![]() |
নন্দিনী রক্তকরবী হয়ে ওঠা, রবীন্দ্র মানসের অসামান্য অবদান : মৃদুল শ্রীমানী |
সেই যে মেয়েটি। বাড়ি তার ঈশানী পাড়ায়। পরনে তার ধানি রঙের শাড়ি। যৌবন তার শুধু দেহে নয়, মনখোলা হাসিতে, কথায় আর গানে তার জীবন জয় করার মন্ত্র। নন্দিনী মেয়েটাকে কে না চেনে? গ্রামের পাঁচ জনে তাকে আপন জেনে ভালবেসে ডাকে নন্দিন। তার সুমধুর চলার ছন্দ তার শাড়িতেও সুর তোলে। সে যখন পাড়ার তড়াগে গাগরি ভরণে আসে, ছল করে কত ছেলে তমাল তরুর তলে দাঁড়িয়ে থাকে। সে মেয়ে চোখের কোণে হাসির ঝিলিক তুলে চলে যায়। শুধু কি জোয়ান ছেলেদের বুকে দোলা দেয় নন্দিন ? প্রবীণেরাও সে মেয়েকে দেখলে একটু রসের গল্প না করে ছাড়ে না। সে মেয়ে কাউকে ফেরায় না, সকলের সাথেই তার সহজ সম্পর্ক, সকলের সাথেই তার প্রাণের টান। তবু সবাই জানে নন্দিনী বিশেষ করে রঞ্জনের। কেননা উপচে ওঠা নদীর জলকে তোলপাড় করে সে নন্দিনীকে জিতে নিয়েছে।
সর্দারদের ওইখানে ভয়। তারা নন্দিনী আর রঞ্জনের জোটকে মারাত্মক ভয় পায়। তাই রঞ্জনের কাছ থেকে নন্দিনীকে আলাদা করতে তারা মরিয়া। রঞ্জনকে হাতে পায়ে শিকল বেঁধে কাজ করতে পাঠালে খনি গর্ভে। আর নন্দিনীকে টেনে আনলে যক্ষপুরীর কেন্দ্রে, যেখানে জালের আড়ালে অজগর সাপের মতো ওঁত পেতে আছে রাজা। এই রাজাকে দেখা যায় না। তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠকায়। এক সাংঘাতিক ভাঙ্গন বিশারদ। তাঁর নজরের সামনে নন্দিনীকে ধরে দিলে সর্দারেরা। মনোগত ইচ্ছেটা এই যে রাজার সাথে কোনোভাবে জড়িয়ে গিয়ে নন্দিনীর অন্তরের শুভ্র সারল্য ঘুচে গেলে রঞ্জনের বুকে তা মারণশেল হয়ে উঠবে। তখন রঞ্জনকে আর বেঁধে রাখতে হবে না। ঝিমিয়ে পড়বে সে চিরকালের জন্য।
নন্দিনীকে দেখে যক্ষপুরে কেমন একটা আলোড়ন পড়ে গেল। কেউ তাকে সন্দেহ করে। এ মেয়ে কি রূপের পসরা নিয়ে ছেলেদের মন ভুলিয়ে বেড়ায় ? তাকে ডাইনী ভাবতেও বাধল না কারো কারো।
আর কেউ কেউ তাকে দেখে নতুন করে বাঁচতে চাইল। এমন কি যক্ষপুরীর ক্ষমতার অলিন্দে যারা, সেই সর্দারেরা ও কেউ কেউ নন্দিনীর গুণমুগ্ধ। সর্দারি বৃত্তের ধারে পাশে যাদের চলন সেই অধ্যাপক, পুরাণবাগীশ, থিঙ্ক ট্যাংকরাও নন্দিনীর উপস্থিতিতে কি রকম একটা বিহ্বলতায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। সে মেয়ে যেন সাক্ষাৎ যৌবনদেবী।
কিন্তু নন্দিনীর সবচেয়ে বড় বাজি যক্ষপুরীর রাজা। নন্দিনী তাঁর মতো নিষ্ঠুরের প্রাণের গভীরে দোলা তুলে দিতে তিনি ভয় পেয়েছিলেন। নন্দিনীকে শেষ করে ফেলার কথাও ভেবেছিলেন। নন্দিনীর খোলা গলার গান শুনলে তাঁর নিজের কাছে নিজের অন্তঃসারশূন্যতা তাঁকে হাঁ করে গিলতে আসত।
নন্দিনী দিন বদলের লড়াই ঘনিয়ে দিল যক্ষপুরীর সমাজে। তার জন্যে তাকে মূল্য দিতে হয়েছিল, যেমন মূল্য চিরকাল মুক্তিপথের অগ্রদূতেরা দিয়ে এসেছেন। আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে নন্দিনীর ম্যাজিক দেখতে থাকি।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন