত্রীকে ফলের রস খাইয়ে দিতেন। প্রবীণের স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েকদিন পর স্বপ্নলেখা তাঁকে ধরে পড়লেন - "তোমাকে আমি একলা থাকতে দেব না।" প্রবীণ বলেছিলেন "স্বপ্ন, কি করতে বলো?"
স্বপ্নলেখা বলেছিলেন সুরঞ্জনের সাথে তাঁর ধারাবাহিক সম্পর্কহীনতার কথা। প্রবীণ বলেছিলেন, "তোমাদের মেয়েটির কি হবে?"
স্বপ্নলেখা বলেছিলেন, "সে আঠারো পেরোলো এই শ্রাবণে। সে জানে বাবার সাথে থাকলেই তার সুবিধে। সুরঞ্জনেরও আপত্তি নেই।"
প্রথাগত ডিভোর্সের কাজ পুরো মেটার আগেই সুরঞ্জনের ঘর ছাড়লেন স্বপ্নলেখা। স্ত্রীর ব্যয়সাধ্য চিকিৎসার জন্য নিজের ঝলমলে ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছিলেন প্রবীণ। সে খবরটুকুও দেন নি হতভাগিনী স্ত্রীকে। উঠে এসেছিলেন একটা এক কামরা ভাড়া ঘরে। সেখানেই একদিন স্বপ্নলেখার সাথে শুভদৃষ্টি হল তাঁর। স্ত্রীর মৃত্যুর তখনো তিনমাস পূৰ্ণ হয় নি। স্বপ্নলেখা আমাকে হঠাৎ একদিন ফোন করে জানতে চাইলেন "আমি কি আমার প্রাক্তন স্বামীর পদবী ব্যবহার করতে পারি?"
বলা গেল "নিশ্চয় করতে পারেন। একজন ভদ্রমহিলা নিজের নামের সাথে পদবী হিসেবে কোন শব্দ ব্যবহার করবেন, বা না করবেন, তা সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ নিয়ে সরকারের বা রাষ্ট্রের মাথা গলাবার এক্তিয়ারটাই নেই।"
স্বপ্নলেখা বললেন "আমার যে সবকিছু আমার পঁচিশ বছরের আমির নামে। ব্যাঙ্ক একাউন্ট, জীবনবীমা পলিসি, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, সবকিছু।"
বলা গেল "কোনো চিন্তা নেই। ওগুলি আবার সংশোধন করতে আপনি আইনত বাধ্য নন।"
ফোনের ওপার থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ভেসে এল।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন