অভাগীনির নক্সী-গাঁথা : কর্ণধর মণ্ডল

অভাগীনির নক্সী-গাঁথা : কর্ণধর মণ্ডল
অভাগীনির নক্সী-গাঁথা : কর্ণধর মণ্ডল

পর্বঃ-৭ম(অন্তিম পর্ব)

     পাশকুঁড়া গ্রাম থেকে কবিরাজ মশাইয়ের মৃতদেহ দু'জনে কাঁধে নিয়ে,প্রায় তিন মাইল পথ হেঁটে আসার পর শ্মশানে পৌঁছলেন।শ্মশানে কবিরাজ মশাইয়ের জাতি-গোত্রীয় উপাচার মেনে মৃতদেহ অন্তিম স্বত্-কার্য সম্পন্ন করে,আপন পর্ণ-কুঠিরে ফিরলেন।নিরুপমা দু'চোখে বিরহ'অশ্রু নিয়ে।
----একেই বলে "বিধিলিপি"।একের পর এক জীবন মরুর কন্টকাকীর্ণ বালিয়াড়ী ও মরুত্বট অতিক্রান্ত করে সামনে এগিয়ে চললেন।

     এই ভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর,সন্তান-সম্ভবা অভাগী নিরুপমা ও সত্যের সংগ্রামী রুপমের সুখের সংসারে স্বাগত জানাতে নতুন অতিথি শুভা'গমন করলেন।সুন্দর ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান।অভাবের সংসারে রুপম হলেন পিতা ও নিরুপমা হলেন মাতা।দুই দম্পত্তি আদর করে পুত্রের নাম রাখলেন "অনুক্ষণ"।এই শুভ সংবাদটি পৌঁছে গেল জমিদার দুর্যোধন রায় চৌধুরীর কর্ণ-কুহরে ও রাজদরবারে। সু-সংবাদটি পাওয়ার পর, একটি বারের জন্য দেখতে এলেন না,পরবর্তী বংশধর ও নাতি অনুক্ষণকে।হয়তো বুকের ভিতরে জমে থাকা রাগটাকে সংবরণ করতে পারেননি।অথবা মনে মনে পুষে রাখেছেন নতুন কোন অভিসন্ধি।যা সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে ব্যবহার করবার জন্য।

----ছোট্ট অনুক্ষণকে নিয়ে রুপম ও নিরপমার অভাবী সংসারে সুখের প্লাবন।শত দারিদ্রতা থাকলেও এতটুকু কষ্টের আঁচ লাগতে দেয়নি রুপম ও নিরুপমা তার সন্তানকে।শত অভাব দারিদ্রতার মধ্যে দিয়ে খেয়ে না খেয়ে অনুক্ষণকে বড়ো করে তুলতে লাগলেন।অনুক্ষণের বয়স এখন হয়েছে চার বৎসর।
----প্রতিদিনের মতো রুপম,আজও গেলেন মাছ ধরতে।ডিঙি নৌকা নিয়ে রুপসার মাঝ-দরিয়ায়।কি জানি আজ ভাগ্যের কোন পরিহাস......
----হঠাৎ ঘুটঘুটে কালো মেঘ, সারা আকাশ দিলো ঢেকে।নৌঙর তুলে নৌকা তীরে ভিঁড়ানোর সুযোগ পর্যন্ত দিলো না।প্রবল বর্ষণ,গর্জণে আর বিদ্যুতের ঝলকানি।প্রাণ কাড়া কালবৈশাখী ঝড়ে রুপমের নৌকা দিলো মাঝ-দরিয়াতে ডুবিয়ে।শত চেষ্টা করেও রুপম প্রাণে বেঁচে ফিরলেন না আর বাড়ীতে।হায় রে বিধিলিপি........
        " যার কেহ নাই তাকে দাও শত আঘাত"!
        "সর্বহারা অভাগীনির জীবনে এ কেমন অভিশাপ "??

----এই ভয়ংঙ্কর দুঃসংবাদটি গিয়ে পৌঁছালো অভাগী নিরুপমার কর্ণ-কুহরে।শুনে,স্তম্ভিত,নীরব,বোধির হয়ে গেলেন।মুখে কোন ভাষা নেই  "এ কেমন অভিসম্পাত"।নিরুপমার স্বপ্নের দুনিয়াটা মুহুর্তের মধ্যে ভেঙে চুরে হয়ে গেল ছারখার,চুর্ণ-বিচুর্ণ।তার মাথায় যেন আশমান ভেঙে পড়লো।সারা পৃথিবীটা হয়ে গেল নিরুপমার কাছে নৃগুঢ় অন্ধকার।ছোট্ট অনুক্ষণ হলেন অকালে পিতৃহারা। এ কেমন বিধাতার নির্মম নির্দোয় বিচার।অভাগীনিকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো আপন-স্বজন কেউ নেই।ছোট্ট সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ডুগরে ডুগরে কাঁদতে লাগলেন অভাগীনি নিরুপমা।

----দুঃসংবাদটি গিয়ে পৌঁছালো নির্দোয় জমিদার দুর্যোধর রায় চৌধুরী ও তার অহংকারী স্ত্রী মন্দাকীনির কর্ণে।সঙ্গে সঙ্গে নির্দোয় জমিদার গিয়ে পৌঁছালেন রুপসা গ্রামে,রুপসা নদীর তীরে অভাগীনির পর্ণ-কুঠিরে।পুত্র হারানোর যন্ত্রণায় ব্যথিত না হয়ে,পাষাণ-নির্দোয়-নির্মম মানসীকতার পরিচয় দেখালেন।হায় রে!নিষ্ঠুর বিধাতা এ কেমন তোমার বিচার?
----মানুষ যে এমন নিষ্ঠুর হতে পারে তা জানা ছিলো না।সহায় সর্বস্ব হারা অসহায় অভাগীনিকে চোখের জল মুছিয়ে,সান্ত্বনা দিতে পিতৃ-স্নেহে কোলে টেনে নেওয়া ভুলে,সন্তান হারানোর যন্ত্রণা ভুলে নানা অছিলায় ও কটু ভাষাতে তিরস্কৃত করতে লাগলেন অভাগীনি নিরুপমাকে।

     অবশেষে অভাগীনির শেষ সম্বল,একমাত্র হৃদয়ের হৃদ্-স্পন্দন ও অন্ধ-নয়নের মনি অনুক্ষণকে অসহায় মায়ের কোলে থেকে ছিনিয়ে নিলেন অহংকারী পাষন্ড অত্যাচারী জমিদার।
----বললেন!আমার বংশ প্রদীপকে এই কু-লক্ষনার কাছে থেকে নিয়ে গেলাম। "হায় রে মানুষ!এ কেমন তোমাদের বিচার"?যে অভাগীর জন্ম নীচু জাতের ঘরে বলে,নাম ধরে পর্যন্ত ডাকলেন না।অথচ তাঁর রক্ত-মাংসে গড়া স্তন-দুগ্ধ খেয়ে তিলে তিলে বেড়ে ওঠা বত্রিশ নাড়ি ছিন্ন করা সন্তানকে ছিনিয়ে নেয়  "বংশ-প্রদীপ '' বলে।
হে অহংকারী দুর্যোধন জমিদার।এ তোমার কেমন কেমন বিচার......??

     স্বামীর বিরহ-বিয়োগ ও সন্তানের মাতৃত্বের বন্ধন উৎছেদনে,সহায় সর্বস্ব হারা অভাগীনি নিরুপমা অবিরত চোখের জল ফেলছে ও অশেষ প্রতিক্ষায় রুপসার জল-স্রোতের দিকে তাকিয়ে বসে আনমনে যেন কার কথা ভাবছে।নেই নাওয়া,নেই  খাওয়া।নেই দু'চোখে ঘুম।নেই কোন অভিযোগ।নীরবে নিভৃতে সে লিখে চলেছে নয়ন ধারার বেদনা'শ্রুর কালি দিয়ে। " অভাগীনির নক্সি-গাঁথা " -য় দুঃখ-যন্ত্রণা, বেদনার হাজার বিরহের  কথা।স্মৃতির পাতায়, অন্তেঃ অন্তেঃ।

----নিয়তির পরিহাস বড়োই নির্মম।অভাগীনি এখন নিঃস্ব,পথের ভিক্ষারী।এ ভাবেই কেটে গেল অভাগীনির ভিক্ষারীর বেশে দীর্ঘঃ এক যুগ।অভাগীনির সন্তান অনুক্ষণের বয়স হয়েছে পনের বছর।সে এখন বুঝতে শিখেছে।সবাই যখন বাবা-মাকে নিয়ে ঘুরতে যায়, বেড়াতে যায় তখন অনুক্ষণের মনে খুব কষ্ট হয়।তার মনে কৌতুহল জন্মায় কে ওর বাবা-মা।বারংবার জমিদার দুর্যোধন ও মন্দাকীনির কাছে জানতে চাইলে,হাজার গল্পের ছলে সে কথাকে এড়িয়ে যায়।

----হঠাৎ একদিন মহল্লায় এক গরীব চাষীর মুখে রুপকথার গল্প শুনতে শুনতে জানতে পারেন তার বাবা-মায়ের পরিচয়।যে রুপকথার গল্পের নায়ক ছিলেন রুপম ও অভাগীনি রুপ-কুমারী নিরুপমা।এই রুপ-কুমার ও অভাগীনি রুপ-কুমারী দুজনে অনুক্ষণের বাবা-মা।যে গল্পে রুপ-কুমার মারা যায়।এবং রুপ-কুমারী অভাগীনি আজো পথের কাঙাল ভিক্ষারী।এই চরম সত্য কথাটি জানবার পর যখন অনুক্ষণ অহংকারী জমিদারের কাছে জানতে চায়,কেন এমন অবিচার করেছেন তার বাবা-মায়ের উপর।তখন দাম্ভিক জমিদার নিঃশ্চুপ রইলেন।মুখে কোন কথা বললেন না।কারন দাম্ভিক জমিদার সেদিন মর্মে মর্মে অনুভব করেছেন!কতো বড়ো অন্যায় অবিচার তার পুত্র রুপম ও অভাগীনি নিরুপমার উপর করেছিলেন।

     অনুক্ষণ ছুটে চললেন দু-তিন মাইল পথ হেঁটে অভাগীনি মা নিরুপমাকে দেখ বার জন্য রুপসী নদী তীরে পর্ণ-কুঠিরের অভিমুখে।সেই জায়গাতে এসে অভাগী মা-কে দেখতে পেলেন না।আর পিছে পিছে পালকি সাজিয়ে নিয়ে চললেন জমিদার দুর্যোধন রায় চৌধুরী।

----কিছুটা দুরে নদীর তীরে,একটা পোড়ো মন্দির দেখতে পেলেন।অনুক্ষণ ছুটে চললেন সেখানে।দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।পাশে শ্মশানে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছেন সর্বস্ব হারা অভাগীনি মা নিরুপমা।বুকের উপর স্ব-যত্নে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন,সুখ-দুঃখ-বেদনা জমানো হাজার স্মৃতির কথাব্য- " নক্সী-গাঁথা " খানি।
----সেই ব্যথাময়, বেদনাময়,শত শত আঘাতে বিধ্বস্ত অভাগীনি মা-কে দেখে,অনুক্ষণ দু'চোখের জলকে ধরে রাখতে পারলেন না।স্ব-যত্নে সেই কাব্য খানি তুলে নিয়ে অশ্রু-বিগলিত দু'নয়নে পড়তে লাগলেন।কিছুক্ষণ পর,মৃত মায়ের দেহটা নিয়ে চিতা সাজিয়ে মুখা'গ্নি করে সলিল সমাধি করলেন।পুর্ব-পুরুষ ও স্বামী রুপমের সমাধির পাশে অভাগীনি নিরুপমা মা-য়ের দেহ-ভষ্ম সমাধিস্থ করে রাখলেন।এবং মৃত অভাগীনি মা-য়ের শেষ ইচ্ছা পুরণ করতে, সমাধির উপরে " নক্সী-গাঁথা " খানি স্ব-যত্নে বিছায়ে দিলেন।মাতৃ-পিতৃহারা অনুক্ষণ আজো বিনিদ্র-রজনী বাবা-মায়ের সমাধি তলে বসে দু-নয়নের অশ্রুবারি ঝরায়........!!
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.